॥ একেএম মকছুদ আহমেদ/উচিংছা রাখাইন/লিটন শীল ॥
-------------------------------
স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও মুক্তিযোদ্ধার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সম্মান না পাওয়ার যন্ত্রণা নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন রাঙ্গামাটি শহরের আসামবস্তীর শান্তিনগর এলাকায় বসবাসকারী বুদ্ধিরাম আসাম। দীর্ঘদিন ধরে অনেক চেষ্টা তদবির করেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় তার নাম লিপিবদ্ধ হয়নি। তালিকায় অন্তভুক্তি না হওয়ায় তিনি বঞ্চিত রয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে। অর্থ ও খাদ্যকষ্টে পরিবার পরিজন নিয়ে নিজ বসতবাসীতে মানবেতর দিনাতিপাত করছেন এখন বুদ্ধিরাম। প্রায় ৮০বছর বয়সেও সহযোগিতা পাইনি কোনো মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে। অথচ ১৯৭১’র নিজের জীবন বাজি রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বাধীনতা অর্জনে ভুমিকা রাখায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত থেকে পেয়েছিলেন বীরত্বের প্রতীক হিসেবে সম্মানীয় মেডেল। সেই বীরত্বের মেডেল হাতে নিয়ে অশ্রুসিক্ত জলে স্মৃতিচারণ করে বেড়ান মুক্তিযুদ্ধের আর ঝাঁপসা চোখে এখন শুধু মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান।
আবেগ আপ্লুত কন্ঠে বুদ্ধিরাম আসাম বলেন, শুনেছি বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সন্তান, নাতি-নাতনী ও মুক্তিযোদ্ধা সহযোগীদের জন্য অনেক সহযোগিতা করছেন। তাহলে আমি কেন বঞ্চিত?' কথাগুলো বলতে বলতে চোখ দিয়ে পানি চলে আসে বুদ্ধিরামের।
পুলিশ বিভাগে ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রাম দামপাড়া পুলিশ ক্যাম্পে ব্যাচ নং ১৪৫৭ নম্বরে কনেষ্টেবল হিসেবে যোগদান করেন বুদ্ধিরাম আসাম। চাকুরীরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীদের সাথে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীরা তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে চালায় নির্মম শারীরিক নির্যাতন। দিনের পর দিন পাকবাহিনীর নির্মম পাশবিক নির্যাতনের এক পর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেললে পাকবাহিনীরা তাকে মৃত মনে করে ফেলে দেয় ক্যাম্পের পেছনের একটি গর্তে। সেখান থেকে হামাগুড়ি দিয়ে তিনি পালিয়ে আসেন। পরে চিকিৎসা শেষে সুষ্ঠ হয়ে আবার ফিরে যান পুলিশ ক্যাম্পে। পাকবাহিনীদের বন্দুকের বাট দিয়ে মাথায়, হাটু, হাত ও শরীরের বিভিন্ন অংশের আঘাতের ক্ষত চিহ্নগুলো এখনো মনে করিয়ে দেয় সেই বর্বরতার দিনগুলো। চোখের জল মুছতে মুছতে কথাগুলো বলতে থাকেন বুদ্ধিরাম আসাম।
একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ ও স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য করেছেন অনেকবার চেষ্টা। কিন্তু তাঁর সব চেষ্টাই হয়েছে বিফল। তিনি মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করার পর সত্যতা যাচাই করতে তার নিজ গ্রাম রাঙ্গামাটির আসামবস্তীতে আসেন মন্ত্রণালয়ের একদল তদন্ত কমিটি। কিন্তু কিছু দুষ্ট লোক রহস্যজনক কারণে দেখিয়ে দেননি তার বসতবাড়ী। এরপর থেকে আর কোন প্রতিষ্ঠান থেকে তার খোঁজ খবর নেইনি।
পরে ১৯৯৮ সালে চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন তিনি। এরপর থেকে পেনশনের মাত্র ৭ হাজার টাকা দিয়েই চলে তার সংসার। বর্তমানে রাঙ্গামাটি শহরের আসামবস্তি শান্তিনগর এলাকায় নিজের চিকিৎসা ও সাংসারিক খরচ এই সামান্য টাকায় টানাটানি করে চলে তার সংসার।
বর্তমানে পঙ্গু অবস্থায় বেঁচে থাকা একথাগুলো ছিল একজন বুদ্ধিরাম আসামের যিনি গণমানুষের সেবা করার মানসেই এই কষ্টকর পুলিশের চাকুরিতে যোগদান করেছিলেন। সেই সাথে তাঁর ধারনা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্য প্রদত্ত সম্মান ও সাহায্য তিনি আবশ্যই পাবেন। কিন্তু বাস্তবতো সেটি নয়।
যে কারনে প্রায় ৮০বছর বয়সে এসে গভীর হতাশা ও ভাঙ্গামন নিয়ে এখন দিনাতিপাত করছেন বুদ্ধিরাম। প্রশ্ন হচ্ছে- বড় কিছু না হলেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে তাঁকে সম্মান এবং সহযোগিতা করা হতো তাহলে বুদ্ধিরামও এই অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যায় অত্যন্ত সুন্দরভাবে তার পরিবার পরিজনকে নিয়ে এই স্বাধীন দেশে সুন্দর করে বসবাস করতে পারতেন। একইভাবে তিনিও হয়তো অন্যজনদের সহয়তা করতে পারতেন।
বুদ্ধিরামের কথা বলতে গিয়ে তাকে হতদরিদ্র মানুষ বলে আক্ষায়িত করার উদ্যেশ্যে এই প্রতিবেদকের নেই। সংবাদকর্মী হিসেবে আমরা মনে করি সার্বিক চেতনাবোধ জাগ্রত করার লক্ষ্যেই এ লেখাগুলো। এজন্য প্রয়োজন উদার মনমানসিকতা। মহান মুত্তিযুদ্ধের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও দায়িত্ববোধের পরিচয়ে পরিচিত হয়ে বুদ্ধিরামের সতীর্থ ও শুভানুধ্যায়িরা এগিয়ে আসলেই তাঁর মনের আকুতি একদিকে যেমন কিছুটা কমে আসবে এবং বর্তমানে ৩ ছেলে, ১ মেয়ে ও নাতি নাতনিসহ ১২জনের পরিবারটি অন্ততঃ দুইবেলা মুখে ভাত তুলতে পারবে। আশাকরি বিবেকবান কোন ব্যাক্তি বা ব্যাক্তিরা অথবা কোন প্রতিষ্ঠান বুদ্ধিরামের দুঃখের অবসান ঘটাতে এগিয়ে আসবে।
অতএব, বিবেকবান কোন ব্যাক্তি বা ব্যাক্তিরা, এখানকার মুক্তিযোদ্ধা, পুলিশ বিভাগ যদি তাঁর প্রতি সদয় হয়ে তার বিষয়ে দ্রুত করনীয় নির্ধারণ কিছু করা গেলে প্রায় ৮০বছর হওয়া বুদ্ধিরামের অসহায় পরিবারটি বেঁচে থাকার মতো একটি উপায় অবলম্বন করতে পারবেন।