হাসান মনসুর :: ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে যে ক’জন সাহসী সন্তান প্রাণ দিয়েছেন, তাদের মধ্যে একাত্তরের গেরিলা কমান্ডার মাওলানা সৈয়দ আহমদ অন্যতম। বস্তুত বঙ্গবন্ধুপ্রেমী এই অসীম সাহসী বীরই হলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদকারী এবং প্রথম শহীদ।বিপ্লবী সূর্য সেনের সুযোগ্য উত্তরাধিকার- চট্টগ্রামের অহংকার শহীদ মৌলভী সৈয়দ। ১৯৪৪ সালের ১১ মার্চ বাঁশখালী শেখেরখীল লালজীবন গ্রামে তাঁর জন্ম।-
পিতা একরাম আলী সিকদার, মাতা ওমেদা খাতুন। চট্টগ্রামের সমুদ্রবর্তী উপকূলীয় অঞ্চল বাঁশখালী উপজেলা। এই এলাকার মানুষের কাছে সাহস আর গর্বের নাম শহীদ মৌলভী সৈয়দ। নিজেদের এলাকার বর্ণনা আর সাহসের পরিচয় দিতে গিয়ে বাঁশখালীবাসী বলে, আমরা মাওলানা সৈয়দ আহমদের এলাকার লোক ।
১৯৬০ সালে পুঁইছড়ি ইসলামিয়া ফাযিল-ডিগ্রি মাদ্রাসা হতে উলা(ফাজিল) পাস করে পরবর্তী ইজ্জতিয়া জুনিয়র হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। তার দুই বছর পর চট্টগ্রাম শহরের ঐতিহ্যবাহী সরকারি মুসলিম হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পাস করেন। মাদ্রাসার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও তিনি ছিলেন সংস্কৃতিমনা একজন মানুষ।
এরপর সিটি কলেজে ভর্তি হন। সেই সময় ছাত্রলীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল কলেজটি। সিটি কলেজ থেকেই শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন।
১৯৬৮ ও ৬৯ এর গণআন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও যোগ্যতার বলে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বাঁশখালী সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন প্রদান করেন।
পোস্টার, লিফলেট, ফেস্টুন ও ব্যানার ছাপানোর কাজ শেষ করে তিনি যখন ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন, ঠিক ওই সময়ে ঢাকা থেকে খবর এলো তার মনোনয়ন প্রত্যাহার করে বাঁশখালীতে শাহ-ই-জাহান চৌধুরীকে মনোনয়ন প্রদান করা হয়েছে। এই কথা শুনে তিনি এতটুকু বিচলিত হননি বা তার মাঝে কোনো ধরনের ক্ষোভ দেখা যায়নি। এখন যেমন দেখা যায়, সারাবছর দলের পক্ষে কাজ করে অনেক নেতাকর্মী নির্বাচনের সময় নিজের পছন্দের মানুষ মনোনয়ন না পেলে প্রকাশ্যে দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করে। ওই প্রার্থীকে হারিয়ে নিজের কৃতিত্ব নেন। অনেক বড় বড় নেতাও মাঝে মাঝে দলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। বঙ্গবন্ধু প্রেমিক মৌলভী সৈয়দ সেদিন দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে দলীয় প্রার্থীকে বিপুল ভোটে জয়ী করে এমপি বানিয়েছিলেন।
মৌলভী সৈয়দ প্রচুর লেখাপড়া করতেন। তিনি ভালো গান গাইতেন, তার একটি ব্যক্তিগত লাইব্রেরিও ছিল। আগ্রাবাদ মিস্ত্রিপাড়ায় বর্তমান কেন্দ্রীয় আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ মাহমুদুল হকের পৈতৃক বাড়িতে তার চট্টগ্রাম শহরকেন্দ্রিক ঘাঁটিটি ছিল। এই বাড়ি থেকেই তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। পরে এখান থেকেই প্রাথমিক অবস্থায় পরিচালিত হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদী আন্দোলন। শহীদ মৌলভী সৈয়দ মেনে নিতে পারেননি বঙ্গবন্ধুকে কেউ হত্যা করতে পারে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বেঈমান খন্দকার মুশতাকের প্রাণনাশের পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন। যদিও তা বাস্তবায়ন হয়নি। গড়ে তুলেছিলেন সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ, তাও নিয়মিত একটি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে। দুর্ভাগ্য চাকচিক্যময় ডিজিটাল রাজনীতির যুগে এই নামটি বিস্মৃতির অতলে চলে যেতে বসেছে। তার আত্মত্যাগের, নায়কোচিত বীরত্বগাথা যেন এক গোপন অধ্যায়। মৃত মানুষকে বড় করে দেখাতেও এ যেন এক দীনতা-হীনমন্যতা ।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি সম্মুখ সমরের জন্য গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব গেরিলা বাহিনী। চট্টলার আঞ্চলিক ভাষায় মানুষের কাছে এই বীর-মুলই সৈয়দ নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত। চট্টগ্রামের রাজনীতির ইতিহাসে তিনি এক জীবন্ত কিংবদন্তী। বেঈমানির রাজনীতির বিরুদ্ধে আদর্শের, ইমানদারির মূর্ত প্রতীক এই বিপ্লবী মৌলভী সৈয়দ ।
চট্টগ্রামসহ এই জনপদের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের হিরো। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারী হিসেবে ঘুরেফিরে যাদের নাম উঠে আসে তাদের মধ্যে তিনি সহ এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, মরহুম সুলতানুল কবির চৌধুরী এমপি, মুক্তিযোদ্ধা এম. ইউনুস, মরহুম কাজি ইনামুল হক দানু সহ অনেকের নাম উঠে আসে। তবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল-মুজিবপ্রেমে অন্ধ মৌলভী সৈয়দ ছিলেন অতিমাত্রায় সাহসী। তিনি সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন দেশের সীমানার ভিতরেই। ভারত বর্ডার ক্রস করে দেশের ভিতরে ঢুকে অপারেশনে অংশ নিতেন তিনি ।
যখন কালো মুজিব কোট বদলে আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা খুনি মুশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগদানের জন্য উদগ্রীব ছিলেন, অনেক আওয়ামী লীগ মন্ত্রী, এমপির বাসার ড্রয়িং রুম থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামিয়ে ফেলা হয়, তখন চট্টগ্রামের মৌলভী সৈয়দ অস্ত্র আর গ্রেনেড নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশের বিভিন্ন স্থানের সামরিক চৌকিতে।
১৯৭০ সালে মুক্তিযুদ্ধের ডামাডোলের সময় লালদীঘির মাঠে জয়বাংলা বাহিনীর মার্চপাস্ট অনুষ্ঠিত হলো। সিদ্ধান্ত হলো পাকিস্তানি পতাকা পোড়ানো হবে। মৌলভী সৈয়দ বীরদর্পে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন আর পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে ফেলেন।
তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে চট্টগ্রাম গেরিলা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন। ছিলেন অনলবর্ষী বক্তা। তার বক্তৃতা শুনে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হত সাধারণ মানুষ। তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গড়ে তুলেছিলেন দুর্ধর্ষ এক গোপন গেরিলা স্কোয়াড। তার দল মৌলভী সৈয়দ বাহিনী নামে পরিচিত ছিল। এই মহান বীরের নেতৃত্বে অন্তত অর্ধশত বড় বড় সফল অপারেশন সংঘটিত হয়েছে।
চট্টগ্রামের প্রয়াত জননেতা জহুর আহম্মেদ চৌধুরীর কাছে রাজনৈতিক দীক্ষায় অনুপ্রাণিত মৌলভী সৈয়দ ছাত্রাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য লাভ করেন। তার সামনে চট্টগ্রামের কেউ পড়লে তিনি ডাক ছাড়তেন, কোথায় আমার মৌলভী সৈয়দ, মহিউদ্দিন। বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন ও আস্থাভাজন কয়েকজনের মধ্যে মৌলভী সৈয়দ অন্যতম। তিনি মৌলভী সৈয়দকে পুত্রসম স্নেহ করতেন। বঙ্গবন্ধু তাকে আমার মৌলভী সাব বলে ডাকতেন। চট্টগ্রাম এলে তিনি প্রিয় সৈয়দকে সাথে রাখতেন সবসময়। মাঝেমধ্যে ঢাকাতে খবর দিয়ে আনাতেন। তার বীরত্ব ও সাহসের ভূয়সী প্রশংসা করে উপস্থিত সকলকে শোনাতেন বঙ্গবন্ধু।
’৭৫ পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারের নিহত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের অনেক বাঘা বাঘা নেতা ভয়ে চুপসে গিয়েছিলেন বা খোলস পাল্টাতে তৎপর ছিলেন। আর সে সময়ই মৌলভী সৈয়দ সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন সামরিক জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে। ১৯৭৫ এর নভেম্বরের দিকে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কয়েকটি সফল অপারেশন পরিচালনা করেছিলেন। ঘাতকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। ১৯৭৫ এর ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান হলে, খালেদ মোশারফের পক্ষে ঢাকায় সমাবেশের উদ্যোক্তাদের অন্যতম ছিলেন এই বীর আলেম। ৭ নভেম্বর পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে যখন খালেদ মোশারফ নিহত হন, তখন মৌলভী সৈয়দ, এ.বি.এম. মহিউদ্দীন চৌধুরী সহ পুরো দলটি ভারতে আশ্রয় নেয়।
১৯৭৬ সালের ৭ নভেম্বর দেশদ্রোহিতার অভিযোগে মৌলভী সৈয়দকে ১ নং ও এ.বি.এম. মহিউদ্দীন চৌধুরীকে ২ নং আসামি করে মোট ১৬ জন বিপ্লবী নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা-১, মামলা-২, মামলা-৩ নামে পরিচিত ৩টি মামলা দায়ের করা হয়। পরবর্তীতে ভারতের জাতীয় নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধির দল পরাজিত হলে মৌলভী সৈয়দ ও সহকর্মীদের ভারতীয় সামরিক বাহিনী আটক করে ময়মনসিংহ বর্ডার দিয়ে পুশব্যাক করে। বাংলাদেশের সীমানার প্রবেশের সাথে সাথে সেদিন মৌলভী সৈয়দ সহ তার অনেক সহকর্মী গ্রেফতার হন।
পরবর্তীতে তাদের ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা হয়। ওই বছরের ১১ আগস্ট বিনা বিচারে মৌলভী সৈয়দকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান বিচারের নামে প্রহসন করে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছিলেন। সংগ্রামের মাধ্যমে যার জীবন শুরু, সংগ্রাম করেই জীবন দিয়ে গেলেন বীর শহীদ মৌলভী সৈয়দ। নির্মমভাবে হত্যার পর তার লাশ সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে বাঁশখালীতে তাঁর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করা হয়। দীর্ঘ এক মাস পুলিশ দিয়ে কবর পাহারা দেয় সামরিক সরকার, যাতে করে জনগণ এই হত্যার প্রতিক্রিয়ায় বিশৃংখলা সৃষ্টি করতে না পারে। কি রকম ভয় পেত তাকে তৎকালীন সরকার- এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায় ।
চিরকুমার শহীদ মৌলভী সৈয়দ আহমদ বীর প্রসবিনী চট্টলার বীরপুরুষ, প্রতিবাদের আইকন। অসামান্য দেশপ্রেমের অধিকারী এই বীর পুরুষটি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন দেশসেবায়। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ভালবাসা ছিল নজিরবিহীন। বাঁশখালিতে চিরনিদ্রায় কবরে শুয়ে আছেন বঙ্গবন্ধু পাগল এই মানুষটি। তার স্মরণে কিছুই করেনি কোনো সরকার। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাকে যেন মনে রাখতে পারে সে জন্য তার নামে কিছু করা উচিত।
লাল সালাম বিপ্লবী বীর মৌলভী সৈয়দ
হাসান মনসুর সাঃ সম্পাদক(সাবেক) কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগ। |
করোনাভাইরাসের ঝাঁকুনিতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যেকার এক লাখ ছয় হাজার কোটি টাকার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে বন্ধ রয়েছে আমদানি-রফতানি। নতুন করে এলসি তো খোলা হচ্ছেই না, পূর্বে এলসি করা পণ্যের জাহাজীকরণও বন্ধ। বন্ধ রয়েছে ব্যবসায়ী এবং কর্মরতদের আসা-যাওয়াও। অথচ বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় প্রতিটি পর্যায়েই যুক্ত রয়েছে চীন।
রফতানিমুখী এবং স্থানীয় বাজারের জন্য পণ্য উৎপাদনকারী শিল্প-কারখানাগুলো কাঁচামালের জন্য অনেকাংশেই চীনের ওপর নির্ভরশীল। বতর্মানে বাংলাদেশের ১২টি প্রকল্পে ৯০ হাজার কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে চীন। এসব প্রকল্পে কাজ করছে দুই হাজারের বেশি চীনা বিশেষজ্ঞ।
তাদের অনেকেই ছুটিতে গেছেন, বাকিরা পরিবার-পরিজনের কাছে যেতে উদগ্রীব হয়ে আছেন। করোনাভাইরাসের কারণে একরকম নিথর হয়ে আছে বিশ্ব অর্থনীতি। এর বিস্তৃতি ও ব্যাপকতা আরও বাড়লে বাংলাদেশের অর্থনীতি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
চীনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, করোনাভাইরাসে দেশটিতে এ পর্যন্ত আট শতাধিক প্রাণহানি ঘটেছে। বেশির ভাগ মৃত্যু ও নতুন সংক্রমণের ঘটনাই ঘটেছে হুবেই প্রদেশে, যার উহান শহরকে এ ভাইরাসের ‘উৎসস্থল’ বলা হচ্ছে। এ ছাড়া এ পর্যন্ত চীনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে হংকংয়ে একজন এবং ফিলিপাইনে একজন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।
বিশ্বের অন্তত ২৫টি দেশে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। ভাইরাসটির ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে চীনের বেশ কয়েকটি শহর অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে কয়েক হাজার লোককে কোয়ারেন্টিন করে রাখা হয়েছে। ট্রেন স্টেশন ও বিমানবন্দরের পাশাপাশি রাস্তাগুলোও বন্ধ করে দেয়ায় চীনের মধ্যাঞ্চলীয় হুবেই প্রদেশ প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে আছে। প্রথমে এই প্রদেশেই ভাইরাসটি শনাক্ত হয়েছিল। প্রাদেশিক রাজধানী উহানের একটি সি-ফুড মার্কেট থেকে ভাইরাসটির উৎপত্তি বলে মনে করা হয়।
বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে যে অবস্থা চলছে, বাংলাদেশকে তার অনেক বেশি মূল্য দিতে হবে। বিশেষ করে কাঁচামালের অভাবে শিগগির অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। মূলধনী যন্ত্রপাতির অভাবে অনেক নতুন ফ্যাক্টরি চালু করা সম্ভব হবে না। ইতোমধ্যে চীনা নাগরিকদের বাংলাদেশে আসা বন্ধ রয়েছে। অনেক প্রতিনিধি তাদের সফর বাতিল করেছেন। এতে কারিগরি কর্মকর্তারাও আসতে পারছেন না।
এতে প্রস্তুতি শেষ হলেও কারিগরি কর্মকর্তার অভাবে অনেক শিল্পকারখানা চালু হতে পারবে না। ফলে পূরণ হবে না রফতানির ল্য। আটকে গেছে শত শত এলসি। এতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বাড়বে। পণ্য শিপমেন্টের অপেক্ষায় আছে বহু ব্যবসায়ী।
উদ্যোক্তারা জানান, বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামালের প্রায় পুরোটাই আমদানি করা হয় চীন থেকে। এর বাইরেও কাপড়, আদা, রসুন, বিভিন্ন প্রকারের খাদ্যসামগ্রী, মেশিনারি, খুচরা যন্ত্রাংশ, খেলনা, মোবাইল, বৈদ্যুতিক সামগ্রী মিলিয়ে শত শত আইটেমের পণ্য আমদানি করা হয় চীন থেকে। সবচেয়ে বড় বাণিজ্য হচ্ছে তৈরী পোশাক ও এর কাঁচামাল আমদানি।
যা চীনের বাইরে প্রত্যাশা করাটাও অসম্ভব। চীনে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস আতঙ্ক ছড়াচ্ছে সারা বিশ্বে। দেশটির ভেতরে এ সংক্রমণের প্রভাব এত তীব্র যে চীনের বেশির ভাগ অফিস ও ব্যাংক নববর্ষের ছুটির পর এখন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। চেষ্টা করেও সেখানে এলসি খুলতে পারছেন না বাংলাদেশী আমদানিকারকরা।
দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর নবাবপুরে ব্যবসা করা ব্যবসায়ী আবদুল করিম গতকাল বলেন, নবাবপুর এলাকায় বিক্রি হওয়া বেশির ভাগ পণ্য আসে চীন থেকে। বিশেষ করে ইলেক্ট্রনিক্স, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও মেশিনারিজ জিনিসপত্র পাওয়া যায় এখানে। চীনে করোনাভাইরাস আক্রান্তের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে দেশের বড় বড় ব্যবসায়ীরা চীন যাচ্ছেন না। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় চীনের পণ্যও আসতে পারছে না। এখন বড় বড় মজুদদারদের কাছে কিছু পণ্য আছে। আবার কিছু পণ্য কারো কাছেই পাওয়া যাচ্ছে না।
যাদের কাছে পণ্য আছে, তারা পণ্যের দাম ১০ থেকে ৩০ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে আগে যেসব পণ্য ১০০ থেকে ১১০ টাকায় পাওয়া যেতে সেগুলো এখন খুচরা বিক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৮০ টাকায়। আবার যেসব পণ্য ২০০ টাকায় পাওয়া যেতে সেগুলো কিনতে হচ্ছে ২৫০ টাকায়। আর এর প্রভাব পড়ছে সাধারণ ক্রেতাদের ওপর।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে মোট বাণিজ্য হয় ১২ দশমিক চার বিলিয়ন ডলারের। এর মধ্যে চীন থেকে দেশে আমদানি হয়েছে এক হাজার ১৬৯ কোটি ২৫ লাখ ডলারের পণ্য। প্রতি ডলার ৮৫ টাকা হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। একই সময়ে চীনে ৬৯ কোটি ৪৯ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ। স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ পাঁচ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা। এ হিসাবে দেশটির সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ১১ বিলিয়ন ডলার বা ৯৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বর্তমানে চীনে চার হাজার ৭০০ পয়েন্ট শুল্কমুক্তভাবে রফতানি করতে পারে বাংলাদেশ।
চীনের করোনাভাইরাস দীর্ঘায়িত হলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হতে পারে মন্তব্য করে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, আমাদের বড় দুশ্চিন্তা তৈরী পোশাক শিল্প নিয়ে। আদা-রসুন হয়তো আমরা ভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে পারব, কিন্তু তৈরী পোশাকের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে চীনের বিকল্প কিছুই ভাবছি না। তবে এ মুহূর্তেই কিছু বলা ঠিক হবে না। কারণ, তথ্যের অনেক ঘাটতি রয়েছে। আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। কী করব তা সময় বলে দেবে।
তৈরী পোশাক খাতের কাঁচামালসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে এ মুহূর্তে কোনো সমস্যা নেই দাবি করে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাস সমস্যা দীর্ঘায়িত হলে চিন্তা করতে হবে। চীনের সাথে যেগুলো সেক্টরে বাণিজ্য রয়েছে বিশেষ করে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএসহ সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে কাজ করছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে বোঝা যাবে। ব্যবসায়ীরাও বিষয়টি পর্যালোচনা করছেন। যথা সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে আশ্বাস দেন তিনি।
চীনের সাথে বাংলাদেশের যেসব সেক্টরের বাণিজ্য রয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে সেসব সেক্টরের আমদানিকৃত বা রফতানিকৃত পণ্যের পরিমাণসহ বিভিন্ন তথ্য তিন দিনের মধ্যে জানতে চাওয়া হয়েছে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের কাছে। একইসাথে গত কয়েক বছর কী পরিমাণ পণ্যের বাণিজ্য চীনের সাথে হয়েছে তারও তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। বর্তমানে এ নিয়ে কাজ করছেন বলে জানান এফবিসিসিআই নেতারা।
বতর্মানে বাংলাদেশের ১২টি প্রকল্পে ৯০ হাজার কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে চীন। এসব প্রকল্পে কাজ করছে দুই হাজারের বেশি চীনা বিশেষজ্ঞ। দেশটির মোট সহায়তার পরিমাণ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রোড ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড হাইওয়ের ১৬০ কোটি ডলার, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে ১৫ কোটি ডলার, কর্ণফুলী টানেলে ৭০ কোটি, রাজশাহী ওয়াসায় ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে ৫০ কোটি ডলার, বিদ্যুৎ খাতের ডিপিসিতে পাওয়ার সিস্টেম নেটওয়ার্কে ৫০ কোটি, পদ্মা সেতু রেল সংযোগের দুই প্রকল্পে ২৫৮ কোটি ডলার, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসে ১৪০ কোটি ডলার, পাওয়ার গ্রিডে ১৩২ কোটি ডলার এবং টেলিকমিউনিকেশন আধুনিকায়নে ২০ কোটি ডলার সহায়তা করছে চীন। এ ছাড়াও আরও ৯টি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন। এসব প্রকল্পে সহায়তার পরিমাণ ৮০৮ কোটি ডলার।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য অনুসারে বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন। অন্য দিকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হিসাবে ২০১৮ সালে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৪২তম। আর বিশ্বের চীনের অবস্থান দ্বিতীয়। এ সময়ে বাংলাদেশের জিডিপির আকার ছিল ৩০২ দশমিক চার বিলিয়ন ডলার। এ সময়ে চীনের জিডিপি ছিল ১২ দশমিক ২৩ ট্রিলিয়ন ডলার।
অর্থাৎ বাংলাদেশের চেয়ে চীনের জিডিপির আকার ৫৫ গুণ বেশি। তৈরী পোশাকের বিশ্ববাজারে ৪০ শতাংশই চীনের দখলে। বাংলাদেশ চীন থেকে যেসব পণ্য আমদানি করে এর মধ্যে রয়েছে- টেক্সটাইল, যন্ত্রপাতি ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি, সার, টায়ার, লৌহ ও ইস্পাত, সয়াবিন তেল, পাম অয়েল, গম প্রভৃতি। অন্য দিকে বাংলাদেশ চীনে যেসব পণ্য রফতানি করে এগুলো হলো- চামড়া, পাট ও পাটজাত পণ্য, চা, তৈরী পোশাক ও মৎস্যজাতীয় পণ্য।
সমীরণ চাকমা, রাংগামাটি : চাকমা সম্প্রদায়ে জন্ম নিয়ে জীবনের শুরুতেই দেখেছি অন্যের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তে আমার বাবাকে চলতে। বাবার মুখে শুনেছি উনার পূর্ব পুরুষগণও এভাবেই চলেছেন। আমরা চাকমা সম্প্রদায়ের সাধারণ জনগন কখনো আমরা উপজাতি, কখনো ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা, কখনো বা আদিবাসী- যে যেভাবে পারছে সেভাবেই তাদের সিদ্ধান্ত আমাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। রাঙামাটির প্রত্যন্ত একটি গ্রামে জন্ম নিয়ে জীবনের শুরুতেই দেখেছি হেডম্যান কারবারীরা আমাদের দেখভাল করতেন। মাঝে মাঝে দেবতাতুল্য রাজাবাবুদেরও দেখতাম আমাদের খোঁজ খবর নিতে। আস্তে আস্তে যখন কিছুটা বুঝে ওঠা শুরু করলাম তখন অনুধাবন করলাম জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে পড়াশুনার কোন বিকল্প নেই।
তৎকালীন সময়ে আমার গ্রামের নিরক্ষর মানুষগুলোর জীবনযাপন দেখে আমার মনে হতো, একটা অর্থহীন সময় পার করা হচ্ছে। আমার বাবাও বোধহয় এ বিষয়ে কিছুটা বুঝতেন। তিনি রাঙামাটি শহরের আমার এক মাসির বাড়ীতে রেখে আমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। সময়টা তখন পাকিস্তান আমলের শুরুর দিকে। স্কুলের গণ্ডি পার হতেই কলেজে ভর্তি হবার পালা কিন্তু কোথায় পাড়বো! রাঙামাটিতে তো কোন কলেজ নেই।
আমাদের দেবতাতুল্য রাজা বাবুরা আমাদের পড়াশুনার বিষয়টি বিবেচনায় আনতে চাননি। পরে বুঝেছি অশিক্ষিত লোকদের নিয়ন্ত্রণ করা সহজ এ বিবেচনায় রাজা বাবুরা চাইতেন না আমরা শিক্ষিত হই। আমি যখন কলেজে ভর্তির জন্য উম্মুখ তখন শুনেছি রাজপুত্র আর তার স্বজনেরা কেউ কলকাতায় আবার কেউ চট্টগ্রাম বা ঢাকাতে পড়াশুনা করছে। তাই আমাদের জন্য কোন ব্যবস্থা রাখার প্রয়োজন তারা মনে করেননি ।
পরে অবশ্য ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারের উদ্যোগে রাঙামাটিতে একটি কলেজ তৈরীর চেষ্টা করা হলে তৎকালীন রাজা ত্রিদিব রায় আর বাঁধা হয়ে দাঁড়াননি। কলেজে ভর্তির জন্য উদ্বেগ থাকায় চট্টগ্রাম গিয়ে আমি বিভিন্ন বাড়ীতে লজিং থেকে, টিউশনি করে চট্টগ্রাম এর একটি কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের পাহাড়ি সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে যখন ভাবি, মনে হয় আমাদের শাসক শ্রেণী বিশেষত রাজা বাবুরা আমাদের অন্যের দয়ায় বেঁচে থেকে একটি মেরুদণ্ডহীন জাতিতে পরিণত করেছিলেন।
চাকমা রাজারাতো নিজেদের ঐতিহাসিক আড়ম্বর নিয়ে গর্ব করেন। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে তাদের অনেক ভূমিকা রয়েছে বলেও প্রচার করেন। কিন্তু গত কয়েকশত বছর ধরে এমন ঐতিহাসিক ক্ষমতাধরী রাজাগণ আমাদের এমনভাবেই গড়ে তুলেছেন যে, আমাদের তারা পশ্চাৎপদ বলে প্রচার করতে পছন্দ করেন। এখনও আমাদের কোটা পদ্ধতিতে, বিশেষ সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি অথবা চাকুরীতে যোগদান করতে হয়। ১০০ নম্বরের এর ভিতরে ৪০ নম্বর পেয়েও বিশেষ কোটায় উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমরা ভর্তি হতে পারি। অন্যদিকে বাঙালীরা আমাদের চেয়ে পড়াশুনায় ভালো করলেও এবং আমাদের চেয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অনেক বেশি নাম্বার পেলেও তারা সুযোগ পায় না। আমাদের রাজা বাবুরা হয়তো বোঝেন না, বিশেষ কোটায় সুযোগ পেয়ে ভর্তি হওয়ার সময় বাঙালীদের তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি আমাদের আহত করে।
গত এক দশক ধরে রাজা বাবুরা আমাদের আদিবাসী হতে বলছেন। এ বিষয়ে আমি কিছুটা পড়াশুনা করে আমাদের ইতিহাস নিয়ে ঘাটাঘাটি করে নিশ্চিত হয়েছি যে, আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী নই। তবে রাজা বাবুরা হঠাৎ করে কেন আমাদের আদিবাসী বানাতে চাইছেন? আমাদের জন্য কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, আমরা আদিবাসী হতে চাই কি না? এই মতামত কি কেও আমাদের কাছ থেকে নিয়েছেন? রাজাবাবুরা কি গণভোট করে দেখেছেন, সাধারণ চাকমা সম্প্রদায় আদিবাসী হতে চায় কিনা?
আদিবাসী না হয়েও আন্তর্জাতিকভাবে প্রদত্ত এ সংক্রান্ত সংজ্ঞার বিশ্লেষণ করে এর মধ্যে ফাঁক-ফোকর বের করে তারা আমাদের আদিবাসী বানাতে চাইছেন। আমরা এই ভ্রান্তভাবে সংজ্ঞায়িত হয়ে নিজেদের আদিবাসী হিসেবে পরিচিতি নিয়ে বিশেষ সুযোগ সুবিধা চাই কিনা এ বিষয়ে আমাদের মতামত কি কেউ গ্রহণ করেছে? এই ধরণের সিদ্ধান্ত যা অন্য জাতির কাছে আমাদের করুণার পাত্র করে তুলবে যে, আমরা বিশেষ সুবিধা আদায়ের জন্য মিথ্যার ইতিহাস রচনা করেছি।
শুনেছি আমাদের আদিবাসী বানানোর জন্য দেশে বিদেশে রাজাবাবুরা অনেক দৌঁড়-ঝাঁপ করছেন। কিন্তু আমরা কি পেয়েছি তাদের এই দৌঁড়ঝাঁপের মাধ্যমে? আমাদের সন্তানেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাইলে তো’ রাঙামাটির বাহিরে যাওয়ার প্রয়োজন হয়। সরকার রাঙামাটিতে মেডিকেল কলেজ আর প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় করতে চাইলে এই রাজাবাবুরা তাতে বাঁধা দিয়েছেন। আদিবাসী বিষয়ক ভ্রান্ত মিথ্যার আবর্তের কলঙ্ক আমাদের মধ্যে জড়িয়ে না দিয়ে রাজা বাবুরা পারতেন আমাদের উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করতে।
তারাই বলেন, তাদের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। তারা চাইলেতো প্রতিটি গ্রামে গ্রামে ভালো ভালো স্কুল, কলেজ স্থাপন করতে পারতেন। গ্রাম পর্যায়ে আমাদের সন্তানেরা সু শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারতো। তখন কোটা পদ্ধতির সুযোগ নিয়ে অন্যের করুণার পাত্র হতে হতো না।
চাকমা জাতির মেধা রয়েছে, সক্ষমতা রয়েছে, যুগে যুগে রাজা বাবুদের চাপিয়ে দেওয়া পশ্চাৎপদ সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও দেশ বিদেশে নিজ যোগ্যতায় আমরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছি। এ জাতির জন্য শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হলে তারা দেশ ও জাতির জন্য কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। তাই রাজাবাবু আর সন্তু লারমারাসহ যারা গত কয়েক দশক ধরে আমাদের নিয়ে রাজনীতি করছেন, তাদের বলছি, যুগে যুগে আপনাদের কর্মকাণ্ডে চাকমা সম্প্রদায় ছাড়াও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠি ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আমাদের জীবন একটাই। আমরা আত্মসম্মানবোধ নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাই। আমরা কারো করুণার পাত্র হতে চাই না। আমাদের সক্ষমতা রয়েছে আমরা এ সক্ষমতা ব্যবহার করে বাংলাদেশের উন্নয়নে অংশগ্রহণ করতে চাই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিক্রমায় স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও বেঁচে থাকার যে স্বাদ আমরা পেয়েছি তাকে পুঁজি করে সামনে এগিয়ে যেতে চাই। আমরা কোন নেতার ব্যক্তিস্বার্থগত সিদ্ধান্ত, যা’ শুধুমাত্র তাদেরকে এবং তাদের পারিবারকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সুনাম-স্বীকৃতি প্রাপ্তিতে সহায়তা করবে এবং অপরদিকে আমাদের বাংলাদেশের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর কাছে করুণার পাত্র করে তুলবে সেই পরিবেশ আমরা চাই না। অন্যের সিদ্ধান্তের এই পথ চলা এখনই বন্ধ হোক, শুরু হোক ব্যক্তি স্বাধীনতার স্বাদযুক্ত অবারিত এই ধরনীর বুকে দৃপ্ত পথ চলা।
লেখক: সমীরণ চাকমা, রাংগামাটি
মাহের ইসলাম: একজন মাত্র ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ঘটনাবলীর মধ্যে পার্বত্য চট্রগ্রামের সবচেয়ে আলোচিত এবং বিতর্কিত ঘটনা হল কল্পনা চাকমার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা। ঘটনাটি আসলে অন্তর্ধান না অপহরণ সে নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, কেন আলোচিত বলা হচ্ছে, সেটা বলাই বাহুল্য।
বিতর্কিত ট্যাগ লাগানোয় অনেকে মনঃকষ্ট পেতে পারেন বিধায়, স্মরণ করা যেতে পারে যে, ২০০৬ সালে হিল উইমেন্স ফেডারেশন কর্তৃক প্রকাশিত পাহাড়ের রুদ্ধকন্ঠ, দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে জানা যায়, “৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে অস্ত্র সমর্পণের পরে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় কালে তিনি (সন্তু লারমা) ‘কল্পনা অপহরণ ও লোগাঙ গণহত্যাকে বিতর্কিত বিষয়’ বলে উড়িয়ে দেন।“ (পাহাড়ের রুদ্র কণ্ঠ, দ্বিতীয় সংখ্যা, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, ২০০৬, পৃ. ৬০ দ্রষ্টব্য)।
আপাতদৃষ্টিতে, বিশ্লেষণের আঙ্গিকে এই ঘটনাটি যেমন একদিকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী এবং পার্বত্য চট্রগ্রামের ক্ষেত্রে অনন্য এক ঘটনা হিসেবে প্রতীয়মান; তেমনি অন্যদিকে নৈমিত্তিক ও একই ধরণের প্রচেষ্টার বিপরীতে অভাবনীয় ফলদায়ক এক অনন্য সাধারণ ঘটনা হিসেবে প্রমাণিত। আর এ কারণেই, এই ঘটনার সত্যাসত্য নির্ণয়ের দুঃসাহস না দেখিয়ে বরং দৃষ্টির আড়ালে রয়ে যাওয়া ঘটনার প্রেক্ষাপটের বাস্তবতায় আলোকপাত করা শ্রেয়।
ঘটনার প্রেক্ষাপট বিবেচনা করা যে কোন ঘটনার কারণ বের করার পূর্বশর্তস্বরূপ। পার্বত্য চট্রগ্রামের ঘটনাবলীর উপর নজর রাখেন এমন সকলেই স্বীকার করবেন যে, আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর কোনটিই তাদের বিরুদ্ধবাদীদের সহজে মেনে নেয় না। এক্ষেত্রে, শাস্তিস্বরূপ শারীরিক নির্যাতন, জরিমানা, ধর্ষণ, অপহরণ, এমনকি হত্যা পর্যন্ত করা হয়।
সাম্প্রতিক কালের মণ্টি চাকমা আর দয়াসোনা চাকমার অপহরণের ঘটনা দেখে অনেকের মনে হতে পারে, এসব হয়ত শুধু এখনকার সময়ে ঘটে। এমন ধারণা পোষণকারীদের ভুল ভাঙাতে ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত লে. আবু রুশদ (অব.) এর ‘পার্বত্য চট্রগ্রাম, শান্তিবাহিনী ও মানবাধিকার’ নামক বই থেকে তৎকালীন সময়ের কিছু উদাহরণ দেয়া হলঃ
১। সংবাদ সংস্থা মিডিয়া সার্ভিস ‘তিনটি পার্বত্য জেলার আইন শৃংখলা পরিস্থিতি’ শিরোনামের এক রিপোর্টে জানুয়ারি ১৯৯৬ তে জানায়, “পিসিপি (পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের) -পিজিপি’র (পাহাড়ী গণপরিষদের) সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি আলোক চাকমা বলেন যে, শান্তিবাহিনীর এসব সমর্থক সংগঠনের সন্ত্রাস এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এদের বিরুদ্ধে কথা বললেই ধরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং নির্যাতনের মাধ্যমে মেরে ফেলা হয়।”
২। ১২ সেপ্টেম্বর (১৯৯৫), খাগড়াছড়ির পোছেড়া গ্রামের “বিভা বসু চাকমার পুত্র কালোমানি চাকমাকে পিসিপি’র কর্মীরা ধরে নিয়ে হত্যা করে”।
৩। “সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটির সক্রিয় কর্মী সুকুমার চাকমা, রুইথুই মারমা এবং বোধিমিত্র চাকমাকে পাহাড়ী ছাত্র – গণপরিষদের কর্মীরা অপহরণ করে নিয়ে যায়। ”
৪। ২৩ ডিসেম্বর (১৯৯৫), “পানছড়ি এলাকা থেকে পিপিএসপি’র সদস্যা ধীমান দেওয়ান এর মা শেফালীকা দেওয়ান ও তার মামা নবকুমার দেওয়ানকে অপহরণ করা হয়।”
৫। ২০ জানুয়ারি (১৯৯৬), পানছড়ি থেকে পাইলট ফার্ম প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে অপহরণ করা হয়।
৬। পিসিপি’র পানছড়ির সম্পাদক ২৪ ডিসেম্বর (১৯৯৫) তারিখে পিসিপি’র প্রধান প্রসীত বিকাশ চাকমার কাছে এক গোপন চিঠি পাঠিয়ে, “সন্ত্রাসবিরোধী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আলোক চাকমাসহ উষাতন, অরুণ, আলো, দেবাশীষ এবং মিলন চাকমাকে মেরে ফেলার জন্য” অনুমতি চায়। (লে. আবু রুশদ, পার্বত্য চট্রগ্রাম শান্তিবাহিনী ও মানবাধিকার; জেড, আর প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৭, পৃষ্ঠা ৪৮-৪৯ দ্রষ্টব্য।)
(রুশদ, ১৯৯৭, pp. ৪৮-৪৯)
সংগত কারণেই, এমন অসংখ্য উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও এই তালিকা দীর্ঘ করার প্রয়োজন নেই। বরং, কল্পনা চাকমার ঘটনার সময়কাল বিবেচনা করা বেশি প্রয়োজন।
“১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাঙামাটি জেলায় পাহাড়ি সংগঠনগুলো নিজস্ব প্রার্থী হিসেবে তাদের অঙ্গ সংগঠন পাহাড়ী গণপরিষদের কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য বিজয় কেতন চাকমাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে (প্রজাপতি মার্কা) দাঁড় করায়। তার পক্ষে প্রচারণা চালানোর জন্য তাদের প্রকাশ্য সংগঠন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), পাহাড়ী গণপরিষদ (পিজিপি) ও হিল উইমেন ফেডারেশন (এইচডব্লিউএফ) কে নির্দেশ দেয়।
অপরদিকে রাঙামাটিতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী দীপংকর তালুকদারের পক্ষে নাগরিক কমিটিসহ বেশীরভাগ ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী ও বাঙ্গালী জনগন সমর্থন দেয় এবং প্রচারণায় নামে।
তৎকালীন শান্তিবাহিনীর দোসর পিসিপি, পিজিপি ও এইচডব্লিউএফ দীপংকর তালুকদারের জনপ্রিয়তায় শঙ্কিত হয়ে তার সমর্থক বিভিন্ন নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও সাধারণ উপজাতীয়দের হুমকি দেয়া ও হয়রানি করা শুরু করে। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা সেসময় সমগ্র পার্বত্যাঞ্চলে প্রায় ৩৫ জন আওয়ামীলীগ সমর্থককে নির্বাচনের আগে ও পরে অপহরণ করে।
এদিকে কল্পনা চাকমা আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর হয়ে প্রচার কাজ চালাচ্ছিলেন, যদিও তিনি হিল উইমেন ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদিকা ছিলেন। এসব মিলিয়ে ঘটনাটি তাদের উপদলীয় কোন্দলের সৃষ্টি করেছিল এবং তাকে উক্ত প্রচার থেকে বিরত থাকার জন্য সন্ত্রাসীরা বেশ কয়েকবার হুমকিও দিয়েছিল।” (কল্পনা চাকমা কি বেঁচে আছেন?, পার্বত্যনিউজ, ১১ জুন ২০১৬)।
উপরোক্ত উদাহরণসমূহ এবং ঘটনার প্রেক্ষাপটে কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করা কাদের স্বার্থে জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নেয়ার ভার পাঠকের হাতেই ছেড়ে দেয়া হল।
পাঠকের দোদুল্যমনতা দূরীকরণের অভিপ্রায়ে আরো কিছু তথ্য দেয়া প্রাসঙ্গিক নিঃসন্দেহে। পূর্বোক্ত বইয়ের তথ্যানুযায়ী, ১৯৭৬ সাল হতে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত পাহাড়ী ও বাঙ্গালী মিলিয়ে মোট ২৩৮৯ জন অপহরণ ও গুম হয়েছেন। শান্তি চুক্তির পরে গত বিশ বছরে অপহৃত হয়েছে প্রায় হাজার দেড়েক মানুষ। অর্থাৎ অদ্যবধি, পার্বত্য চট্রগ্রামে পাহাড়ী – বাঙ্গালী মিলিয়ে প্রায় চার হাজার মানুষ অপহরণের শিকার হয়েছেন। আর, এই সকল অপহরণের প্রায় শতভাগই হয়েছে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হাতে। ( অপহরণের আরো কিছু উদাহরণ জানতে চাইলে এই লিঙ্কে (http://www.somewhereinblog.net/blog/MaherIslam/30235131) যাওয়া যেতে পারে। )
মাহের ইসলাম:
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা নিয়ে যেকোনো আলোচনার শুরুতেই দেশের সুশীল সমাজ. বিদগ্ধজন, এমনকি অনেক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষককে বলতে শোনা যায়, পাকিস্তান আমলে সরকার কর্তৃক কাপ্তাই বাঁধ সৃষ্টি করে বিপুল পরিমাণ পাহাড়ীদের পানিতে ডুবিয়ে বাস্তচ্যুত করায় পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রথম অসন্তোষ দানা বাঁধে, তারা ক্ষুদ্ধ হয়, বিদ্রোহী হয়। তাদের এ বক্তব্যের সারবত্ত্বা কতটুকু তা বিবেচনার দাবী রাখে।
কর্ণফুলী নদীকে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা এবং এর ‘অববাহিকার নিম্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণহীন সর্বনাশা বন্যা নিয়ন্ত্রণের’ কথা মাথায় রেখে ১৯০৬-০৭ সালে সর্বপ্রথম এবং ১৯২২ সালে পুনরায় নদীতে বাঁধ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায়, ১৯৪০ সালে প্রিলিমিনারি রিপোর্ট এবং ১৯৫২ সালে কর্ণফুলী বহুমুখী প্রকল্পের বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়। ( সূত্র: জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য স্থানীয় পরিষদ, প্রকাশ: ১৯৯৩ )। ঐ সময় এই প্রকল্প থেকে নিম্নোক্ত পাঁচটি সুবিধা বিবেচনা করা হয়েছিলঃ
- ক। বিদ্যুৎ উন্নয়ন।
- খ। সেচ ও পানি নিষ্কাশন।
- গ। বন্যা নিয়ন্ত্রণ।
- ঘ। নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি।
- ঙ। বনজ সম্পদ আহরণে সুবিধা।
শ্রী বিরাজ মোহন দেওয়ান কর্তৃক রচিত ও ১৯৬৯ সালে প্রথম প্রকাশিত ‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ হতে জানা যায় যে, কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণের ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ‘সুচারুরূপে’ পরিচালনার জন্যে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৫ সাল থেকে তৎকালীন চাকমা সার্কেল চীফ (যিনি চাকমা রাজা নামেও পরিচিত) মেজর ত্রিদিব রায়ের সভাপতিত্বে সরকারী ও বেসরকারী কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে এক সাব-কমিটি গঠন করেন। “Sub-Committee উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য কর্তৃপক্ষের নিকট এক বিস্তৃত রিপোর্ট প্রদান করেন।
ফলে, কাচলং, রাইংখ্যং, ও ঠেগা রিজার্ভ ফরেস্টের কিয়দংশ এলাকা বন বিভাগ হইতে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য মুক্ত করিয়া দেওয়া হয়। রাজা বাহাদুর ঐ সময় পুনর্বাসন এলাকাদি পরিদর্শন করতঃ উদ্বাস্তুদের উৎসাহ প্রদানে তাহাদের সুখ সুবিধার ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়া তাহাদের কষ্ট লাঘব করিয়া দেন এবং পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ঐকান্তিক চেষ্টায় আজ সেইখানে স্থাপিত হইয়াছে এক শান্তিপূর্ণ পরিবেশ।” (সূত্র: বিরাজ মোহন দেওয়ান, পৃষ্ঠা-১৫২ দ্রষ্টব্য)।
স্মরণযোগ্য যে, বিরাজ মোহন দেওয়ান রচিত উপরোল্লিখিত বইয়ের পুণঃমুদ্রণের সময় রাজা দেবাশীষ রায় বইটিকে “পুস্তকটি অত্রাঞ্চলের ইতিহাস রচনাবলীর মধ্যে অগ্রজ ভুমিকার দাবীদার।” হিসেবে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। (সূত্র: বিরাজ মোহন দেওয়ান, ২০০৫, অভিমত দ্রষ্টব্য)। একথা মনে করিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য হলো, বইটির গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে ধারণা দেয়া এবং এই সত্যটি প্রতিষ্ঠা করা যে, পাকিস্তান সরকার কর্তৃক কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণের ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যে স্বয়ং চাকমা রাজার নেতৃত্বে পুণর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।
শুধু তাই নয়, উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের যথাযথ পদক্ষেপও নেয়া হয়েছিল, যার ফলে পুণর্বাসিতগণ ঐ সময়েই ‘এক শান্তিপূর্ণ পরিবেশ’ এর দেখা পেয়েছিলেন। আরো স্মরণযোগ্য যে, কাপ্তাই বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার আগেই এই কমিটি গঠন করা হয়েছিল ( নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৫৭ সালে)। এই সত্য মেনে নিলে, স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন থেকে যায়, তাহলে এত বছর পরে যারা কাপ্তাই বাঁধের দোহাই দিয়ে অশান্তি সৃষ্টি করার অপচেষ্টা করছে, তাদের উদ্দেশ্য আসলে কী?
কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণের ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয় যে, ২৫৬ বর্গমাইল এলাকার ঘরবাড়ি ও কৃষিজমি তলিয়ে গেছে, প্রায় এক লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তন্মধ্যে কিছু লোক ক্ষতিপূরণ সরকারের কাছ থেকে পেয়েছে। প্রদীপ্ত খীসা তার ‘পার্বত্য চট্রগ্রামের সমস্যা’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, “১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ শেষ হলে তার পরিণতিতে ৯৯ হাজার ৯শ’ ৭৭ জন বাস্তু ও জমিহারা হয়ে পড়েন”। (সূত্র: প্রদীপ্ত খীসা, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা, প্রকাশ ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ৩৫ দ্রষ্টব্য)।”
পাকিস্তান আমলে কাপ্তাই লেক ছিল রাঙামাটি মহকুমার অন্তর্ভুক্ত। ১৯৬১ সালের আদম শুমারী মোতাবেক রাঙামাটি মহকুমার আয়তন ১৬০১ বর্গমাইল, মোট জনসংখ্যা ১,৬২,৪৯৫ জন এবং মোট বাড়ি ছিল ২৮,৩৭২ টি।
শুমারীর তথ্যানুসারে, রাঙামাটি মহকুমায় প্রতি বর্গ মাইলে বাস করত ১০২ জন লোক। থানা অনুযায়ী, জনসংখ্যার বিন্যাস ছিল নিম্নরূপঃ
যদি ধরে নেয়া হয় যে, কর্ণফুলী প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা এক লাখ; তাহলে উপরের তথ্য অনুসারে, রাঙামাটি মহকুমার মাত্র ৬.২৫% এলাকায় সমগ্র মহকুমার ৬১.৫৪% বাড়ি ও মানুষ ছিল। (মোট আয়তন ১৬০১ বর্গমাইলের মধ্যে প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত ২৫৬ বর্গমাইল; মোট জনসংখ্যা ১,৬২,৪৯৫ জন, ক্ষতিগ্রস্ত এক লাখ)। পুরো মহকুমার শুধুমাত্র এই ২৫৬ বর্গমাইলে জনসংখ্যার বসতি ছিল, প্রতি বর্গমাইলে ৩৯০ জন। যা যৌক্তিক হওয়ার কোন সুযোগ নেই। (সূত্র: আনিসুল হক, পার্বত্য চট্রগ্রাম উপজাতীয় সমস্যা ও শান্তিচুক্তি, প্রকাশ ২০০৭, পৃষ্ঠা: ৬২-৬৩ দ্রষ্টব্য)
সঙ্গত কারণেই, আনিসুল হক তার ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতীয় সমস্যা ও শান্তিচুক্তি’ বইয়ে তথ্য পর্যালোচনা করে ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। এর কারণ হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন যে,
- উপজাতীয় বা বিদেশি লেখকদের কোন লেখায়ই উল্লেখ করা হয়নি যে, পাহাড়িদের সমতল এলাকা প্রীতি আছে বা পাহাড়ির বিরাট সংখ্যক লোক একটা নির্দিষ্ট এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস কিংবা কৃষির প্রতি আগ্রহী।
- বরং সবাই একটা বিষয়ে একমত যে পাহাড়িরা ‘জুম নির্ভর যাযাবরী জীবনে অভ্যস্ত’।
- বর্তমানে অনেক খালি সমতল জায়গা থাকা সত্ত্বেও, ‘উপজাতীয়রা পাহাড় বা পাহাড়ী এলাকায় বসবাস করছে’।
- পাহাড়িদের গ্রামে অন্য এলাকার মতই এক সাথে অনেকগুলো পরিবার থাকে। কিন্তু বর্তমানে যে গ্রামের জনসংখ্যা ১৯৬১ সালের তুলনায় পায় ৪ গুণ হয়ে গেছে, সেখানেও ১০০ হতে ১৫০ পরিবারের গ্রাম খুব একটা পাওয়া যাবে না। (সূত্র: প্রাগুক্ত দ্রষ্টব্য) ।
পাঠকের জ্ঞাতার্থে, কাপ্তাই লেক এলাকার ইউনিয়ন অনুযায়ী জনসংখ্যার বিন্যাস নিচে তুলে ধরা হলোঃ
ইউনিয়নের মোট জনসংখ্যার চিত্র দেখেও এটা বোঝা যায় যে, এক লাখ মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে হলে অনেকগুলো ইউনিয়নকে পুরোপুরি পানির নিচে তলিয়ে দিতে হবে। রাঙ্গামাটি জেলার ম্যাপের দিকে তাকালেই বোঝা যায় যে, বিষয়টি কতটা অবাস্তব হতে পারে। সুতরাং, শুধুমাত্র ২৫৬ বর্গমাইলে প্রায় এক লাখ লোকের বাস ছিল এমন দাবী করা মোটেও যুক্তি সংগত নয়। (সূত্র: আনিসুল হক, পার্বত্য চট্রগ্রাম উপজাতীয় সমস্যা ও শান্তিচুক্তি, প্রকাশ ২০০৭, পৃষ্ঠা: ৬২-৬৩ দ্রষ্টব্য)
ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের একটা পূর্ণ চিত্র পাওয়া যায় জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমার ‘ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য স্থানীয় সরকার পরিষদ’ বইয়ে। এ বইয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, “প্রকল্পের প্রতিবেদনে বাঁধের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত জনসংখ্যার হিসাব দেওয়া হয়নি। বাঁধ নির্মাণের পর ১২৫ টি মৌজার মোট ১৮ হাজার পরিবারে ১ লক্ষ লোকের কৃষি জমি অথবা বসতবাড়ী ডুবে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এবং বাস্তচ্যুত হয়েছিল। এই ১৮ হাজার পরিবারের মধ্যে ১০ হাজার নদী অববাহিকার সমতল এলাকার চাষী এবং বাকী ৮ হাজার পরিবার জুমিয়া” (সূত্র: জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য স্থানীয় পরিষদ, প্রকাশ: ১৯৯৩, পৃষ্ঠা: ৩০ দ্রষ্টব্য)।
জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমার পূর্বোক্ত বই থেকে আরো জানা যায় যে, পাকিস্তান আমলেই একাধিক দফায় পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল যা ১৯৫৭ সালে শুরু হয়ে ৩০ জুন ১৯৭৫ সালে সমাপ্ত হয়। পুণর্বাসনের সংখ্যা ছিলো নিম্নরূপ:
অর্থাৎ, সর্বমোট ২৫০৪৭ টি পরিবারকে বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন পদ্ধতিতে পুনর্বাসন করা হয়। এই পুনর্বাসন প্রক্রিয়া বাঁধের নির্মাণ কাজের সময়েই শুরু হয় এবং পাকিস্তান আমল পেরিয়ে বাংলাদেশ আমলেও চলমান ছিল।
উপরের তথ্যাবলী থেকে এটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণের সম্ভাব্য প্রভাব সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথা সময়েই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। সেই প্রেক্ষিতে স্বয়ং চাকমা রাজার নেতৃত্বে উপযুক্ত কমিটি গঠন করে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যে যথাযথ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও নিয়েছিলেন। ক্ষতিগ্রস্তদের প্রকৃত সংখ্যা না জানা গেলেও শুমারি ও পাহাড়িদের বসবাসের রীতি পর্যালোচনায় এটা ধারণা করা অমুলক নয় যে, অনেকের দাবিকৃত প্রায় এক লাখ হওয়ার কোন সুযোগ ছিল না।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্ত ২৫০৪৭টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছিল। স্মরণযোগ্য যে, ১৯৬১ সালে রাঙামাটি মহকুমায় মোট বাড়ি ছিল ২৮,৩৭২ টি এবং জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমার পুস্তকে ১৮ হাজার পরিবারের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
শুধুমাত্র আলোচনার জন্যে বিবেচনা করলেও দেখা যায় যে, ১,৬২,৪৯৫ জন ২৮,৩৭২ টি বাড়িতে বসবাস করত। অর্থাৎ, আলোচনার খাতিরে ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা এক লাখ ধরে নিলেও (ইতিপূর্বে দেখা গেছে, এক লাখ লোকের ক্ষতি হওয়ার সুযোগ নেই), কাপ্তাই বাঁধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির সংখ্যা কোন মতেই ১৭,৪৬০ এর বেশী হতে পারে না। এর বাইরেও সীমান্তবর্তী এলাকার কিছু পরিবার সীমানা পেরিয়ে ভারতে চলে গিয়েছিল বলে অনেকেই দাবী করে থাকেন।
অনেকেই বলেন যে, বাস্তভিটার ক্ষতিপূরণ না দেয়াও পাহাড়িদের ক্ষোভের একটা কারণ। আসলেই, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ জায়গা-জমি ও বাড়ির জন্যে ভিন্ন ছিল, যথাক্রমে একর প্রতি গড়ে ২৫০ টাকা ও ঘরবাড়ির জন্যে গড়ে ৪০০ টাকা। কিন্তু তখনকার দিনে পাহাড়িরা বসতবাড়ির ভিটা বন্দোবস্ত নিত না। তাই তারা বাড়ির ক্ষতিপূরণ পায়নি, শুধুমাত্র বাস্তভিটার আশেপাশের গাছ-গাছালির ক্ষতিপূরণ পেয়েছিল।
১৯৬১ সালের শুমারি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে জনসংখ্যার ৮২% ছিল উপজাতি এবং ১৮% অউপজাতি ছিল। যদিও সাধারণত বাঙ্গালিরাই কৃষিকাজের জন্যে সমতল ভুমিতে থাকতে চায় এবং উপজাতীয়রা জুম চাষের জন্যে পাহাড়ে থাকতে পছন্দ করে, তবুও ধরে নিচ্ছি কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় মাত্র ১৮% বাঙ্গালীই ছিল। সে হিসেবে, মোট বাড়ি ১৭,৪৬০ এর ৮২% হিসেবে শুধুমাত্র পাহাড়িদের ১৪,৩১৭ টি বাড়ির ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি, কিন্তু ঐ বাস্তভিটার আশেপাশে রোপিত বাঁশ-গাছের ক্ষতিপূরণও দেয়া হয়েছিল। সহজ কথায়, এক লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকলেও (বাস্তবে, এই সংখ্যা অযৌক্তিক), তন্মধ্যে ১৪,৩১৭ জনের শুধুমাত্র বাস্তভিটার (গাছ-গাছালী বাদে) ক্ষতিপূরণ সরকার কর্তৃক দেয়া হয়নি।
আনিসুল হকের হিসেব মতে, “ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা বড় জোর ৫০ হাজার হতে পারে”। (সূত্র: আনিসুল হক, পার্বত্য চট্রগ্রাম উপজাতীয় সমস্যা ও শান্তিচুক্তি, প্রকাশ ২০০৭, পৃষ্ঠা: ৬৩ দ্রষ্টব্য) । এই সংখ্যা মেনে নিলে (যা বেশী যুক্তিসংগত), মোট ৭১৫৯ জনকে শুধুমাত্র বাস্তভিটার (গাছ-গাছালী বাদে) ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি।
সুতরাং, ধারণা করা যেতে পারে যে, ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই বর্তমানে অনেক বেশী বলা হচ্ছে। এছাড়াও, এই সিদ্ধান্তে আসা মোটেও অযৌক্তিক নয় যে, ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় আশে পাশে বসবাসকারী কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি এমন লোকদেরও ধরা হয়েছিল। এরই পাশাপাশি “নাম, ঠিকানা ও চেহারায় সনাক্তকরণে অসুবিধে, ভীত সন্ত্রস্ত মানসিকতা, ভাষাগত দুর্বোধ্যতা ছাড়াও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সুযোগী মানসিকতা এবং মানবিক সহযোগিতা প্রদান না করায় কিছু লোক সরকারী সাহায্য সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হতে পারে, কিছু লোক বার বার সুযোগ-সুবিধে গ্রহণ করতে পারে, এমন কি আত্নসাতের ঘটনাও ঘটতে পারে।” (সূত্র: আনিসুল হক, পার্বত্য চট্রগ্রাম উপজাতীয় সমস্যা ও শান্তিচুক্তি, প্রকাশ ২০০৭, পৃষ্ঠা: ৬৪ দ্রষ্টব্য)। একই প্রেক্ষাপটে এও অমুলক নয় যে, ক্ষতিপূরণের জন্যে বরাদ্দকৃত অর্থের একটা অংশ তৎকালীন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ নিজেরা কুক্ষিগত করেছিলেন।
তাছাড়া পাকিস্তান সরকার কর্তৃক কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য বরাদ্দ দেয়া অর্থের একটা বড় অংশ এই কমিটি ব্যবহার করতে না পারায় তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত যায়। কাজেই পুণর্বাসনের ব্যর্থতার দায় সরকারের চেয়ে চাকমা রাজার নেতৃত্বাধীন কমিটির উপর বর্তায়।
সহজ কথায়, কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণের ভয়াবহতা সরকারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং ক্ষতিপূরণের ও পুনর্বাসনের যথাযথ পদক্ষেপও গ্রহণ করেছিলেন যথাসময়য়েই। কিন্তু, নেতৃবৃন্দের ব্যক্তি স্বার্থের শিকার হয়েছে সাধারণ পাহাড়ি মানুষেরা। এখনো ব্যক্তি স্বার্থেই কর্ণফুলী বাঁধ নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে।
বিশ্বের অনেক দেশেই উন্নয়নমুলক কাজের ফলে জনসাধারণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জনসাধারণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এই ভয়ে উন্নয়নমুলক কাজ স্থগিত করার কোন নজির নেই। বরং, বৃহত্তর কল্যাণের কথা ভেবে উন্নয়নমুলক কাজের পাশাপাশি সব দেশের সরকারই ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণও তেমনি একটি উন্নয়নমুলক পদক্ষেপ। সরকার কর্তৃক যথাসময়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার পরেও যদি ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণ যথাযথ ক্ষতিপূরণ না পায় এবং পুনর্বাসনের সুফল পেতে ব্যর্থ হয়, তাহলে এর দায়ভার সরকারকে নিতে হবে।
তবে, এর দায়ভার যতটা না তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের তার চেয়ে অনেক অনেক বেশী স্থানীয় নেতৃবৃন্দের যারা এর বাস্তবায়নের সাথে জড়িত ছিলেন। এক্ষেত্রে, তৎকালীন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের দায় সবচেয়ে বেশী। কারণ, তার নেতৃত্বেই ১৯৫৫ সালে পুনর্বাসন কাজ পরিচালনার জন্যে কমিটি করে দেয়া হয়েছিল। কমিটি যে নামমাত্র ছিল না তা বোঝা যায়, যখন কমিটির সুপারিশেই রিজার্ভ ফরেস্ট এর অংশবিশেষ পুনর্বাসনের জন্যে মুক্ত করে দেয়া দেয়া হয়।
এখানে একটি কথা না বললেই নয়, পাকিস্তান সরকার কর্তৃক কাপ্তাই বাঁধ সৃষ্টি ও এর ফলে পানিতে ডুবে বাস্তচ্যুত চাকমা সম্প্রদায়ের স্বাভাবিক কারণেই পাকিস্তান সরকারের প্রতি ক্ষুদ্ধ হওয়ার কথা। বিশেষ করে যে চাকমার সার্কেল চিফের রাজমহল পানিতে ডুবে গেলো তার তো পাকিস্তান সরকারের প্রতি প্রবলভাবে ক্ষুদ্ধ ও বিদ্রোহী হওয়ার কথা, যেমনটা হয়েছিল বাঙালীরা। পাকিস্তান সরকারের বৈষম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালীরা ক্ষুদ্ধ ও বিদ্রোহী হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখলাম?
১৯৭১ সালে পাকিস্তানী বৈষম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বাঙালী জাতি যখন স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন চাকমা সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীরও একই কারণে বাঙালীদের মতোই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শামিল হবার কথা। কিন্তু আমরা দেখলাম খুব সামান্য সংখ্যক চাকমা সম্প্রদায়ের লোকই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে শামিল হয়েছে। উল্টো তাদের অধিকাংশই রাঙামাটিতে পাকিস্তান সরকারের প্রতি আনুগত্য পোষণ করে রাজাকারে নাম লেখায়। এমনকি নিজের রাজত্বের বিশাল এলাকা ও রাজমহল ডুবিয়ে দেয়া এবং নিজের বিপুল পরিমাণ প্রজাকে বাস্তচ্যুত করায় যে চাকমা সার্কেল চিফের সবচেয়ে বেশী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হওয়ার কথা, অথচ সেই চাকমা সার্কেল চিফ ত্রিদিব রায় হলেন দেশের সবচেয়ে কুখ্যাত রাজাকার। যিনি আমৃত্যু পাকিস্তানের আনুগত্য পোষণ করে পাকিস্তানেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
এ থেকে প্রমাণিত হয় চাকমা সম্প্রদায়ের বৃহত্তম অংশ এবং চাকমা নেতৃত্ব, কাপ্তাই বাঁধ সৃষ্টি করে বাস্তচ্যুত করার পরও পাকিস্তান সরকারের প্রতি বিরূপ বা বিক্ষুদ্ধ ছিলেন না। বরং পাকিস্তান প্রেমী ছিলেন। এর কারণ কী হতে পারে? তারা কি পাকিস্তান সরকারের পুনর্বাসন প্রকল্পে সন্তুষ্ট ছিলেন?
তাই এতবছর পরে যখন পাহাড়ি নেতৃবৃন্দের একাংশ সাধারণ পাহাড়িদের চোখের সামনে জাজ্বল্যমান কাপ্তাই বাঁধ দেখিয়ে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করে তখন বুঝতে কষ্ট হয় না, এখানে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার অভিপ্রায়ই প্রধান নিয়ায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদের মত কিছু নেতৃত্বের ব্যক্তিস্বার্থেই সাধারণ পাহাড়িরা কাপ্তাই বাঁধের নির্মাণ পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। রাজনৈতিক ফায়দা লোটার মতলবেই এখনও নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে তারা সোচ্চার – এমনকি সাধারণ পাহাড়ীদের জন্যে দুর্দশার বিনিময়ে হলেও।
♦ লেখক: পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক।
লিখেছেন: মাহের ইসলাম : পার্বত্য চট্রগ্রামের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে, কিছু কিছু শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি শুধুমাত্র পাহাড়িদের বঞ্চনা এবং অত্যাচারিত হওয়ার নির্বাচিত অংশবিশেষের উপর আলোকপাত করেন এবং কোন এক অজানা কারণে পুরো সত্য এড়িয়ে যান। এতে হয়তো, পাহাড়িদের প্রতি সহানুভূতি আদায় করা সহজ হয়; কিন্তু প্রকৃত সত্য আড়ালের দায় এড়ানো যায় না। পাহাড়িদের প্রতি ভালোবাসা থেকে কেউ কেউ এমন করতে গিয়ে হয়ত ভুলে যান যে, কিছু লোকের জন্যে সহানুভূতি আদায়ের এই পদ্ধতি অন্য অনেক লোকের প্রতিও এক ধরনের বঞ্চনার সৃস্টি করছে। সহজ কথায়, একই এলাকার মানুষের একাংশের প্রতি সুবিচারের প্র্ত্যাশায় অন্য অংশের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে।
কোন সন্দেহ নেই যে, পাকিস্তান আমলে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে হাজার হাজার পাহাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটাও ঠিক যে, চাকমা বা মারমারা বাংলাদেশী – বাঙ্গালী নয়। তেমনি এটাও অনস্বীকার্য যে, পার্বত্য চট্রগ্রামে ভুমি সমস্যার অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি কারণ হলো বাংলাদেশের অন্য স্থান হতে বাঙ্গালীদের পার্বত্য চট্রগ্রামে পুনর্বাসন।
পার্বত্য চট্রগ্রামের ব্যাপারে যথাযথ ধারনা লাভের জন্যে এই তিনটি বাস্তবতার আংশিক নয় বরং সম্পূর্ণ প্রেক্ষাপট এবং এর সাথে জড়িত তৎকালীন পাহাড়ি নেতাদের ভূমিকা খাটো করে দেখার অবকাশ রয়েছে বলে মনে হয় না। প্রকৃতপক্ষে, পাহাড়ি নেতাদের ভুমিকাই অনেকাংশে এই তিনটি ঐতিহাসিক বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে – দেশের পরিবর্তে জাতির স্বার্থ দেখতে গিয়ে এই নেতারা তাদের জাতির সাধারণ মানুষের জন্যে বয়ে এনেছেন দুর্ভোগ। যদিও তাদের উদ্দেশ্যে খারাপ কিছু ছিল না, কিন্তু তাদের অদূরদর্শীতা সমগ্র জাতির জন্যে বঞ্চনা আর দুর্দশা নিশ্চিত করেছে। সবচেয়ে ভয়াবহ দিকটি এই যে, এখনকার নেতৃবৃন্দগণও কেন জানি তাদের পূর্বপুরুষের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে বদ্ধ পরিকর – যেখানে আবার আমাদের দেশেরই কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী যোগ দিয়েছেন।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময় পাহাড়ের কোন নেতাই পার্বত্য চট্রগ্রামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে ছিলেন না। বরং অনেক নেতাই যারপরনাই চেষ্টা করেছিলেন ভারতে অন্তর্ভুক্তির জন্যে। এমনকি পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির ব্রিটিশ সিদ্ধান্তের পরেও, তৎকালীন জনসমিতির সাধারণ সম্পাদক স্নেহ কুমার চাকমার নেতৃত্বে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের অফিসের সামনে প্রকাশ্যে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। এক্ষেত্রে তিনি স্থানীয় পাহাড়ী পুলিশদেরকে সশস্ত্র প্রতিরোধের জন্যে প্রস্তুত রাখার পাশাপাশি “গ্রামস্থ বহু পাহাড়ীকেও বন্দুক প্রভৃতি আগ্নেয়াস্ত্র লইয়া উপস্থিত হইতে নির্দেশ প্রদান” করেন। অবশ্য সশস্ত্র প্রতিরোধের পরিকল্পনা জানতে পেরে গভর্নর জেনারেল বলেছিলেন, “হিন্দুস্তান ভুক্তির চেষ্টা পরিহার করুন, অন্যথা শুধু শক্তির অপব্যয় করা হইবে এমন নহে, ইহাতে তোমরা বিশেষ কষ্টে পতিত হইবে” (দেওয়ান, ১৯৭০)।
পরবর্তীতে, পাহাড়ী নেতৃবৃন্দের সশস্ত্র প্রতিরোধ ব্যর্থ করে পাকিস্তানের বেলুচ রেজিমেন্ট ২১ আগস্ট ভারতের পতাকা নামিয়ে ফেলে। “এরপর পাকিস্তান সরকার ঢালাওভাবে উপজাতীয়দের প্রো-ইন্ডিয়ান বা ভারতপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করে। এবং সেই থেকে শুরু হয় তাদের ওপর বিমাতাসুলভ আচরণ প্রদর্শনের পালা।” (খীসা, ১৯৯৬, p. 34)
পতাকা নামালেও পাহাড়ি নেতারা দমে যাননি, অপরপক্ষে ভারতীয় নেতারাও তাদের দেশবিভাগপূর্ব সেন্টিমেন্ট বজায় রাখেন। যার প্রকাশ ঘটে দেশ বিভাগের প্রায় দুই বছর পরে ভারতের কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সরদার প্যাটেল পূর্ব পাকিস্তানী সংখ্যালঘূদের খুশী করার জন্যে যখন বলেন যে, “শুধুমাত্র একটা দাগের অন্যপাশে আছে বলেই যারা আমাদের রক্ত এবং মাংস, যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের পাশে থেকে লড়াই করেছে, হঠাৎ করে তারা আমাদের কাছে বিদেশী হতে পারে না।” (চৌধুরী মোঃ নাজমুল হাসান, ২০০৬, p. 40)। তাই পাহাড়ি নেতাদের সাথে ভারতীয় নেতাদের যোগাযোগের বিষয়টি বুঝতে পেরে, পাকিস্তান সরকার স্বাভাবিকভাবেই তা বন্ধ করার চেষ্টা করেন।
পাকিস্তান সরকারের প্রচেষ্টার মধ্যে পার্বত্য চট্রগ্রামকে বাঙ্গালীদের প্রবেশের জন্যে খুলে দেয়া অন্যতম। যার ধারাবাহিকতায়, ১৯৬২ সালের সংবিধানে পার্বত্য চট্রগ্রামকে ‘এক্সক্লুডেড এলাকা’ হতে ‘ট্রাইবাল এলাকা’র মর্যাদা দেয়া হয়। এমনকি ১৯৬৪ সালে, ‘ট্রাইবাল এলাকা’র বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করে এই অঞ্চলে বাইরের অধিবাসীদের প্রবেশ, বসবাস এবং জমি অধিগ্রহণ এর উপর হতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। অপরপক্ষে, ১৯৬০ হতে ১৯৭০ সালে, এই অঞ্চল হতে বেশীরভাগ পাহাড়ী সরকারী কর্মচারীদের অন্যত্র বদলি করে দিয়ে শুধুমাত্র প্রধানত বাঙ্গালিদেরকেই এখানে সরকারী প্রশাসনের দায়িত্বে রাখা হয়। একই সময়, সোভিয়েত ব্লক ও ভারতের বিপক্ষে আমেরিকাকে সমর্থনের অংশ হিসেবে পাকিস্তান পার্বত্য অঞ্চলে ভারতের নাগা ন্যাশনাল আর্মি এবং মিজো গেরিলাদের সাহায্য করে। এরই পাশাপাশি, এই এলাকার উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্রগ্রামকে ‘ট্যাক্স ফ্রি জোন’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। একই লক্ষ্যে, ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলা ও এই অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে ১৯৫৭ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এই সমস্ত কিছু করা হয় প্রধানত পার্বত্য অঞ্চলকে ভারতে অন্তর্ভুক্তির হাত থেকে রক্ষা করতে। স্মরণযোগ্য যে, ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পরে জম্মু ও কাশ্মীর, হায়দ্রাবাদ, গোয়া, সিকিম, জুনাগর ইত্যাদির ভাগ্যের দিকে তাকালে পাকিস্তানের এহেন ভারতভীতি থাকা মোটেও অস্বাভাবিক মনে হয় না।
(চলবে)
তথ্যসুত্রঃ
খীসা, প. (১৯৯৬). পার্বত্য চট্রগ্রামের সমস্যা. ঢাকা। : সাহিত্য প্রকাশ.
চৌধুরী মোঃ নাজমুল হাসান. (২০০৬, অক্টোবর – ডিসেম্বর). The Resistance Movement in the Chittagong Hill Tracts: Global and Regional Connections. এশিয়ান এফেয়ারস, ২৮(৪), ৩৬-৫১.
দেওয়ান, শ. ক. (১৯৭০). পার্বত্য চট্রলের এক দীন সেবকের জীবন কাহিনী . রাঙামাটি : দেওয়ান ব্রাদার্স এন্ড কোং
মোহাম্মদ সাইদুল হক * যে সমস্ত বরকতময় রজনীতে আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের প্রতি করুণার দৃষ্টি দান করে থাকেন,লাইলাতুল বারা’আত তারই অন্যতম।তাফসীর, হাদিস ও বিজ্ঞ আলিমদের পরিভাষায় এ রাতকে”লাইলাতুন নিছফি মিন শা’বান” বা শা’ বানের মধ্য রজনী নামে অভিহিত করা হয়।যে রাতটি হলো শা’বান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত।প্রিয়নবী (দঃ),বুযুর্গানে দ্বীন ও বিজ্ঞ মনীষীগন রাতটি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে পালন করেছেন।অনুরুপ, যুগে যুগে মুসলমানগণ এরই ধারাবাহিকতায় রাতটি শরীয়ত সম্মত পন্থায় পালন করে আসতেছেন।বর্তমানে কিছু সংখ্যক লেবাসধারী আলেম এ রাত টি উদযাপন করা বিদ’আত ফতোয়া দিয়ে সাধারণ মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করতেছে। ঐ সব জ্ঞানপাপী আলেমদের থেকে সতর্ক থাকার জন্য আপামর মুসলমানদেরকে আহ্বান জানাচ্ছি।
কুরআনের আলোকে শবে বারা’আতঃ আল্লাহ বলেন, ” .হা- মীম।শপথ ঐ সুস্পষ্ট কিতাবের; নিশ্চয়ই আমি সেটাকে বরকতময় রাতের মধ্যে অবতীর্ণ করেছি।নিশ্চয়ই আমি সতর্কবাণী শুনাই।তাতে বন্টন করে দেয়া হয় প্রত্যেক হিকমতময় কাজ।( পারাঃ২৫,সূরা দুখান,আয়াত:১-৪) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে জালালাইন শরীফে উল্লেখ আছে ” নিশ্চয়ই আমি সেটাকে ( কুরআন) বরকতময় রাতের মধ্যে অবতীর্ণ করেছি।সেই বরকতময়ী রাত হচ্ছে হয়তো “শবে ক্বদর” অথবা অর্ধ শা’বানের রাত্রি — শবে বরাত।( তাফসীরে জালালাইন:৪১০ পৃঃ) জালালাইন শরীফে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায়…. ২৪ নং টীকায় আরো উল্লেখ আছে যে, ঐ বরকতময়ী রাত হচ্ছে, অর্ধ-শা’বানের রাত( শবে বরাত)।এটা হযরত ইকরামা ও তাফসীরকারকদের একটা দলে অভিমত।তাঁরা এর কতিপয় কারণও উল্লেখ করেছেন।যেমন—অর্ধ-শা’বানের রাতের কতিপয় নাম আছে–১. আল লাইলাতুল মুবারাকাহ ( বরকতময় রাত)২. লাইলাতুল বারা’আত ( মুক্তির রাত)৩.লাইলাতুর রাহমাহ্ (রহমতের রাত) এবং ৪.লাইলাতুস্ সক্কি( অঙ্গিকারের রাত) ইত্যাদি।তাছাড়া এই রাতে ইবাদত বন্দেগী করার ফলে বান্দা অনেক ফযীলত লাভ করবে।(হাশিয়াহ্ জালালাইনঃ৪১০ পৃঃ) এভাবে আরো বিভিন্ন তাফসীরের কিতাব যেমন – তাফসীরে কাশশাফ,তাফসীরে কুরতুবী সহ গুণিয়াতুত ত্বালিবীন কিতাবে লাইলাতুল বারা’আতে অকাট্য প্রমাণ রয়েছে।এরপরও যারা লাইলাতুল বারা’আতের বিরোধীতা করে তারা যেন উক্ত তাফসীরের কিতাব দেখার আহ্বান জানাচ্ছি।
হাদিসের আলোকে লাইলাতুল বারা’আতঃলাইলাতুল বারা’আত তথা শবে বরাত( ফার্সী শব্দ) এর তাৎপর্য ও ফযীলত সম্পর্কে বহু বিশুদ্ধ হাদিস শরীফ বর্ণিত হয়।নিম্নে কয়েকটা উল্লেখ করা হলো….১.হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন,রাসুল (দঃ) একাধারে (এতবেশী) রোযা রাখতেন ( শা’বান মাসে) আমরা বলাবলি করতাম,তিনি আর রোযা পরিত্যাগ করবেন না।আবার কখনো এমনভাবে রোযা ছেড়ে দিতেন,আমরা বলাবলি করতাম,তিনি আর রোযা রাখবেন না।আমি রাসুল (দঃ) কে রমজান ব্যতীত কোনো পুরো মাস রোজা রাখতে দেখিনি এবং শা’বান মাসের চেয়ে কোনো মাসে বেশী রোযা রাখতে দেখিনি।( বুখরী শরীফ, ১ম খন্ড,পৃঃ২৬৪)সহীহ্ ইবনুল হিব্বান এ হযরত মুয়াজ (রাঃ) থেকে বর্ণিত,যখন শা’বানের মধ্য রজনী (শবে বরাত)উপস্থিত হয়,তখন এক আহ্বানকারী এ আহ্বান করতে থাকে যে, ” কোনোও ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছো কি?আমি তাকে ক্ষমা করব,কোনো প্রার্থী বা ফরিয়াদি আছো কি?আমি তার ফরিয়াদ কবুল করব।এভাবে যে যা প্রার্থনা করবে তাকে তা দেয়া হবে– একমাত্র যিনাকারী ও মুশরিক ব্যতীত।
এভাবে লাইলাতুল বারা’আত সম্পর্কে নিম্নের কিতাব তথা– মা ছবাতা বিস্ সুন্নাহ,পৃঃ ১৮৮;ফাযায়েলুল আওকাত,পৃঃ ১১৬,১১৩;১১৪;আবু দাউদ শরীফ,২য় খন্ড,গুণিয়াতুত ত্বালিবীন, ১ম খন্ড,পৃঃ২৪৬ — কিতাব সমুহে উল্লেখ আছে।
হযরত আলী (রাঃ) প্রায়ই শা’বান মাসের ১৫তম রাত তথা ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে ঘর থেকে বের হতেন।একবার এভাবে শবে বরাতে বের হয়ে আসমানের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললেন, ” একবার হযরত দাউদ (আঃ) শা’বানের ১৫তম রাতে আসমানের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলেছেন,এটা ঐ সময়, ডে সময় যে যা দোয়া আল্লাহর নিকট করেছে,আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেছেন আর যে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে,আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।তবে,দোয়া প্রার্থনাকারী যেন অন্যায়ভাবে কর আদায়কারী,গণক,অত্যাচারী শাসক বা নেতা,চুগলখোর,গায়ক বা বাদ্য- বাজনা বাদক না হয়।অতঃপর এই দোয়া করলেন–” হে আল্লাহ! হে দাউদ (আঃ) এর পালনকর্তা!যে এ রাতে তোমার নিকট দোয়া করে অথবা ক্ষমা প্রার্থনা করে, তুমি তাঁকে ক্ষমা করে দাও।( মা ছাবাতা বিস্ সুন্নাহ,পৃঃ ৩৫৪)
শবে বরাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রাত।কেউ জানেনা তার অদৃষ্টে কি লিখে দেয়া হয়েছে।কাজেই কোনো অবস্হাতেই এ রাতটি অবহেলায় কাটিয়ে দেয়া উচিত নয়।এ রাতে বিশেষভাবে রহমতের বৃষ্টি মুষলধারে বর্ষিত হয়।এ মুবারক রাতে আল্লাহ “বনী কালব” গোত্রের ছাগল গুলোর লোম অপেক্ষা বেশী উম্মতের গুনাহ ক্ষমা করে দেন।কিতাবে উল্লেখ রয়েছে যে,বনী কালব গোত্র আরবের গোত্র গুলোর মধ্যে বেশি ছাগল পালন করত।দুর্ভাগ্য! কিছু হতভাগ্য লোক এমন ও রয়েছে যাদেরকে এ শবে বরাত তথা মুক্তির রাতেও ক্ষমা করা হয় না।যেমন ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) বলেন,১.মদ্যপানে অভ্যস্ত ২.যিনা বা ব্যভিচারে অভ্যস্ত ৩.মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান- সন্ততি ৪.আত্বীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী ৫.ফিৎনা ( বিশৃংখলা)সৃষ্টিকারী ও চুগলখোরদের এ রাতে ক্ষমা করা হয় না।(মুকাশাফাতুল কুলুব,পৃঃ৩০৪)
অনুরুপভাবে,গণক,যাদুকর,অহংকার সহকারে পায়জামা অথবা লুঙ্গি ( প্যান্ট,জুব্বা ইত্যাদি) গোড়ালীর নিচে ঝুলিয়ে পরিধান কারী,দু’ জন মুসলমানের মাঝে বিরোধ সৃষ্টিকারী ও হিংসা বিদ্ধেষ পোষণকারীও এ রাতে ক্ষমার সৌভাগ্য লাভ থেকে বঞ্চিত থাকে।সুতরাং সকল মুসলমানের উচিত,উপোরক্ত গুনাহ্ সমুহ থেকে যদি কোন একটির মধ্যে লিপ্ত থাকে তবে তারা যেন এ শবে বরাত আসার পূর্বেই সত্যিকার অর্থে তাওবা করে নেয়।
শা’বান মাসের ১৫তম রাতে কেউ যদি বড়ই গাছের সাতটি পাতা পানিতে সিদ্ধ করে ঐ পানি দিয়ে গোসল করে, ইনশা আল্লাহ!সারা বছর যাদুর প্রভাব থেকে নিরাপদে থাকবে।(ইসলামী যিন্দেগী,পৃঃ১১৩)।
হে আল্লাহ!আমাকে সহ উম্মতে মুহাম্মদী (দঃ) কে লাইলাতুল বারা’আত নসীব করে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ দান করুন।আমিন,বিহুরমাতি শাফিয়িল মুযনেবীন।
সহকারি শিক্ষক
পোয়াপাড়া সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়
কাউখালী,রাংগামাটি পার্বত্য জেলা।
পূর্ব প্রকাশিতের পর
বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ক্ষমার বিরল ইতিহাস…
মোহাম্মদ সাইদুল হক*
ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা ছিল প্রিয়নবীর (দঃ) অন্যতম মহৎ গুণ।যে গুণে কোনো ঘাটতি ছিল না।ছিল পরিপূর্ণতা।ব্যাক্তিগত কারণে বা সম্পদের জন্য রাসূল (দঃ) কখনো প্রতিশোধ নিতেন না।কিন্তু যখন বৈধ জিনিসকে অবৈধ করা হতো তখন রাসুল (দঃ) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রতিশোধ গ্রহন করতেন।তাঁর জীবনে সবচেয়ে কঠিন বিচার ছিল ওহুদ যুদ্বের বিচার।এই যুদ্বে পৌত্তলিক কুরাইশরা রাসুল (দঃ) কে আহত করে।এরপরও তিনি তাদেরকে শুধু ক্ষমাই করে দেন নি বরং তাদের জন্য দোয়া করেছেনঃ “হে আল্লাহ, তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালনা কর,তারা অজ্ঞ।” রাসূল (দঃ) যখন তাদেরকে ক্ষমা করেছেন,তখন সাহাবীগণ তাদেরকে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার জন্য বদ দু’য়া দিতে বলেন।তখন আল্লাহর রাসুল (দঃ) বলেন,” কারো প্রতি অভিশাপ দিতে আমাকে পাঠানো হয়নি বরং সারা জাহানের রহমত হিসেবে সত্য পথের দাওয়াত দিতে আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে।*
আল্লাহ হুকুমে আর অমানবিক কাফিরদের অত্যাচারে রাসুলে করীম (দঃ) যখন হিজরত করছিলেন, ঠিক তখনি সারকা বিন জাশাম ঘোড়ায় আরোহণ করে দ্রুতগতিতে রাসুল (দঃ) কে আক্রমণ করার অভিপ্রায়ে তাঁর নিকট উপস্হিত হয়,তিন তিনবার তার ঘোড়ার পা মাটিতে গেড়ে যায় এবং তিন তিনবার সে ভাগ্য গণনা করে ব্যর্থতার লক্ষণ পেয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ে; তখন সে নিরুপায় হয়ে মহানবী (দঃ)’ র নিকট নিরাপত্তার জন্য আকুতি -মিনতি জানায়।রাসুলে আকরাম (দঃ) দ্বিধাহীনচিত্তে তাকে লিখিত আশ্বাস দেন।মক্কা বিজয়ের পর প্রিয় হাবীব (দঃ) বিনা দ্বিধায় তাকে ক্ষমা করে করেন এবং হিজরতের সময়ের সেই ঘটনার কোনো উল্লেখও করেননি।
আবু সুফিয়ান বদর,ওহুদ,খন্দক প্রভৃতি যুদ্ধে প্রিয়নবীর (দঃ) বিরুদ্ধে কুরাইশদের নেতৃত্ব দিয়ে বিরাট অভিযান চালিয়েছেন।তার হীন চক্রান্তে কত শহীদের শোণিতে মক্কা নগরী রক্তে রঞ্জিত হয়েছে,কিন্তু মক্কা বিজয়ের পর রাসুল (দঃ) শুধু তাকেই ক্ষমা করেননি,তাঁর ঘরে যারা আশ্রয় নিয়েছে তাদেরকেও নিরাপদ বলে ঘোষণা করেন।
আবু সুফিয়ানেরর স্ত্রী হিন্দা হযরত হামযা (রাঃ) ‘ র কলিজাকে কেটে টুকরা টুকরা করেছিল; সেই পিশাচীকেও রাসুলে আরবী (দঃ) ক্ষমা করেছেন।তাঁর এই মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে সে উচ্চসিতকন্ঠে বলে উঠেছে ” মুহাম্মদ (দঃ) পৃথিবীতে তোমার তাঁবু অপেক্ষা অন্য কোনো তাঁবুকে আমি অধিক ঘৃণা করিনি; কিন্তু আজ তোমার তাঁবুই আমার নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয়।” হযরত হাময (রাঃ)’ র হত্যাকারী ওয়াহশী তায়েফ বিজয়ের পর ভয়ে পালিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নেই,কিন্তু রাসুল (দঃ)’ র আশ্রয়স্থল ব্যতীত তার জন্য আর কোনো নিরাপদ স্থা নেই……. সকলের নিকট এই আশ্বাস পেয়ে রাসুলের (দঃ) শরণাপন্ন হয় এবং মানবতার মুক্তির দূত মহানবী (দঃ) তাকেও ক্ষমা করে দেন।আবু জেহেলের পুত্র আকরামা তার পিতার সাথে মিলে বছরের পর বছর ধরে মুসলমানদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে।মক্কা বিজয়ের পর সেও পালিয়ে যায়; কিন্তু তার স্ত্রী রাসুলের (দঃ) মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে এবং তার স্বামীকে ফিরিয়ে এনে প্রিয়নবীর দরবারে উপস্থিত করে।রাসুলে মুখতার (দঃ) তাকে শুধু ক্ষমাই করেন নি, সে তাঁর নিকট আসলে তাকে স্বাগতম জানিয়েছেন।
নিজ কন্যার এক প্রকার হত্যাকারী হাব্বারকেও রাসুল (দঃ) অকুণ্ঠচিত্তে ক্ষমা করেন।মক্কা বিজয়ের পর সে জগণ্য দোষে দোষী সাব্যস্ত হলে তার জন্য কঠোর শাস্তি ঘোষণা করা হয়।হাব্বারের ইরান পালিয়ে যাবার ইচ্ছা ছিল,কিন্তু কিছুক্ষণ চিন্তার পর সে ইরান না গিয়ে রাসুলের (দঃ) নিকট উপস্থিত হয়ে প্রার্থনা করে, ” আপনি আমার সম্বন্ধে যা শুনেছেন তা সত্য।আমি ইরানে পালিয়ে যাবার মনস্থ করেছিলাম,কিন্তু আপনার দয়া ও মহানুভবতার কথা শুনে আপনার নিকট ক্ষমা ভিক্ষার জন্য এসেছি।” মূহুর্তে মহানবীর (দঃ) করুণার দ্বার খুলে যায় এবং তিনি এই পরম শত্রুকেও ক্ষমা করেন।
কুরাইশ সর্দার সাফওয়ান বিন উম্মিয়া আমীর বিন ওহাবকে প্ররোচিত করে তার বিষাক্ত তরবারি দ্বারা মহানবী (দঃ) কে হত্যা করার জন্য মদিনায় পাঠায়; কিন্তু আমীর ঘটনাচক্রে গ্রেপ্তার হয়ে পড়ে।মানবতার মুক্তির দিশারী প্রিয়নবী (দঃ) এই নরপিশাচকেও ক্ষমা করেন। সাফওয়ান বিন উম্মিয়া ভয়ে হজ্জে যাবার উদ্দেশ্যে জেদ্দায় পালিয়ে যায়। আমীর বিন ওহাব রাসুলের (দঃ) নিকট এসে সাফওয়ানের জন্য নিরাপত্তার প্রার্থনা জানায়। রাসুলে আরবী (দঃ) সঙ্গে সঙ্গে তার নিরাপত্তার আশ্বাস দেন,কিন্তু প্রিয়নবীর আশ্বাসের কোনো নিদর্শন না পেলে সে তাঁর দরবারে আসতে সাহস করবে না।পুনরায় রাসুলের (দঃ) নিকট এই প্রার্থনা করায় প্রিয়নবী তৎক্ষণাৎ নিদর্শন স্বরুপ তাকে নিজের আমামা (পাগড়ী) শরীফ দান করেন।
বর্তমান সময়ে গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়,কারো সাথে সামান্য বাক- বিতন্ডা হলেই বৃহদাকার ঘটনা ঘটিয়ে পেলে।শুরু হয় মারামারি, নির্যাতন, হত্যাসহ আরো কত কি।বুকে ক্ষোভ চাপিয়ে রেখে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।সুযোগ পেলে তো আর কোনো ছাড় নেই। কিছু রাজনীতিবিদ,নেতা- নেতৃরা সেই দোষ দোষী,এমনকি সাধারণ মানুষরাও।এই চরিত্র থেকে মানবজাতি যতদিন বেরিয়ে আসতে পারবে না, ততদিন পরিবার, সমাজ,রাষ্ট্র ও বিশ্বে শান্তি আসবে না।
আসুন,আমরা মানবজাতির মুক্তির দূত মহানবী (দঃ) ক্ষমার যে দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে রেখে গেছেন তা গ্রহণ করি।সুন্দর সুশৃঙ্খল বিশ্ব গড়তে এগিয়ে আসি।আর প্রিয়নবীর ক্ষমার এ বিরল ইতিহাস কিয়ামত অবধি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
★ সুরা আম্বিয়াঃ১০৭ ( সমাপ্ত)
(সহকারি শিক্ষক)
পোয়াপাড়া মডেল উচ্চ বিদ্যালয়
কাউখালী, রাঙ্গামাটি পাবর্ত্য জেলা।
—
Amen Computer & Photo Center
Mobile: 01833-061813
Kawkhali, Rangamati.
॥ নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের এ দিনে দখলদার পাকহানাদার বাহিনী ও তার দোসর রাজাকার আল-বদর, আল-শামস মিলিতভাবে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ঠিক দুই দিন পর ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বাধীন বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং বিজয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীন দেশ হিসাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বিনয় এবং শ্রদ্ধায় কাল জাতি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করবে। একই সাথে এবারও জাতির প্রত্যাশা, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যারা হত্যা করেছে তাদের মধ্যে যারা বিচার প্রক্রিয়ার বাইরে আছে অথবা পলাতক আছে তাদের বিচারের রায় কার্যকর করে দেশকে কলংকমুক্ত করা হবে। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ নানা পেশাজীবী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকালে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, দিনব্যাপী বিভিন্ন সংগঠন শহীদদের স্মরণে আলোচনা সভা, মৌন মিছিল ইত্যাদি। এছাড়াও দিবসটি উপলক্ষে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া ও প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো.আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুদ্ধিজীবীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে পৃথক বাণী দিয়েছেন।
জাতি এ বছর এমন একটি প্রেক্ষাপটে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করছে যখন একাত্তরের সেই যুদ্ধাপরাধী ও বুদ্ধিজীবী হত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত অনেকের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। মানবতাবিরোধী হত্যা মামলায় দ-িত বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দ- কার্যকর হয়েছে। জামায়াতের অপর নেতা মো. কামারুজ্জামান এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম হোতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে।
এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধকালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের নীলনকশা বাস্তবায়নকারী গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রধান ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির দন্ড কার্যকর হয়। তবে বুদ্ধিজীবী হত্যায় সরাসরি জড়িত চৌধুরী মইনুউদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান পলাতক থাকায় বিচার এখনও কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।
চৌধুরী মইনুদ্দীন যুক্তরাজ্য এবং আশরাফুজ্জামান খান যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক রয়েছে। তাদেরকে ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সন্তান আসিফ মুনীর তন্ময় বলেন, ‘আমার পিতার হত্যাকান্ড এবং তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সাথে সরাসরি জড়িত ছিল চৌধুরী মইনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান। আমার বাবার হত্যার সাথে জড়িতদের রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত আমাদের কাছে বিজয়টা অসম্পূর্ণই থেকে যায়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের আবাসিক শিক্ষক শহীদ বুদ্ধিজীবী জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার একমাত্র সন্তান মেঘনাগুহ ঠাকুরতা বলেন, ‘বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত নায়কদের শাস্তি হয়েছে তাতে আমরা অনেক খুশি। এখনো কেউ কেউ বাকি আছে। চৌধুরী মইনুউদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের দন্ড কার্যকর করা যায়নি। বিদেশ থেকে তাদের ফেরত এনে বিচার কার্যকর করতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের কাছে আমরা দাবি জানাই। তা না হলে বিজয়ের অর্জন পূর্ণাঙ্গ হবে না।’ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের এ দেশীয় দোসর আল-বদরের সাহায্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও বিভিন্ন স্থান থেকে শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, সংস্কৃতি কর্মীসহ বিভিন্ন পেশার বরেণ্য ব্যক্তিদের অপহরণ করা হয়। পরে নিদারুণ যন্ত্রণা দিয়ে রায়েরবাজার ও মিরপুরে তাদের হত্যা করা হয়। এ দু’টি স্থান এখন বধ্যভূমি হিসেবে সংরক্ষিত।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ লগ্নে ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে আল-বদর বাহিনী আরও অনেক বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে স্থাপিত আল-বদর ঘাঁটিতে নির্যাতনের পর রায়েরবাজার বধ্যভূমি ও মিরপুর কবরস্থানে নিয়ে হত্যা করে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছেনÑ অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, ডা. আলিম চৌধুরী, অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান, ড. ফজলে রাব্বী, সিরাজ উদ্দিন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, অধ্যাপক জিসি দেব, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সাংবাদিক খন্দকার আবু তাহের, নিজামউদ্দিন আহমেদ, এসএ মান্নান (লাডু ভাই), এ এন এম গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ নাজমুল হক, সেলিনা পারভিনসহ আরো অনেকে।
রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, একাত্তরে ত্রিশ লাখ শহীদের মধ্যে বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যার ঘটনা বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। তারা শহীদ হন এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসাবে। হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী তাদের পরাজয় আসন্ন জেনে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে বুদ্ধিজীবী নিধনের এই পরিকল্পনা করে।
তারা স্পষ্ট দেখে- চরম বিপর্যয় আসন্ন, পরাজয় একেবারেই সন্নিকটে- তখনই তারা সেই পরিকল্পনা কার্যকর করে। তালিকাভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের চোখ বেঁধে নিয়ে হত্যা করে। তারা স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে এভাবেই অন্ধকার করার পাঁয়তারা করেছিল।
কর্মসূচি : সকালে রাজধানীর মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে সরকারিভাবে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে দিবসের কর্মসূচি শুরু হবে।এর পরেই বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সর্বস্তরের মানুষ স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মাধ্যমে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন।
দিবসটি উপলক্ষে আওয়ামী লীগ বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন আওয়ামী লীগ প্রতিবারের মত এবারও দেশবাসীর সাথে যথাযোগ্য মর্যাদায় ও ভাবগাম্ভীর্য সহকারে এই শোকাবহ দিনটিকে স্মরণ ও পালন করবে।
এ উপলক্ষে গৃহীত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ভোরে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবন ও দেশব্যাপী সংগঠনের কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ। সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন এবং ৭টা ৪৫ মিনিটে বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন। এছাড়াও সকাল সাড়ে ৮টায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্য রয়েছে আগামীকাল সকাল ৬টা ১৫ মিনিটে উপাচার্য ভবনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান-প্রধান ভবনে কালো পতাকা উত্তোলন, সকাল সাড়ে ৬টায় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে জমায়েত এবং সকাল ৬টা ৩৫ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণস্থ কবরস্থান, জগন্নাথ হল প্রাঙ্গণস্থ স্মৃতিসৌধ ও বিভিন্ন আবাসিক এলাকার স্মৃতিসৌধে পু®পস্তবক অর্পণ, মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পু®পস্তবক অর্পণের উদ্দেশ্যে যাত্রা, বেলা ১১টায় উপাচার্যের সভাপতিত্বে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে আলোচনা সভা। বাদ জোহর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদসহ বিভিন্ন হল মসজিদ ও উপাসনালয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া করা হবে।
এছাড়াও জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদ, জাতীয় পার্টি, জাসদ, কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরাম- মুক্তিযুদ্ধ’৭১, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, উদীচী, খেলাঘরসহ বিভিন্ন সংগঠন পৃথক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আজ এক বিবৃতিতে আগামীকাল শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে সংগঠনের কেন্দ্রের ন্যায় সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ করে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের জন্য দেশের সকল শাখা আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা-কর্মী, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ী ও সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
॥ নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ নারী উন্নয়ন ও নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ৫ নারীকে বেগম রোকেয়া পদক-২০১৭ প্রদান করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পার্বত্য অঞ্চলের লেখিকা শোভা রানী ত্রিপুরা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক গ্রহণ করেছেন।
শোভা রানী ত্রিপুরা দীর্ঘ বছর ধরে পার্বত্য অঞ্চলের একজন কবি হিসাবে বিচরণ করছে। তিনি পার্বত্য অঞ্চলের প্রথম সংবাদপত্র সাপ্তাহিক বনভূমির একজন গুনী লেখিকা হিসাবে পরিচিত ছিলো। সম্পাদক এ,কে,এম মকছুদ আহমেদের অপর একটি দৈনিক পত্রিকা দৈনিক গিরিদর্পণ পত্রিকায় যার অসংখ্য লেখা ও কবিতা ছাপা হয়েছে। যার হাত ধরেই তিনি আজ পার্বত্য অঞ্চলের একজন কবি হিসাবে পরিচিত লাভ করেছেন।
২০১৭ সালের বেগম রোকেয়া পদকপ্রাপ্তরা হলেন- মুক্তিযোদ্ধা মাজেদা শওকত আলী, লেখিকা শোভা রাণী ত্রিপুরা, গ্রাম বিকাশ সহায়তা সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মাসুদা ফারুক রতœা, চিকিৎসক ব্রি.জে (অব) সুরাইয়া রহমান এবং সাংবাদিক মাহফুজা খাতুন বেবী মওদুদ (মরোণত্তর)।
শনিবার সকাল ১০টায় ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রধানমন্ত্রী এ পদক প্রদান করেন। এ সময় আলোচনা অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি।