খাগড়াছড়িতে তিন দিনের বর্ষবরণ উৎসব “বৈসাবি” আনুষ্ঠানিকতা শুরু

॥ মোহাম্মদ আবু তৈয়ব, খাগড়াছড়ি ॥ খাগড়াছড়ির চেঙ্গী, ফেনী ও মাইনী নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে খাগড়াছড়িতে শুরু হয়েছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী প্রধান সামাজিক ও প্রাণের উৎসব ‘বৈসাবি’। ফুল বিঝুকে কেন্দ্র নদীর পাড়গুলো হাজারো তরুণ-তরুণীর মিলন মেলায় পরিণত হয়।
বুধবার (১২এপ্রিল) ভোরে পাহাড়ি সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণী, কিশোরী-ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা সকালে ফুল তুলে গঙ্গা দেবীর উদ্দেশ্যে নদী-খালে ভাসিয়ে পুরাতন বছরের গ্লানি মুছে নতুন বছরের শুভ কামনায় নিজেদের পবিত্রতা কামনা করে।
ফুল বিজু, মূলবিজু ও বিচিকাতাল নামে নিজস্ব বৈশিষ্টতায় এ উৎসবে আনন্দের আমেজ ছড়ায়। ত্রিপুরা ভাষায় এ উৎসবকে বৈসু, মারমা ভাষায় সাংগ্রাই এবং চাকমা ভাষায় বিজু বলা হয়। ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা এই তিন সম্প্রদায়ের উৎসবের নাম একত্র করে বৈসাবি শব্দটির উৎপত্তি।
ত্রিপুরা ও চাকমা সম্প্রদায় আজ মবুধবারফুল বিজু পালন করছে। রাতে উড়বে হাজারো ফানুস বাতি। আজ বৃহস্পতিবার মূল বিঝু আর পহেলা বৈশাখ বা গজ্জাপয্যা পালন করবে। ঐদিন ঘরে ঘরে চলবে অতিথি আপ্যায়ন। ত্রিপুরা সম্প্রদায় হারিবৈসু, বিযুমা, বিচিকাতাল। শুক্রবার মারমা সম্প্রদায় সাংগ্রাই উৎসবে ঐতিহ্যবাহী জলকেলি বা পানি খেলা ও জেলা প্রশাসনে উদ্যোগে হবে বর্ষবরণের র‌্যালী।
পাশিপাশি তঞ্চঙ্গ্যা, বম, খিয়াং, লুসাই, পাংখোয়া, ম্রো, খুমি, আসাম, চাক ও রাখাইনসহ ১৩টি ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠী তাদের ভাষা-সংস্কুতি ও অবস্থানকে বৈচিত্রময় করে করে তুলতে প্রতি বছর চৈত্রের শেষ দিন থেকে ‘বৈসাবি’ উৎসব পালন করে থাকে।
এদিকে, খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় পার্বত্য অঞ্চলে ঐতিহ্যবাহী উৎসব বিঝু উপলক্ষে বর্ণাঢ্য র‌্যালি বের করেছে দীঘিনালা বৈ-সা-বি উদযাপন কমিটি। গতবুধবার সকালে উপজেলার লারমা স্কোয়ার থেকে র‌্যালিটি শুরু হয়। র‌্যালিতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, দীঘিনালা জোন অধিনায়ক লে.কর্ণেল মো. ফেরদৌস জিয়াউদ্দীন মাহমুদ।
এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নব কমল চাকমা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মো. শহীদ হোসেন চৌধুরী, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সুসময় চাকমা, গোপাদেবী চাকমা, দীঘিনালা প্রেসক্লাবের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম রাজু, এবং বোয়ালখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান চয়ন বিকাশ চাকমাসহ বিভিন্ন এলাকার যুবক-যুবতীরা।
পরে সবাই র‌্যালি সহকারে উপজেলার মাইনী নদীতে গিয়ে সকল সম্প্রদায়ের মঙ্গল কামনা করে নদীতে ফুল ভাসা কর্মসূচিতে অংশ নেয়। এর আগে  রিবেং যুব সংঘ, মধ্য বোয়ালখালী গাবুজ্যা-গাবুরী র‌্যালি ও ফুল ভাসা কর্মসূচিতে অংশ নেয়।
অপরদিকে, খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলায় ফুল বিঝু’র দিনে চেংগী নদীর রাবার ড্যাম এলাকায় ফুল ভাসানো উৎসবের মধ্য দিয়ে এক বর্ণ্যাঢ্য বৈ-সা-বি র‌্যালি অনুষ্ঠিত হয়েছে।
গতকাল বুধবার সাত সকাল থেকেই এ উপলক্ষে উপজেলার অপরূপ সৌন্দর্যের স্থান শান্তিপুর রাবার ড্যাম এলাকা পরিনত হয় আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার মিলন মেলায়।
সকাল ৮টায় চেংগী নদীর পানিতে ফুল ভাসিয়ে পুরাতন বছরের গ্লানি মুছে নতুন বছরের শুভ কামনায় নিজেদের মঙ্গল কামনা করে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী প্রধান সামাজিক ও প্রাণের এবারের উৎসবটি হার মানিয়েছে বিগত দিনের উৎসব গুলিকে। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও সাঁওতাল সম্প্রদায়ের বাহারী পোশাক, ঢাক-ঢোলের শব্দের তালে তালে নৃত্য, ব্যান্ড পার্টির সুরেলা গান আর মোবাইলের সেলফি তোলার প্রাণবন্ত মুহুর্তগুলো মুখরিত করে রেখেছিল রাবার ড্যাম ও তার আশ-পাশ এলাকা।
জেলা পরিষদ সদস্য সতীশ চন্দ্র চাকমা, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সর্বোত্তম চাকমা, ১নং লোগাং ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান সমর বিকাশ চাকমা, বর্তমান চেয়ারম্যান প্রত্যুত্তর চাকমা, ২নং চেংগী ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান অনিল চন্দ্র চাকমা বর্তমান কালা চাদ চাকমা, ৩নং পানছড়ি ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান অসেতু বিকাশ চাকমা, ৪নং লতিবান ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান শান্তি জীবন চাকমা, ৫নং উল্টাছড়ি ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান সুব্রত চাকমা বর্তমান বিজয় চাকমাসহ বিভিন্ন এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গরা মিলে এক সাথে চেংগী নদীতে ফুল ভাসিয়ে সূচনা পর্ব শুরু করে।
পরবর্তীতে এক বিশালাকার র‌্যালি পানছড়ির প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। সব মিলে এবারের ফুল বিঝু মাত করে দিয়েছে পুরো পানছড়িকে।
অপরদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি চুক্তি বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠন ইউপিডিএফ সর্ববৃহৎ সামাজিক উৎসব বৈসাবি উপলক্ষে তিন দিন সরকারি ছুটি ঘোষণাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে কমর্রত সরকারি-আধা সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি ও শিক্ষার্থীদের বিশেষ বন্দোবস্তের মাধ্যমে ছুটি-ভাতা ও পরীক্ষার রুটিন নির্ধারণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর সভাপতি প্রসিত খীসা ও সাধারণ সম্পাদক রবি শংকর চাকমা।
ঐতিহ্যবাহী সর্ববৃহৎ সামাজিক উৎসব বৈসাবি (বৈসুক-সাংগ্রাই-বিঝু-বিষু-বিহু) প্রাক্কালে গত বুধবার সংবাদ মাধ্যমে প্রেরিত এক যৌথ বার্তায় এই আহ্বান জানান। একইসাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বস্তরের অধিবাসী ও প্রবাসী ভাই-বোনদের প্রতি আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিবাদন জানানোর পাশাপাশি দীঘিনালায় বৈসাবি আনুষ্ঠানিকতা বর্জনের কর্মসূচির প্রতিও ব্যক্ত করেছেন দ্ব্যর্থহীন সমর্থন।
গণমাধ্যমে প্রদত্ত বৈসাবি শুভেচ্ছা বার্তায় ইউপিডিএফ নেতৃদ্বয় মানিকছড়িতে বৈসাবি র‌্যালিতে নিরাপত্তা বাহিনীর হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতিকে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সাথে তুলনা করে ক্ষমতাসীন সরকারের কঠোর সমালোচনা করে তারা বলেন,‘ ফৌজী শাসক আইয়ুব শাহী কর্তৃক বাংলা নববর্ষ উৎযাপনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধকরণের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বৈসাবি উৎসবে বাধা প্রদান করা হচ্ছে।’
বৈসাবি উৎসবকে সর্বজনীন বৃহৎ সামাজিক উৎসব ও ঐক্য-সংহতির উপলক্ষ অভিহিত করে ইউপিডিএফ নেতৃদ্বয় বলেন,‘মাটিরাঙ্গায় বৈসাবি র‌্যালিতে সেনা বাধা তোয়াক্কা না করে অংশগ্রহণকারী লোকজন যেভাবে দৃঢ়তার সাথে প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে, নিরাপত্তাবাহিনী কর্তৃক আটক দুই যুবককে ছিনিয়ে এনেছে তা হচ্ছে স্ব স্ব সংস্কৃতি ঐতিহ্য ও অস্তিত্ব রক্ষার্থে ছাত্র-যুব-জনতার পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বিষ্ফোরণ, এটি এক অর্থে স্থানীয় সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ।’

বার্তায় ইউপিডিএফ নেতৃদ্বয় স্মরণ করিয়ে দিয়ে আরো বলেন, ‘মাটিরাঙ্গার মতই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রান্তে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের ¯্রােতে মিলিত হয়ে একদিন বিরাট প্রবাহ সৃষ্টি করবে। পূর্ব বাংলার জনগণ যেমন পাক শাসকচক্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার্থে লড়েছিলো, একইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিসত্তাসমূহকেও বর্তমানে নিজেদের জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি, স্বকীয়তা রক্ষা ও ঐতিহ্যবাহী উৎসব পালনের জন্য অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন সংগঠিত করতে হচ্ছে।’
ইউপিডিএফ নেতৃদ্বয় আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন,‘কোন জাতি চিরদিন অসংগঠিত বা দুর্বল থাকে না। ঐতিহাসিক নিয়মে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকারহারা জনগণও উঠে দাঁড়াতে বাধ্য। ঐতিহ্যবাহী বৈসাবি উৎসবের মহামিলন ও ঐক্যের শক্তিতে আরো বলীয়ান হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণও সমাজের সমস্ত দালাল প্রতিক্রিয়াশীল বেঈমানদের ষড়যন্ত্র চক্রান্ত নসাৎ করে দেবে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির মোকাবিলা করে পাকিন্তান ভাবধারার সেনা-আমলাদের পরাস্ত করে কায়েম করবে কাক্সিক্ষত অধিকার পূর্ণস্বায়ত্তশাসন।’
‘আনন্দ উৎসবের জন্য প্রথম ও প্রধান শর্ত হচ্ছে পরিবেশ ও নিরাপত্তা’ মন্তব্য করে গণমাধ্যমে প্রদত্ত দীর্ঘ বার্তায় ইউপিডিএফ নেতৃদ্বয় বলেন,‘পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় কর্তৃক ১১দফা নির্দেশনা জারির পর আক্ষরিক অর্থে উৎসবের পরিবেশ নেই।’ রাতে-বিরাতে বাড়িঘরে ঘেরাও, পাড়া-মহল্লার ভিতর টহল, রাস্তায় তল্লাশির নামে সাধারণ যাত্রীদের নামিয়ে হয়রানি, নান্যাচরে এইচএসসি পরীক্ষার্থী রমেল-রামগড়ে দিনমজুর রুই হ্লা অং’কে মারধর, ইউপিডিএফ কর্মী সুগতসহ দীঘিনালায় ৪ ব্যক্তিকে আটক, নিরীহ লোকজনকে হয়রানির তীব্র নিন্দা জানিয়ে নেতৃদ্বয় অবিলম্বে তা বন্ধের দাবি করেন।
‘সবাইকে নিয়ে আনন্দ উৎসবে সামিল হওয়াই বৈসাবির চেতনা। কাউকে বাদ দিয়ে বা বঞ্চিত রেখে উৎসব পরিপূর্ণ হয় না’ মন্তব্য করে ইউপিডিএফ নেতৃদ্বয় দীঘিনালা এলাকাবাসীর কর্মসূচির প্রতি সম্মান জানিয়ে উৎসবে কৃত্রিম জৌলুস প্রদর্শন থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।

Archive Calendar
MonTueWedThuFriSatSun
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31