কাপ্তাই হ্রদের নাব্যতা সংকটে ৫ উপজেলার মানুষ, নৌ-চলাচল ব্যাহত, ড্রেজিং এর দাবী

॥ মিল্টন বাহাদুর ॥ কাপ্তাই হ্রদে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ও নৌ-যোগাযোগ মারাত্মক ভাবে ব্যাহত হচ্ছে। তীব্র তাপদাহে ও অনাবৃষ্টিতে হ্রদের পানি অস্বাভাবিক হারে কমেছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ার পাশাপাশি হ্রদবেষ্টিত ৫ উপজেলায় নৌ-যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এতে শহর থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়েছে ৫ উপজেলার বসবাসরত মানুষেরা। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। যোগাযোগ বন্ধ থাকায় এক উপজেলা হতে অন্য উপজেলায় যাতাযাত ও পরিবহন করতে সীমাহীন দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে উপজেলাবাসীকে। ইঞ্চিন চালিত ছোট ছোট বোট করে তাদের চলাচল করতে হচ্ছে।
পানি শুকিয়ে যাওয়ার কারণে নৌ চলাচল ব্যাহত হওয়ায় পর্যটন এলাকার পানি পথে ভ্রমনের বিভিন্ন তরী, নৌকা, সাম্পান, ইঞ্জিন চালিত বোটগুলো নদীর পাড়ে পড়ে রয়েছে। আর পানি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে রাঙ্গামাটি দূর্গম এলাকাগুলোতে দেখা দিয়েছে তীব্র পানি সংকট। পাহাড়ী পল্লীর লোকজন সচেতনতার অভাবে ময়লা, দূর্গন্ধযুক্ত বিভিন্ন কুয়া অথবা ঝর্ণার পানি পান করে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়াও রাঙ্গামাটি সদর থেকে ৫০ থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরের অন্যান্য উপজেলা বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি, বরকল, জুড়াইছড়ি ও লংগদু যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌপথ। কিন্তু কাপ্তাই হ্রদের পানি অস্বাভাবিক হারে কমে যাওয়ায় এবং উজান থেকে পাহাড়ি ঢলে পলি জমে হ্রদের বুকে অসংখ্য চর জেগে উঠায় আভ্যন্তরীণ নৌ-যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। নৌযানের দেড়-দুই ঘন্টার পথ এখন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিরামহীন হেঁটে পাড়ি দিতে হচ্ছে। পানি না থাকায় বিকল্প ও সরু পথে তিন ঘণ্টার বেশী সময় লাগছে। কাপ্তাই হ্রদের পানি শুকিয়ে যাওয়া কিছুদূর পথ যাত্রীদের পায়ে হেঁটে ছোট বোটে চড়ে যেতে হচ্ছে। এতে করেই বিলাইছড়ি আসা-যাওয়া করতে হয় এসব উপজেলার মানুষদের। ফলে সময়ও লাগছে প্রচুর।
নৌ চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মাঝি-মাল্লা। বিশেষ করে বিলাইছড়ি উপজেলার বিলাইছড়ি, ফারুয়া ও কেংড়াছড়ি, বাঘাইছড়ি উপজেলার বাঘাইছড়ি, বাঙালতলি, মারিশ্চা, সরবাতলি, রূপাকারি ও কেদারমারা, বরকল উপজেলার আইমাছড়া, বড় হরিণা, বরকল, ভূবণছড়া ও শুভলং, জুড়াইছড়ি উপজেলার বনজুগিছড়া, দমদমিয়া, জুড়াছড়ি ও ময়ডং, লংগদু উপজেলার লংগদু, মাইনিমুখ ও কালাপাকুইজায়া, নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাট, ঘিলাছড়ি, নানিয়ারচর ও সাবেকখিয়াং এলাকার সাথে নৌ-যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
ফলে এসব এলাকার মানুষের জীবনে দেখা দিয়েছে চরম বিপর্যয়। স্বাভাবিক কাজকর্ম থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কর্মকান্ডে পর্যন্ত নেমে এসেছে স্থবিরতা। শহরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় এসব এলাকার কৃষকদের উৎপাদিত কোটি কোটি টাকার কাঁচামাল বাজারজাত করতে না পেরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে জুম চাষীরা।
বিশেষ করে এই জেলায় উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ আদা, হলুদ, আনারস, আম, কাঁঠাল, কলা, তরমুজ, লিচুসহ বিভিন্ন মৌসুমী ফল ও শাক-সবজি বাজারজাত করতে না পারায় সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অপর দিকে উল্লেখিত ৫ উপজেলায় নৌযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় দৈনন্দিন জীবনের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য দ্রব্যেরও সঙ্কট দেখা দিয়েছে। পরিবহন ব্যবস্থার নানা জটিলতার কারণে এই উপজেলাগুলোতে বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী আনা-নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এখানকার প্রতিটি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে ৫ উপজেলায় খাদ্য সঙ্কট ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আশংকা করা হচ্ছে।
বাঘাইছড়ি প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও প্রবীণ সাংবাদিক দীলিপ কুমার দাশ বলেন, বাঘাইছড়ি উপজেলার সঙ্গে জেলা সদরের যাতায়াত ব্যবস্থা দীর্ঘ বছরের। চরম দুর্ভোগ হতে যাত্রীরা রক্ষা পেতে মারিশ্যা হতে লংগদু ভায়া নানিয়ারচর পর্যন্ত নির্মাণাধীন সড়ক দ্রুত সম্পন্ন করার দাবি জানিয়েছেন বাঘাইছড়িবাসী। প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে প্রায় ছয় মাস কাপ্তাই হ্রদের পানি শুকিয়ে যায়। তাই লঞ্চ চলাচলে বাধাগ্রস্ত হয়ে যাত্রীদের জেলা শহর খাগড়াছড়ি হয়ে রাঙ্গামাটি সদরে যেতে হয়। দুর্ভোগের শেষ নেই বাঘাইছড়িবাসীর।
রাঙ্গামাটি লঞ্চ মালিক সমিতি সভাপতি মো. মঈন উদ্দিন সেলিম বলেন, প্রায় পাঁচ উপজেলার সঙ্গে জেলা সদরের লঞ্চ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাই লঞ্চ নিয়ে বড়ই বিপদে আছি। প্রতি বছর এই মৌসুমে হ্রদে পানি কমে গিয়ে ডুবন্ত চর জেগে উঠলে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এসব বিষয়ে নদী রক্ষা জাতীয় কমিটি ও নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে অনেক বার চিঠি লিখেছি। রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসনকে অনেক বার প্রস্তাব পাঠিয়েছে। তার পরেও কাপ্তাই হ্রদে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করা হচ্ছে না। এতে করে প্রতি বছর এই সময়ে ৫ উপজেলার মানুষ মারাত্মক দূর্ভোগের স্বীকার হয়।
এদিকে এর প্রভাব পড়েছে সংশ্লিষ্ট উপজেলার অফিস পাড়াতেও। নৌপথে চলাচলকারী উপজেলার অনেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সময়মত অফিসে যাতায়াত করতে মারাত্মক দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তীব্র তাপদাহে কখনো তারা ইঞ্চিন বোটে, কখনো পায়ে হেটে যাতায়াত করতে হচ্ছে। এতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতিও কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। সকালে উপজেলাগুলোতে গেলে কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা আবার ফিরতে পারছে না। এতে করে তাদের থাকা, খাওয়াসহ আর্থিক ভাবে ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছেন।
উল্লেখ্য, ১৯৬০ সালে কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। ফলে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার প্রায় সাতশ’ বর্গকিলোমিটার এলাকায় কৃত্রিম হ্রদের সৃষ্টি হয়। ডুবে যায় প্রায় ৫৪ হাজার একর আবাদি জমি। উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে প্রায় এক লাখ মানুষ। তবে হ্রদ সৃষ্টি হওয়ায় পার্বত্য এলাকার দুর্গম অঞ্চলে নৌ যোগাযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু হ্রদ সৃষ্টির পর হতে একবারও কাপ্তাই হ্রদে ড্রেজিং করা হয়নি। ফলে প্রতিদিন শত শত টন বর্জ্য ও ময়লা আবর্জনা হ্রদে এসে পড়ার পাশাপাশি উজানের পলি এসে ভরাট করে দিচ্ছে এই হ্রদকে।
এতে হ্রদে পানি ধারণক্ষমতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে পাহাড়ি মানুষের জীবন-জীবিকার রকমফের। দেখা দিচ্ছে পরিবেশ বিপর্যয়, নষ্ট হচ্ছে জীব বৈচিত্র্য, কৃষি উৎপাদনেও পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। যা পাহাড়ের বসবাসরত মানুষদের শংকিত করে তুলছে দিনের পর দিন।

Archive Calendar
MonTueWedThuFriSatSun
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30