
ছবির কপিরাইট Dr Samia Khatun Image caption অস্ট্রেলিয়ায় খুঁজে পাওয়া ১৮শতকী বাংলা পুঁথি
অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে দুর্গম অঞ্চলের প্রায় পাঁচশো কিলোমিটার গভীর মরুভূমিতে বেশ কয়েক বছর আগে হঠাৎ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল একটি প্রাচীন গ্রন্থ, যাকে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন মনে করে সংরক্ষণ করা হচ্ছিল।
কিন্তু একজন অস্ট্রেলিয়ান-বাংলাদেশি গবেষক সেখানে গিয়ে দেখতে পেলেন এটি আসলে বাংলা ভাষায় লেখা শত বছরেরও আগের একটি পুঁথি।
গবেষক ড: সামিয়া খাতুন এই গবেষণার সূত্র ধরে বিশ শতকের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ায় তৎকালীন বাংলা এবং ভারতবর্ষ থেকে মানুষের অভিবাসনের চমকপ্রদ এক ইতিহাসের সন্ধান পেয়েছেন, যা নিয়ে তার একটি বই শীঘ্রই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে লন্ডন থেকে।
ড: সামিয়া খাতুন বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ইতিহাসের বই-এ যখন তিনি ওই কোরআনের কথা পড়েন তখন তিনি তা দেখতে পাড়ি জমিয়েছিলেন সেখানে।
“পাঁচশ কিলোমিটার পথ গিয়ে বইটি খুঁজে বের করার পর খুলে দেখি সেটি কোরআন নয়, বাংলা কবিতা,” বলেছেন ড: সামিয়া খাতুন।
ড: খাতুন তার গবেষণায় দেখেছেন বহু জাহাজী সেসময় ওই এলাকায় গিয়েছিলেন। উটের ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত ছিল বহু বাঙালি। অনেক বাঙালি সেসময় আয়ার কাজ করতে সেখানে গিয়েছিলেন বলে তিনি তার গবেষণায় জেনেছেন।
তিনি বলছেন এরা সেসময় অস্ট্রেলিয়ার গভীরে দুর্গম মরু অঞ্চলে কাজ করতে গিয়েছিলেন।
“প্রথমে লেখাটি ছাপা হয়েছিল ১৮৬১ সালে, পরে এটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে কয়েকবার পুর্নমুদ্রিত হয়ে যে কপিটি আমার হাতে আসে সেটি ১৮৯৫ সালে ছাপা।”
ছবির কপিরাইট Dr Samia Khatun Image caption ড: সামিয়া খাতুন
ড: খাতুন এসব মানুষের কাজ ও বসতির সূত্র ধরে অস্ট্রেলিয়ার ব্রোকেনহিল শহরে তাদের প্রথম অভিবাসী হয়ে আসার আগ্রহব্যঞ্জক তথ্য পেয়েছেন।
“এদের অনেকে উট নিয়ে কাজ করতে করতে সেখানে চলে গিয়েছিলেন। তবে সবচেয়ে বেশি লোক জাহাজে কাজ নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছেছিলেন, এরপর যে কোন একটা কাজ জুটিয়ে নিয়ে মরুভূমি এলাকায় বা অস্ট্রেলিয়ার গহীন অঞ্চলে পৌঁছে যান।”
ড: খাতুন বলছেন সেখানে যে মসজিদগুলো ছিল এই লোকেরা সেই মসজিদগুলোতে ঈদের সময় জড়ো হতেন। এভাবেই ব্রোকেনহিলসহ আশপাশের দুর্গম এলাকাগুলোয় তখন বাঙালিদের একটা বসতি গড়ে ওঠে ।
আঠারো এবং উনিশ শতকে বিশ্ব জুড়ে একটা ব্যাপক অভিবাসনের ইতিহাস রয়েছে। পৃথিবীর নানা প্রান্তের লোক সেসময় নানা জায়গায় গিয়ে বসতি গড়ে তুলেছেন।
ড: খাতুন বলছেন ওই একই সময়ে অস্ট্রেলিয়াতেও একই ঘটনা ঘটেছিল।
তিনি বলছেন এই বাঙালি অভিবাসীরা তখন অস্ট্রেলিয়ার গহীন এলাকায় পুঁথিপাঠ করতেন।
“এই বইয়ে যে বাংলা কবিতাগুলো রয়েছে সেগুলো গান করে অন্যদের পড়ে শোনানো হত- যেমনটা প্রাচীনকালে পুঁথিপাঠের ধারা ছিল।”
তিনি বলছেন এর থেকে বোঝা যায় ওই সময়ে অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমিতে বাঙালিদের মধ্যে পুঁথিপাঠের একটা সংস্কৃতি চালু ছিল।
আরও পড়তে পারেন:
বিশ্বে দূষণজনিত মৃত্যু সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে
প্রধান বিচারপতির আর কাজে ফেরার সুযোগ নেই: আবদুল মতিন খসরু
বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে?
ছবির কপিরাইট Dr Samia Khatun Image caption অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে দুর্গম অঞ্চলের প্রায় পাঁচশো কিলোমিটার গভীর মরুভূমিতে এখনও টিঁকে আছে প্রাচীন কিছু মসজিদ
তার গবেষণায় ড: খাতুন দেখেছেন সেখানে ওই সময় একটা বড়সড় বাঙালি জনগোষ্ঠি ছিল বলেই এই পুঁথিপাঠের চর্চা গড়ে উঠেছিল। এছাড়া অন্য দেশ থেকে সেখানে যাওয়া অনেক মানুষ সেই পুঁথিপাঠ শুনতে আসতেন যারা বাঙালি ছিলেন না। তাদের জন্য অনুবাদ করে এইসব কবিতা শোনানো হতো।
ড: খাতুন বলছেন সেইসময় যেসব বাঙালি ওই দুর্গম অঞ্চলে বসতি করেছিলেন তাদের বংশধররা এখনও আছেন।
তিনি বলছেন সেসময় স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গে এরকম অনেক বাঙালির বিয়ে হয়েছিল। তারা অবশ্যই তখন ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে যাওয়া বাঙালি ছিলেন।
“ফলে তাদের বংশধরদের এখন পাওয়া যায় আদিবাসী অ্যাবোরোজিন সম্প্রদায়ের মধ্যে যেহেতু ওই বাঙালিদের মধ্যে অনেক মিশ্র বিয়ের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়।”
ড: সামিয়া খাতুন বলছেন সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল এই মিশ্র বিয়ের কারণে ওই প্রত্যন্ত অঞ্চলের অ্যাবোরোজিন সম্প্রদায়ের ভাষায় ঢুকে গেছে বহু বাংলা শব্দ।
“যেমন চাপাটি শব্দকে ওরা বলে জাপাটি, ট্যাংক হয়ে গেছে টাংকি- এরকম বহু শব্দ রয়েছে। তারপর উট নিয়ে যেহেতু তারা কাজ করতেন, তাই উটকে তারা উট বলে।”
তিনি বলছেন সেসময় যে মসজিদগুলো সেখানে ছিল, সেগুলোর কয়েকটা ধ্বংস হয়ে গেলেও কয়েকটা এখনও টিঁকে আছে এবং ওই মরু এলাকা খুবই শুষ্ক হওয়ার কারণে যেগুলো টিঁকে আছে সেগুলোর ভেতরে “সবকিছু এখনও খুব ভালভাবেই টিঁকে আছে।”