আলসার শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ আলকাস থেকে। ওরাল আলসারে মুখের অভ্যন্তরে মিউকাস মেমব্রেন ভাঙন বা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। আবার মুখের সন্নিবেশিত অ্যাপিথেলিয়াম বা বহিরাবরণ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। লিখেছেনডা: মো: ফারুক হোসেন
সবচেয়ে বেশি দেখা যাওয়া ওরাল আলসারের মধ্যে একটি হলো অ্যাপথাস আলসার, আর অন্যটি কোল্ড সোর যা হারপিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস দিয়ে হয়ে থাকে।
ওরাল আলসার দেখতে কেমন
ওরাল আলসার সাধারণত দেখা যায় সাদা বা হলুদাভ ডিম্বাকৃতির মতো, যার চারপাশে প্রদাহজনিত লাল রঙের বর্ডার দেখা যায়। ক্ষত স্থানের চারপাশে সাদা বৃত্তাকার লাইন দেখা যেতে পারে। ধূসর সাদা অথবা হলুদাভ রঙের আলসারযুক্ত স্থান লাল রঙের বর্ডার বা বাউন্ডারির মধ্যে দেখা যায়। এটি হয় ফিব্রিনের স্তর গঠন হওয়ার কারণে। ফিব্রিন একটি প্রোটিন, যা রক্ত জমাট বাঁধার সাথে সম্পৃক্ত। আলসার যখন তীব্র ব্যথাযুক্ত হয় তখন চোয়ালের নিচে ব্যথাযুক্ত লিস্ফনোড বা লসিকাগ্রন্থির ফোলা ভাব পরিলক্ষিত হতে পারে, যা অনেক সময় ভুলবশত দাঁতের ব্যথা বলে মনে হয়।
ওরাল আলসারের কারণ
রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ত্রুটিজনিত কারণ, মানসিক চাপ, হরমোনের পরিবর্তন, মাসিকের সমস্যা, খাদ্যজনিত এলার্জি, ভিটামিন বি ১২, আয়রন বা ফলিক এসিডের অভাব, কিছু ওষুধ যেমন নিকোরানডিল ধূমপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্যাদি গ্রহণ, ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস সংক্রমণ, ফাঙ্গাল সংক্রমণ।
যেসব রোগে মুখে আলসার হতে পারে
সিলিয়াক ডিজিজ (ক্ষুদ্রান্ত্রের রোগ), জিনজাইভোস্টোমাটাইটিস, লিউকোপ্লাকিয়া, ওরাল লাইকেন পস্ন্যানাস, লুপাস ইরাইথিম্যাটোসাস, ওরাল থ্রাস, আলসারেটিভ কোলাইটিস, বুলাস পেনফিগয়ড, সিফিলিস, গনোরিয়া, যক্ষ্মা, মারাত্মক রক্তশূন্যতা।
ট্রমা বা আঘাতজনিত ওরাল আলসার
মুখে আঘাত মুখের আলসারের সচরাচর পরিলক্ষিত কারণ। দাঁতের কোনো অংশ যদি ধারালো থাকে তাহলে সেখান থেকে আলসার হতে পারে। অসাবধানতাবশত কামড় সাধারণত ধারালো ক্যানাইন বা ছেদন দাঁত দিয়ে হয়ে থাকে। মুখে যদি ধারালো দাঁত থাকে তাহলে হাঁচি দেয়ার সময় ও ধারালো দাঁত দিয়ে জিহ্বা বা মুখের অন্য যেকোনো অংশ কেটে যেতে পারে। তাই ধারালো দাঁত যত দ্রুত সম্ভব ট্রিমিং করে নিতে হবে।
এব্রেসিভ বা ক্ষয়কারক খাবার যদি মুখের ভেতর সারা রাত রেখে দেয়া হয়, তাহলে মুখে আলসার হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যারা পান খান তাদের অনেকেই পান, সুপারি এবং জর্দার মিশ্রণ গালের এক পাশে রেখে সারা রাত সুখনিদ্রা যাপন করেন। যা মুখের আলসার থেকে শুরু করে ক্যান্সার পর্যন্ত সৃষ্টি হতে পারে। অর্থোডনটিক চিকিৎসাকালীন মুখের ভেতরে ডেন্টাল ব্রেসের কোনো ত্রুটির কারণে খোঁচা লেগে মুখে আলসার হতে পারে। টুথব্রাশের আঘাতের কারণে মিউকাস মেমব্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হলে মুখে আলসার হতে পারে। এ ধরনের আলসার সাধারণত উৎসজনিত কারণ অপসারিত হলে ভালো হয়ে যায়।
রাসায়নিক ক্রিয়াজনিত ওরাল আলসার
রাসায়নিক দ্রব্যাদি যেমন এসপিরিন বা এলকোহল যদি মুখের সংস্পর্শে বারবার আসে তাহলে মুখে আলসারের মতো আবরণ তৈরি হতে পারে। বেশির ভাগ টুথপেস্টের উপাদানগুলোর অন্যতম এসএলএস বা সোডিয়াম লরিল সালফেট, যা অনেক ক্ষেত্রে মুখের আলসারের অন্যতম কারণ। সোডিয়াম লরিল সালফেট কখনো কখনো মুখের আলসারের তীব্রতা বাড়িয়ে দেয় আবার আলসারকে দীর্ঘস্থায়ী করে। অতএব টুথপেস্ট ব্যবহারে সচেতন হতে হবে এবং আপনার মুখের জন্য উপযোগী টুথপেস্ট সম্পর্কে জানার জন্য একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
সংক্রমণজনিত ওরাল আলসার
ভাইরাস, ফাঙ্গাস অথবা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের কারণে মুখে আলসার হতে পারে। ভাইরাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় হারপিস সিমপেস্নঙ্ ভাইরাস। এ ভাইরাসটির কারণে মুখে বারবার আলসার দেখা দিতে পারে। রোগী দুর্বল অনুভব করতে পারে। সংক্রমণের সময় রোগীর গায়ে জ্বর জ্বর ভাব অনুভূত হতে পারে। তবে জ্বরের মাত্রা থাকে খুবই কম। এইচআইভি ভাইরাস প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে মুখে আলসার সৃষ্টি করতে পারে।
ব্যাকটেরিয়া
যক্ষ্মা রোগের ক্ষেত্রে মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস এবং সিফিলিস রোগের ক্ষেত্রে ট্রিপেনিমা প্যালিডাম ব্যাকটেরিয়া দিয়ে মুখে আলসার হতে পারে। গনোরিয়া রোগের ক্ষেত্রে নাইসেরিয়া গনোরি ব্যাকটেরিয়াও একই ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া ট্রেপটোকক্কাই, একটিনোমাইসিস দিয়ে আলসার দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
ফাঙ্গাসজনিত মুখের আলসার
ভ্যালি ফিবারের জন্য কক্কিডাইওডিস ইসিটিস, ক্রিপটোকক্কোসিস রোগে ক্রিপটোকক্কাস নিওফরম্যানস, নর্থ আমেরিকান বস্নাসটোমাইকোসিস রোগে বস্নাসটোমাইকোসিস ডার্মাটাইটিডিস জীবাণু দিয়ে সংক্রমণ বিস্তার লাভ করে। সব ফাঙ্গাসজনিত রোগে মুখে আলসার হতে পারে। এছাড়া ক্যানডিডা অ্যালবিকানস মুখের আলসার সৃষ্টি করতে পারে।
রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ত্রুটিজনিত আলসার
রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে আলসার হতে পারে। বারবার মুখে আলসার হলো মুখের মিউকাস মেমব্রেনে ইমমিউনোগ্লোবিউলিনের পরিমাণ কমে যাওয়ার সতর্ক সঙ্কেত। কেমোথেরাপি এবং এইচআইভি সংক্রমণ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে অনেক কমিয়ে দিতে পারে। ফলে মুখে আলসার দেখা দিতে পারে।
অটোইমিউনিটি
অটোইমিউনিটিও ওরাল আলসারের একটি কারণ। মিউকাস মেমব্রেন পেমফিগয়ড, যা একটি অটোইমিউন রিঅ্যাকশন যা অ্যাপিথেলিয়াম বেসমেন্ট মেমব্রেনে সংঘটিত হয় এবং ওরাল আলসার সৃষ্টি করে।
অ্যালার্জিজনিত মুখের আলসার
বিভিন্ন অ্যালার্জেন দিয়ে মুখে দীর্ঘস্থায়ী আলসার হতে পারে।
খাদ্যজনিত ও পুষ্টিজনিত কারণে মুখের আলসার
ভিটামিন সি’র অভাবে স্কার্ভি রোগ হতে পারে এবং ভিটামিন সি’র অভাবে মুখে আলসার দেখা দিতে পারে। একইভাবে ভিটামিন বি-১২, আয়রন, জিংক এবং ফলিক এসিডের ঘাটতির কারণে মুখে আলসার দেখা দিতে পারে। ওরাল আলসারের কারণগুলোর অন্যতম সিলিয়াক ডিজিজ; যার কারণে গম, রাই অথবা বার্লি খেলে মুখে আলসার হতে পারে ধীরে ধীরে। যদি গস্নুটেন ইনটলারেন্সের কারণ হয় তাহলে খাদ্য তালিকায় পরিবর্তন আনতে হবে। সে ক্ষেত্রে বেশির ভাগ ব্রেড বা রুটি জাতীয় খাবার, কেক, পাই, কুকিজ, বিস্কুট, বিয়ার ইত্যাদি খাবার কমিয়ে দিতে হবে। আবার ক্ষেত্রবিশেষে সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে গস্নুটেন মুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। ডায়েট কোলাতে কৃত্রিম চিনি, সুগারলেস গামও কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুখের আলসারের কারণ হয়ে দাঁড়ালে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
ক্যান্সারজনিত ওরাল আলসার
ওরাল ক্যান্সারের কারণে মুখে আলসার হতে পারে যেহেতু সংক্রমণের কেন্দ্রস্থল রক্ত সঞ্চালন পায় না। স্কোয়ামাস সেল কারসিনোমা বা ক্যান্সারের একটি উদাহারণ।
ওরাল আলসারের চিকিৎসা
ওরাল আলসারের ক্ষেত্রে রোগীর খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে। রোগের কারণ অনুসন্ধান করে চিকিৎসা প্রদান করতে হবে। দায়সারা গোছের চিকিৎসা হলে আলসারের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। ওরাল আলসারের রোগীদের টুথপেস্ট ব্যবহারে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে এবং একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী টুথপেস্ট ব্যবহার করতে হবে। রোগীর সার্বিক শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে চিকিৎসা প্রদান করা খুবই জরুরি। বিশেষ করে ওরাল আলসারের কিছু ওষুধের মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। কিছু খাবার ওষুধের কারণে রোগী বেশ দুর্বলতা অনুভব করতে পারে আবার চোখে ঝাপসা দেখতে পারে। তাই ওরাল আলসারের চিকিৎসা অভিজ্ঞতার আলোকেই করতে হয়।