॥ গিরিদর্পণ ডেস্ক ॥ বিজিবি’র মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন বলেছেন, মিয়ানমার আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্তের জিরো পয়েন্টে সেনা সমাবেশ করছে। আমরা পতাকা বৈঠক করে তাদেরকে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে তোমরা আমাদেরকে না জানিয়ে সীমান্তে সেনা সমাবেশ করতে পারো না। সীমান্তে গোলাগুলিও করতে পারো না। এ বিষয়গুলো নিয়ে তোমরা অবশ্যয় সতর্ক থাকবে। একটি দেশের প্রতি আরেকটি দেশের উসকানিমূলক আচরণ শোভনীয় নয়।
শুক্রবার রাত ৮টার দিকে যশোরের শার্শা উপজেলার শালকোনায় কম্পোজিট বিওপি খেলার মাঠ ও অডিটোরিয়াম উদ্বোধন ও ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। এসময় তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ২০৪১ সালে উন্নত সমৃদ্ধশালী দেশে রূপান্তরিত হবে। সেই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী যেমন হওয়া উচিত সে আদলে আমরা বিজিবিকে সাজাচ্ছি। আমরা সীমান্তে সবসময় সতর্ক অবস্থায় থাকি।’
বিজিবির মহাপরিচালক আরও বলেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের আদলে আমাদের বর্ডার সুরক্ষার জন্য সার্ভিলেন্স সিস্টেম এবং স্মার্ট বর্ডার ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থা করছি। সীমান্তে সিসি ক্যামেরা, সার্চ লাইট ও ড্রোন ব্যবহার করা হবে।’ অচিরেই সীমান্ত সড়ক তৈরি করা হবে বলে জানান তিনি।
দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের রিজিওন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার খালিদ আল মানুন বলেন, ‘মিয়ানমার সীমান্তে সেনা সমাবেশ করেছেন তবে যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে আমরা প্রস্তুত আছি।’
পরে বিজিবি অডিটোরিয়ামে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এসময় মহাপরিচালকের সাথে উপস্থিত ছিলেন, উপ-পরিচালক ব্রিগেডিয়ার আনিছুর রহমান, দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের রিজিওন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার খালিদ আল মানুন, সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তৌহিদুল ইসলাম ও ৪৯ বিজিবি’র কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল আরিফুল হক।
॥ গিরিদর্পণ ডেস্ক ॥ বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্তের ওপারে দেড়শ গজের কাছে মিয়ানমার তমব্রু সীমান্তে অতিরিক্ত সেনা ও ভারি অস্ত্রশস্ত্র মোতায়েন করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এতে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মিয়ানমার সীমান্ত এলাকা। এ ঘটনায় আতঙ্ক দেখা দিয়েছে রোহিঙ্গাসহ সীমান্ত অঞ্চলের বসবাসরত বাসিন্দাদের মধ্যে। তবে সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করেছে বিজিবি।
জানা গেছে, বৃস্পতিবার (১ মার্চ) সন্ধ্যায় নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের কোনাপাড়া নোম্যান্স ল্যান্ডের ওপারে মিয়ানমার অতিরিক্ত সীমান্তরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করেছে। সকাল থেকে কয়েকটি ট্রাক এবং মোটরসাইকেলযোগে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবস্থান নিয়েছে। মাইকিং করে রোহিঙ্গাদের নোম্যান্স ল্যান্ড থেকে চলে যেতে হুমকি ধমকি দিচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইটপাটকেল ছুঁড়ে মারছে।
এতে আতঙ্কে নোম্যান্স ল্যান্ডের রোহিঙ্গারা চিৎকার হৈ হুল্লর করে বাংলাদেশে ঢোকার জন্য কয়েকটি স্থানে জড়ো হয়। খবর পেয়ে সীমান্তের তুমব্রু পয়েন্টে বিজিবি টহল জোরদার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবি। অতিরিক্ত সদস্যও মোতায়েন করা হয়েছে সীমান্ত এলাকায়।
এদিকে, শুক্রবার (২ মার্চ) সকালে ফের তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমার সেনারা ফাঁকা গুলি ছুড়েছে বলে জানা গেছে। এতে সীমান্ত এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি)। ইতিমধ্যে পতাকা বৈঠকেরও আহ্বান জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে বিজিবি ও স্থানীয়রা জানায়, জেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তমব্রু কোনাপাড়া সীমান্তে গুলি ছুড়েছে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী। সীমান্তের নোম্যান্সল্যান্ডে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ভয়ভীতি দেখাতে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। ফলে সীমান্তে নতুন উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন বিজিবি সদস্যরাও।
এ ব্যাপারে বিজিবি ও স্থানীয়রা জানায়, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু কোনাপাড়া সীমান্তে গুলি ছুড়েছে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী। সীমান্তের নোম্যান্সল্যান্ডে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ভয়ভীতি দেখাতে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এ ঘটনায় আতঙ্ক দেখা দিয়েছে রোহিঙ্গাসহ সীমান্ত অঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে। সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করেছে বিজিবি।
॥ গিরিদর্পণ ডেস্ক ॥ বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তমব্রু সীমান্তে নিজেদের অংশে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য বাড়তি সেনা মোতায়েন করেছে বলে জানিয়েছে মিয়ানমার। একই কারণে তারা সীমান্ত এলাকায় ফাঁকা গুলি ছুড়েছিল বলেও দাবি করেছে। সীমান্তের জিরো লাইনে অবস্থানকারী প্রায় সাড়ে ছয় হাজার রোহিঙ্গাকে যে কোন সময় ফেরত নিতে রাজি হয়েছে মিয়ানমার। তবে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি, মাইকিং ও অন্যান্য তৎপরতাকে তাদের নিয়মিত নিরাপত্তা কার্যক্রম বলে জানিয়েছেন সেই দেশের প্রতিনিধিরা।
শুক্রবার (২ মার্চ) বিকাল ৩টার দিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তে ঢেঁকুবুনিয়ার ২২নং পিলারের কাছে পতাকা বৈঠকে বসে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। বিকাল ৪টা ৪০ মিনিটের দিকে বৈঠক শেষ হলে সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য জানান ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান।
পতাকা বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেন মঞ্জুরুল হাসান খান ও মিয়ানমারের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেন দেশটির সীমান্ত পুলিশের লেফটেন্যান্ট সোয়োজাই লিউ। এতে বিজিবির পক্ষে সাত সদস্যের একটি দল অংশ নিয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে বিজিবির একটি সূত্র।
বৈঠক থেকে ফিরে কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি’র কমান্ডার লে. কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান আরো জানান, বৃহষ্পতিবার রাতে রোহিঙ্গাদের ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনা অস্বীকার করেছেন মিয়ানমারের কর্মকর্তারা। জিরো লাইনে অবস্থানকারীদের ঠিক কবে থেকে ফেরত নেওয়া হবে তা অবশ্য নিশ্চিত করে বলেননি তাঁরা।
মঞ্জুরুল হাসান খান বলেন, ‘মিয়ানমার সীমান্ত পুলিশ আরও জানিয়েছে, ভবিষ্যতে সীমান্ত এলাকায় ফাঁকা গুলির আগে বাংলাদেশকে অবহিত করবে।’ সীমান্ত এলাকার পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক আছে। শূন্যরেখায় থাকা রোহিঙ্গারাও ভালো আছে।
তিনি আরও বলেন, ‘মিয়ানমার সীমান্ত পুলিশ বিজিবির কাছে প্রশ্ন করে, সীমান্তে বাংলাদেশ কেন সিসি ক্যামেরা স্থাপন করেছে। জবাবে আমরা জানাই, এটা মিয়ানমারকে টার্গেট করে করা হয়নি, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্যই আমরা এটা করেছি।’
এদিকে বৈঠকের এই সিদ্ধান্ত প্রকাশ হবার পর সেখানকার রোহিঙ্গাদের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গা আবু সালাম জানান, ফিরে যেতে বাধ্য হলে তারা নিশ্চিতই মিয়ানমার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের শিকার হবেন। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ কেউই মিয়ানমারে ফেরত যেতে রাজি নয় বলে জানান আরেক রোহিঙ্গা মোঃ আসগর। তিনি বলেন, মিয়ানমারে আমরা মোটেও নিরাপদ নই। আমরা বাংলাদেশের ক্যাম্পে থাকতে চাই।
এর আগে শুক্রবার সকালে বান্দরবান উপজলার ঘুমধুমের তমব্রু সীমান্তে নো-ম্যানস ল্যান্ড এলাকা পরিদর্শন করেছেন বান্দরবান জেলা প্রশাসক দীলিপ কুমার বণিক, ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান, বান্দরবান লামা উপজেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আব্দুস সালাম, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এন সরয়ার কামাল প্রমুখ।
বৃহস্পতিবার (১ মার্চ) মিয়ানমার সীমান্তে অতিরিক্ত সৈন্য সমাবেশ করার প্রতিবাদ জানায় বিজিবি। এসময় পতাকা বৈঠকের আহ্বান করা হয় বিজিবির পক্ষ থেকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শুক্রবার পতাকা বৈঠকে অংশ নিতে রাজি হলো মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)। এর আগে একাধিকবার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পতাকা বৈঠকের আহ্বান জানানো হলেও তাতে রাজি হয়নি মিয়ানমার।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সীমান্তে হঠাৎ করেই অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করে মিয়ানমার। সামরিক পিকআপ, ট্রাক ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিপুল সংখ্যক বিজিপি সদস্য শূন্য রেখা থেকে প্রায় দেড়শ গজ ভেতরে অবস্থান নেয়। শুক্রবার (২ মার্চ) সকালে ফের তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমার সেনারা ফাঁকা গুলি ছুড়ে আতংক সৃষ্টি করে। এতে আতঙ্ক দেখা দেয় রোহিঙ্গাসহ সীমান্ত অঞ্চলের বসবাসরত বাসিন্দাদের মধ্যে। তবে সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করে বিজিবি। এ পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত লুইন উ’কে তলব করে তাকে একটি নোট ভারবাল বা আনুষ্ঠানিক পত্র দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
একটি সূত্র জানায়, রাখাইনে সামরিক শক্তি বাড়ালে নো-ম্যানস ল্যান্ডে যে ছয় হাজার রোহিঙ্গা আছে তারা মিয়ানমারে ফেরত যেতে আগ্রহী হবে না এবং রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর পুরো প্রক্রিয়াটি অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে।
॥ গিরিদর্পণ ডেস্ক ॥ বাংলাদেশে আসন্ন ঘূর্ণিঝড় মৌসুম এবং মিয়ানমারে চলমান সহিংসতা ও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার হুমকিতে থাকা ৭ লাখ ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা শিশুকে সহায়তা করতে জরুরি উদ্যোগ প্রয়োজন বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাম্প্রতিক ঢল শুরুর ছয় মাসপূর্তিতে শুক্রবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ইউনিসেফ বলেছে, আসন্ন ঘূর্ণিঝড় মৌসুমে সৃষ্ট বন্যায় জরাজীর্ণ ও অস্বাস্থ্যকর রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো প্লাবিত হতে পারে। আর তেমনটা হলে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়ে যাবে। এতে ক্লিনিক, শিশু-শিক্ষাকেন্দ্র ও শিশুদের জন্য চালু করা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানাদি বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আনুমানিক ১ লাখ ৮৫ হাজার রোহিঙ্গা শিশু মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রয়ে গেছে, যারা সহিংসতার ভীতি ও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। এমন পরিস্থিতির কারণেই তাদের অনেক আত্মীয় ও প্রতিবেশী সেখান থেকে পালিয়ে গেছে। বাংলাদেশে আনুমানিক প্রায় ৫ লাখ ৩৪ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশু রয়েছে, যারা গত বছর ও তার আগে বাংলাদেশমুখী রোহিঙ্গা-¯্রােতের সঙ্গে চলে আসে।
জাতিসংঘের শিশু ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের জরুরি কর্মসূচির পরিচালক ম্যানুয়েল ফন্টেইন বলেন, ‘প্রায় ৭ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু মূলত আটকা পড়েছে! হয় তারা সহিংসতার কারণে কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে অথবা মিয়ানমারের ভেতরেই বাসস্থান পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছে অথবা দেশে ফিরতে না পারায় বাংলাদেশের জনাকীর্ণ ক্যাম্পগুলোতে আটকা পড়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এটা এমন এক সংকট, যার কোনো ত্বরিত সমাধান নেই এবং মূল কারণ নিরসনে সমন্বিত প্রচেষ্টা না নেয়া হলে এর সমাধানে বেশ কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।’
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নিজেদের ঘর-বাড়ি ও সমাজ থেকে বিতাড়িত হওয়া রোহিঙ্গারা এখন ভাসমান সম্প্রদায়ের মানুষ। স্বাস্থ্য ও জীবন নিয়ে নতুন করে হুমকির মুখোমুখি হওয়া এই মানুষগুলো তাদের মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চলাফেরার স্বাধীনতার ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ, খুবই সীমিত আকারের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও জীবিকার সুযোগ এবং মানবিক সহায়তার ওপর তাদের ক্রমাগত নির্ভরশীল হয়ে পড়ার মতো বিষয়গুলো উল্লেখ করে রাখাইনে সহিসংতা বন্ধে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইউনিসেফ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করা হলে তা শরণার্থীদের জন্য মিয়ানমারে তাদের আগের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
নিরাপত্তা ও সুরক্ষার নিশ্চয়তা, নাগরিকত্ব, ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর সুযোগসহ একটি সুন্দর ভবিষ্যতের সুযোগ না পাওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গারা বাড়ি ফিরে যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন ম্যানুয়েল ফন্টেইন।
২০১৭ সালের আগস্ট থেকে রাখাইন রাজ্যের অনেক অংশে প্রবেশাধিকার না থাকায় ইউনিসেফ ও অন্য মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়।
ইউনিসেফ বলছে, অবিলম্বে এবং নির্বিঘেœ এই সব শিশুর কাছে পৌঁছার সুযোগ দেয়া অপরিহার্য। একইসঙ্গে আন্তঃসাম্প্রদায়িক উদ্বেগ চিহ্নিত করতে এবং সামাজিক সহাবস্থানের বিষয়টি তুলে ধরতে দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টাও অপরিহার্য।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সরকারের নেতৃত্বে ও নজরদারিতে সহায়তা প্রচেষ্টার মাধ্যমে বিপর্যয় এড়ানো গেছে, যেখানে স্থানীয় অধিবাসীরা ৭৯ হাজার রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। ইউনিসেফ পানির কূপ খনন, কয়েক হাজার ল্যাট্রিন স্থাপন এবং শিশুদের কলেরা, হাম ও অন্যান্য রোগ থেকে রক্ষা করতে টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনায় সহায়তা প্রদানে ব্যাপক আন্তর্জাতিক উদ্যোগের অংশ হয়েছে।
সচিবালয়ে দুই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের বৈঠক হয়।
বৈঠক শেষে আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, ১১ লাখ মিয়ানমার নাগরিকের তালিকা করা হয়েছে।
“বৈঠকে তাদের কাছে এক হাজার ৬৭৩টি রোহিঙ্গা পরিবারের আট হাজার ৩২ জনের তালিকা দিয়েছি।”
এদের ফিরিয়ে নেওয়ার আগে তাদের পরিচয় যাচাই করার কথা মিয়ানমারের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন বলে জানান তিনি।
দুই দেশের সীমান্তের ‘শূন্য রেখায়’ অবস্থানরত ছয় হাজারের বেশি রোহিঙ্গা যাতে তাদের এলাকায় ফিরে যেতে পারেন সে বিষয়ে আলোচনার জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক সেদেশে যাবেন বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কয়েক দশক ধরে মিয়ানমারে জাতিগত নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গাদের ওপর গত ২৫ অগাস্ট নতুন করে সেনাবাহিনীর দমন অভিযান শুরু হলে ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে শুরু করে তারা। এই কয় মাসে সাত লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। আগে বিভিন্ন সময়ে আসা আরও চার লাখের মতো রোহিঙ্গার ভার বহন করছে বাংলাদেশ।
এই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য গত ২৩ নভেম্বর মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্মতিপত্র সই হয়। এর ভিত্তিতে দুই দেশ যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করে এবং ১৬ জানুয়ারি ওই গ্রুপের প্রথম বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিভিন্ন বিষয় ঠিক করে ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ স্বাক্ষরিত হয়।
জানুয়ারির শেষ দিকেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা পিছিয়ে যায়।
মিয়ানমারে মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা লির মতে, অপরাধ সংঘটনে সহযোগিতা বা তা রোধে কিছু না করার জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করা যায়।
যুক্তরাজ্যের সম্প্রচারমাধ্যম চ্যানেল ফোরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে একথা বলেছেন ইয়াংহি লি। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর যা হয়েছে, তা কোনো জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্যবস্তু করে নিপীড়ন চালানো- একথার সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেন তিনি।
সেখানে কি রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নিধনের চেষ্টায় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে কি না সে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “একদম।”
“গণহত্যা নিরূপনে আইনিভাবে নির্ভূল হতে হবে এবং এটা একটা আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হতে হবে। তাই আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, সেখানে গণহত্যার বৈশিষ্ট্য রয়েছে।”
রাখাইনে যে কয়জন রোহিঙ্গা নিহতের খবর প্রকাশ হয়েছে তার চেয়ে এই সংখ্যা অনেক বেশি বলে মনে করেন ইয়াংহি লি।
“সেখানে আরও গণকবর পাওয়া যাবে তা তাড়াতাড়ি বা পরে হোক না কেন। কারণ সেখানে এরকম কিছু ঘটেছে বলে আমার কাছে খবর এসেছে।”
বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ওপর সমীক্ষার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক চিকিৎসা বিষয়ক দাতব্য সংস্থা মিতসঁ সঁ ফ্রঁতিয়ে (এমএসএফ) বলেছে, মিয়ানমারে ২৫ অগাস্ট সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর একমাসেই অন্তত ৬ হাজার ৭০০ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে।
এ বিষয়ে সু চির অবস্থান নিয়ে তার মনোভাব জানতে চাইলে লি বলেন, “হয় তিনি বিষয়টি অস্বীকার করছেন অথবা প্রকৃত ঘটনা থেকে তিনি অনেক দূরে আছেন।”
॥ মুহাম্মদ জুবাইর, টেকনাফ ॥ টেকনাফের গহীন পাহাড়ে পুলিশ সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গা ডাকাতের আস্তানা থেকে অপহৃত এক যুবককে উদ্ধার করেছে। এসময় ডাকাতদলের সাথে পুলিশের অর্ধশতাধিক রাউন্ড গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ ডাকাতদলের আস্তানা থেকে দু’টি এলজি, ৫ রাউন্ড কার্টুজ ও ৬ টি কিরিচ উদ্ধার করে।
১১ ফেব্রুয়ারি রবিবার সকাল ১০ টা থেকে টেকনাফ থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ মাঈন উদ্দিন খাঁন ও পরিদর্শক (তদন্ত) শেখ আশরাফুজ্জামানের নেতৃত্বে পুলিশের ৩ টি দল টেকনাফের নেটং পাহাড়ের গভীরে অভিযানের এক পর্যায়ে বিকাল ৩ টার দিকে অপহৃত যুবক জালাল আহমদকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এসময় স্থানীয় শত শত জনতা পুলিশকে সহায়তা করে। অপহৃত জালাল আহমদ (২২) টেকনাফ পৌরসভার নাইট্যংপাড়া এলাকার জহির আহমদের ছেলে। গত শুক্রবার রাত ১০ টার দিকে রোহিঙ্গা ডাকাত আব্দুল হাকিমের নেতৃত্বে স্বশস্ত্র ডাকাতদল নিজ বাড়ী থেকে তাকে অপহরণ করে গহীন পাহাড়ে নিয়ে যায়।
টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ মাঈন উদ্দিন খান জানান, দূর্গম পাহাড়ে জীবনবাজি রেখে পুলিশ অপহৃত যুবককে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। অভিযানে পুলিশ ও ব্যাটালিয়ন আনসারের ৩৯ সদস্য ৩ টি দলে বিভক্ত হয়ে এ অভিযান পরিচালনা করে। একপর্যায়ে ডাকাতদলের সাথে মুখোমুখি হলে ডাকাতদল পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষন করলে পুলিশও পাল্টা ৪৯ রাউন্ড গুলি বর্ষন করে। অভিযানে এক এসআইসহ ৩ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে। আহত পুলিশ সদস্যরা হচ্ছে টেকনাফ থানার এসআই মহির খান, কনস্টেবল রফিক ও রশিদ। তিনি আরো জানান, অভিযানটি পাহাড়ের দুর্গম এলাকায় হওয়ায় ও অপহৃতকে অক্ষতাবস্থায় উদ্ধারের কৌশল গ্রহন করায় ডাকাতদলের সদস্যরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
উদ্ধার যুবক জালাল আহমদকে টেকনাফ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসার পর একই দিন সন্ধ্যায় কক্সবাজার সদর হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। টেকনাফ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দায়িত্বরত চিকিৎসক জানান, তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
জালাল আহমদ জানায়, রোহিঙ্গা ডাকাত আবদুল হাকিমের নেতৃত্বে শুক্রবার রাতে তাকে অপহরণ করে গহীন পাহাড়ে নিয়ে হাত-পা শিকলে বেঁধে আটকে রাখে। সেখানে মুক্তিপনের জন্য তার উপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। এসময় তাকে পানি পর্যন্ত পান করতে দেয়নি তারা। তার সাথে আরো এক যুবককে সেখানে আটকে রাখা হয়েছিল। পুলিশ ও জনতা তাকে উদ্ধারে এগিয়ে গেলে ডাকাতদল উক্ত যুবকসহ পাহাড়ের গভীরে পালিয়ে যায়।
অপহৃত যুবকের পিতা জহির আহমদ জানান, ডাকাত হাকিম মোবাইলে ছেলের মুক্তির বিনিময়ে তার কাছে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা দাবী করেছিল। এঘটনায় তিনি আবদুল হাকিমকে প্রধান আসামী করে গত শনিবার টেকনাফ মডেল থানায় মামলা (নং-১৫) দায়ের করেছিলেন। এদিকে পুলিশ অপহৃতের ঘটনায় রোববার সকালে পৌরসভার জালিয়া পাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে ডাকাত দলের সহযোগী মোঃ সেলিম (৩০), আনজুমান আরা বেগম (৩২) ও রোমানা আক্তার কাজল (২২) নামে তিনজনকে আটক করেছে।
প্রসংগত এর আগেও গত ৩১ জানুয়ারী রাতে রোহিঙ্গা ডাকাত হাকিম ও তার সশস্ত্র লোকজন বাড়িতে ঢুকে নুরুল আবছার নামে এক কিশোরকে অপহরণ করে তার আস্তানায় নিয়ে যায়। এরপর ডাকাত দল তাকে তালা ও শিকল দিয়ে বেঁধে রাখে। পরের দিন আস্থানা থেকে কৌশলে পালিয়ে আসে কিশোর নুরুল আবছার। তবে এ ঘটনায় কেউ বাদী হয়ে মামলা দায়েরে সাহস করেনি।
গত এক বছর আগে নুরুল আবছারের বড় ভাই তোফাইলকেও অপহরণ করে নিয়ে গুম করে এই হাকিম ডাকাত। অদ্যবধি তার কোন খোঁজ নেই। এ সংক্রান্ত একটি মামলা কক্সবাজার আদালতে দায়ের করেছে পরিবার। এ মামলা তুলে নিতে এ পরিবারের স্বজনদের উপর একের পর এক ঘটনার জন্ম দিচ্ছে হাকিম ডাকাত এমন অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজারের টেকনাফে সাধারন মানুষের কাছে এক আতঙ্কের নাম এই রোহিঙ্গা ডাকাত আব্দুল হাকিম। এই ডাকাত মিয়ানমারের মংডু বড় ছড়া এলাকার জানে আলমের ছেলে। মাদক পাচার, অপহরণ, ডাকাতি, হত্যা, ধর্ষণ এসব যেন তার কাছে ঠুনকো বিষয়।
তার বিরুদ্ধে প্রায় এক ডজনের বেশী মামলা রয়েছে। বছর খানেক আগে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের সদর ইউনিয়নের সভাপতি সিরাজুল ইসলামকে বাড়ীতে ঢুকে হত্যাসহ একাধিক হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। ইতিমধ্যে বিজিবি, র্যাবসহ আইনশৃংখলা বাহিনী হাকিম ডাকাতের আস্তানায় একাধিক অভিযান চালিয়ে কয়েকজন সহযোগীকে অস্ত্রসহ আটক করে কারাগারে পাঠালেও এ দূর্ধর্ষ রোহিঙ্গা ডাকাত আবদুল হাকিম এখনো অধরা রয়েছে।
অর্পণা মারমা
সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে, পাহাড়ের অনেক নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তির মানবতা দেখে আমি এবং আমার মতো যারা পাহাড়ের বাইরে আছেন, তারা সবাই সত্যিই মুগ্ধ। যারা পারছেন, তাদের অনেকই সুদূর ঢাকা বা আরো দূরে থেকে তাদের সংহতি ও সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন, রাঙ্গামাটি হাসপাতালে ‘অবরুদ্ধ’ বা কারো কারো ভাষায় ‘চিকিৎসাধীন’ দুই বোনের জন্যে। অনেকে মানববন্ধন করেছেন, আবহাওয়ার বৈরিতাকে উপেক্ষা করে প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছেন, বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন, অনলাইনের যেখানে পারছেন পোস্ট দিচ্ছেন; সবই মানবতার খাতিরে।পার্বত্য অঞ্চলের অতি উঁচু পর্যায়ের বেশ কয়েকজনতো প্রায় প্রতিদিনই রাঙ্গামাটি সদর হাসপাতালের সামনে সময় কাটাচ্ছেন – শুধুমাত্র মেয়ে দুইজনের কল্যাণ্যের জন্যে, ‘নিজেদের মেয়েদের’ জন্যে।
এইসবের যে কোন একটি কাজই ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা অর্জন করার জন্যে যথেষ্ট, সেখানে অনেকেই আরো বেশি করছেন, অনেক বেশি দায়িত্ব নিচ্ছেন। আন্তরিক ধন্যবাদ সেইসব ভলান্টিয়ারদের জন্যে যারা হাসপাতালে মেয়ে দুইজনকে সঙ্গ দিচ্ছেন, তাদের সাথে রাতে ঘুমাচ্ছেন, তাদেরকে পছন্দের মুভি বা গান, ভিডিও দেখাচ্ছেন, ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করছেন। সত্যি বলতে কি, ধন্যবাদ দেয়াটা অনেক অনেক কমই হয়ে যায়। অবশ্য এর বেশি আর কীই বা বলতে পারি।
অর্থাৎ, নারীর প্রতি সংবেদনশীলতা এখনও সমাজে শ্রদ্ধেয় বরং মানবতা শুধু জীবিতই নয় বরং মানবতা প্রদর্শনকে বীরোচিত ও সম্মানিত আচার-ব্যবহার হিসেবেই গণ্য করা হচ্ছে। তবে কেন জানি, আমার ক্ষুদ্র মন তাদের এই মহান কাজগুলির মধ্যে নারীর প্রতি সংবেদনশীলতা এবং মানবতার চেয়ে অন্য কিছু খুঁজে পায়, যা আরো বেশি মাত্রায় উপস্থিত, যা মানবতাকে প্রায়ই লজ্জায় ফেলে দেয়। অবশ্য আমার এই লজ্জাজনক উপলব্ধির জন্যে যদিও আমিই দায়ী, তবুও কেন জানি মনে হয় ঐসকল মহান লোকদের নিজস্ব কার্যকলাপের একটা বিরাট ভূমিকা আছে, আমার এই উপলব্ধির পিছনে।
নিজের দোষ ধরা কঠিন বলেই, বিচারের ভারটা আমি পাঠকদের হাতেই ছেড়ে দিচ্ছি। আমি শুধু আমার এহেন ঘৃণ্য উপলব্ধির প্রেক্ষাপট তুলে ধরছি।
নিশ্চয় আমরা কেউই রাঙ্গামাটির ভুমিধ্বসের কথা ভুলে যাইনি। বিশেষ করে যারা পার্বত্য অঞ্চলের ব্যাপারে কিছুটা হলেও খোঁজ রাখেন, তাদের তো ভোলার প্রশ্নই ওঠে না। অনেকেরই ভুমিধ্বসের কথা খেয়াল থাকলেও শুধুমাত্র রাঙ্গামাটিতেই প্রায় ১২০ জন মারা গিয়েছিলেন, যার মধ্যে ৬১ জনই ছিলো পাহাড়ি- সেই তথ্য হয়ত খেয়াল নেই। রাতারাতি সহায়-সম্বল হারিয়ে, পাহাড়ি– বাঙ্গালী মিলিয়ে প্রায় হাজার দেড়েক মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে এসে উঠছিলেন। অত্যন্ত মানবেতর অবস্থায় দিন কাটাতে হয়েছিল প্রায় মাসাধিককাল। তখন এই সহায়-সম্বলহীন মানুষদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল কারা, সেটি আর সবাই ভুলে গেলেও আশ্রয়কেন্দ্রের ঐ মানুষগুলো ভোলেনি।
আমি জানি অনেক পাহাড়ি ব্যক্তিগতভাবে প্রচুর সাহায্য করেছেন এবং সাহায্য আনার জন্যেও অনেক কাজ করেছেন। তবে, আমাদেরকে যা ব্যথিত করে তা হলো, আমরা যাদেরকে নেতা হিসেবে শ্রদ্ধা করি, যাদেরকে আমাদের রীতিনীতি অনুযায়ী পূজনীয় জানি – তাদের অনেকেই ঐ সময় যথাযথ ভূমিকা রাখেননি। আজ দুইজন মারমা বোনের জন্যে চাকমা রাণীমাতার এবং অন্যান্যদের যে প্রচেষ্টা চোখে পড়ছে, তখন যদি এর ছিটেফোঁটাও থাকতো, পাহাড়ের এই পূজনীয় ব্যক্তিদের জন্যে অনেক বড় ত্যাগ স্বীকারেও অনেকে কুণ্ঠাবোধ করতো বলে মনে হয় না।
আরেকটা তথ্য এখানে না দিলেই নয়, ঐ সময় প্রায় শ’খানেক বা এর কিছু কম ভলান্টিয়ার রাত-দিন আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে কাজ করছিলো– তাদের মধ্যে অতি নগন্য কয়েকজন ছিলো পাহাড়ি, বাকি সবাই ছিল বাঙ্গালী। যাদের অনেকই ছিলো শিক্ষার্থী, এমনকি রাঙ্গামাটির বাসিন্দাও নয়– রোজার ছুটিতে বাড়িতে এসে মানব সেবার সুযোগ পেয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল বিপন্ন মানুষের পাশে।“ঈদের দিনে অন্য বন্ধুদের সাথে উৎসব উদযাপনের পরিবর্তে এরা আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ব্যস্ত সময়” কাটিয়েছে আন্তরিকতার খাতিরে। আর যাই হোক, প্রচারের জন্যে বা লোক দেখানোর জন্যে তারা কিছু করেনি- বরং সত্যিকারের মানবতার জন্যেই তারা নিবেদিত ছিল
তাই তো, শুধুমাত্র পাহাড়িদের জন্যে বৌদ্ধ বিহারে যে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছিলো, সেখানেও ঐ বাঙ্গালী ভলান্টিয়ারদের আন্তরিকতা, আগ্রহ আর প্রচেষ্টায় কখনই কোন কমতি ছিলো না। কেন জানিনা, হাজার খানেক বিপন্ন মানুষের ঐ কঠিন সময়গুলোতে আজকের দিনের এইসব ভলান্টিয়ার ও মানবতাবাদীদের এমন সরব উপস্থিতি চোখে পড়েনি। তাই স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে, তাদের মানবতাবোধ কি পক্ষপাতদুষ্ট? নাকি লোক দেখানো বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত?
কারণ যাই হোক না কেন, তাদের এই মানবতাবোধ বা ‘নারীর প্রতি সংবেদনশীলতা’ যে মানুষের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা অথবা মনুষ্যত্বের কারণে নয়, সেটা অবশ্য বুঝতে কারো দেরি হওয়ার কথা নয়। মানুষের প্রতি ভালবাসার কারণে হলে, আমরা তাদেরকে আরো অনেক ঘটনার পরপরই একই রকম সরব হতে দেখতাম। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি এই যে, এমনটা হয়নি; বরং পার্বত্য অঞ্চলের অন্য অনেক নারী নির্যাতনের ঘটনায় তারা প্রতিবাদ করেন নি।
এমনকি, কোন কোন অতি ভয়াবহ যৌন নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পরেও তাদের কোন ধরণের প্রতিবাদ বা বক্তৃতা-বিবৃতি চোখে পড়ার মতো ছিলো না। কেন জানি না, তারা মানবতাকে ভিন্ন রঙ্গে রাঙ্গিয়ে ফেলেছেন, মানবতা এখন আর তাদের কাছে দল-মত-নির্বিশেষে একই রূপে নেই। আমার মনে হয়, কয়েকটি ঘটনা আপনাদের সামনে তুলে ধরলেই বুঝতে পারবেন, এমন কথা আমি কেন বলছি।
এক কিশোরীকে প্রকাশ্যে মারধোর করে, পরে ধরে নিয়ে যৌন নির্যাতন করে এবং তা যদি মোবাইলে ধারণ করা হয়, তাহলে কি এই প্রতিবাদীদের প্রতিবাদ করার কথা নয়? এখন যদি বলি, ঐ কিশোরী একজন চাকমা, তাহলে? আর যদি বলি, তাকে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ নামের একটি ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা গহীন জঙ্গলে নিয়ে যৌন নির্যাতন করে এবং মোবাইলে ধারণ করেছে, তাহলে কি প্রতিবাদ হবে? প্রতিবাদ অবশ্য হয়েছিল; তবে, কারা করেছিলো জানেন? আজ যে সব মানবদরদী দেখছেন, উনারা নন। প্রতিবাদ করেছিল, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ; ঐ ঘটনায় পুলিশ কর্তৃক আটককৃত ‘নেতার মুক্তির দাবিতে হরতাল-অবরোধ ও বিক্ষোভ করে’।
বিশ্বাস করতে চাইবেন না, জানি। তাই অনুরোধ করবো, ২০১৬ সালের মে মাসের আয়না চাকমার ঘটনার ব্যাপারে একটু খোঁজ নেয়ার জন্যে। ঐ কিশোরীর অপরাধ- এক বাঙালি ছেলের দোকানে গিয়েছিল সে, কলেজে ভর্তির জন্য অনলাইনে আবেদন করতে। মানবতা বা যৌন নির্যাতনের সংজ্ঞা এখানে প্রযোজ্য নয়; কারণ, এখানে পাহাড়ী বীরপুরুষরা নিজেরাই জড়িত, যাদের সাত খুন সব সময়ই মাফ বিশেষ করে পাহাড়ে!
৬ষ্ঠ শ্রেনিতে পড়তো এক বাঙ্গালী দিন মজুরের মেয়ে। খাগড়াছড়ির গামারীঢালার মেয়েটি ২০১৫ সালের জানুয়ারির এক শনিবার সন্ধ্যার দিকে বাড়ির পাশে গরু আনতে গেলে এক পাহাড়ি যুবক তাকে ধর্ষণের চেষ্টার মধ্যেই মেয়েটির চিৎকারে আশে-পাশের লোকজন চলে আসে এবং আহত ও রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে। এই ঘটনার প্রতিবাদে আমি অবশ্য ঢাকায় কাউকে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়েছিল বলে শুনিনি; কোন নারীবাদী সংগঠনের সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা তো দুরের কথা।
হাসপাতালে ঐ মেয়েকে দেখতে কয়জন গিয়েছিলেন বা আদৌ গিয়েছিলেন কি না, সে প্রশ্ন নিশ্চয় এখানে অবান্তর। কোন ক্লাশ বর্জন, কালো ব্যাজ ধারণ, মানব-বন্ধন বা স্মারকলিপি পেশ করার মতো কিছু করারও প্রয়োজন কেউ সম্ভবত বোধ করেননি। হয়তবা, দিনমজুর কিংবা পাহাড়ের বাঙ্গালিদের বা যাদেরকে আমরা ‘সেটেলার’ বলে জানি তাদের জন্যে মানবতা, ‘সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট’ বা মানবাধিকারের মতো কঠিন বিষয় প্রযোজ্য নয়!
গত বছরের জানুয়ারিতে রাংগামাটিতে রীতিমত সংবাদ সম্মেলন করে, এক নির্যাতিতা জানিয়েছিলো তার উপর চালানো অন্যাচারের লোমহর্ষক ঘটনাবলী। ‘গলায় শেকল দিয়ে বেঁধে টানা প্রায় দুই মাস ধরে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছে রাঙ্গামাটির পাহাড়ি মেয়ে জোসনা চাকমার ওপর’। কারা করেছিল জানেন? আমাদের ইউপিডিএফ এর স্থানীয় যুব সমিতির কর্মীরা। ঘটনাস্থল তো এই রাঙ্গামাটিই ছিলো। তখন না ছিল কোন ভলান্টিয়ার তার পাশে, না অন্য কেউ!
পাহাড়ের বড় নেতা দূরে থাক, কোন পাতি নেতা বা নেত্রীও জোসনা চাকমার জন্যে সহানুভূতি দেখাননি। এমনকি, কোন প্রতিবাদও করেননি। মনে হয়, উনাদের প্রতিবাদের চর্চাটা অনেকটা এরকম যে, স্বগোত্রের দূর্বৃত্তরা যাই করুক না কেন, প্রতিবাদ করা যাবে না; কারণ প্রতিবাদ অপরাধ অনুযায়ী হবে না, অপরাধী অথবা নির্যাতিতার পরিচয় অনুযায়ী হবে।
খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার ক্ষেত্রলাল ত্রিপুরার মেয়ে দীপা ত্রিপুরা ভালবেসেছিলো এক বাঙ্গালিকে। পাহাড়ে এর ফলালফল কি হতে পারে সেটা জানতো বলেই, যখন সে তার ভালোবাসার মানুষটির সাথে পালাচ্ছিলো, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কিছু কর্মী তাদেরকে অপহরণ করে। পরের ঘটনাবলি পার্বত্য অঞ্চলে সংগঠিত এমন অন্যান্য ঘটনাগুলোর মতোই। ছেলেটিকে পাশের জঙ্গলে নিয়ে মারধর করা হয়। আর মেয়েটিকে শিকার হতে হয় একাধিকবার গণধর্ষণের, এমন কি তা মোবাইলে রেকর্ডও করা হয়। ঘটনাটি বেশি দিন আগের নয়, ২০১৫ সালের জুন মাসের।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতেও কোন ধরণের প্রতিবাদ করার সাহস কেউ দেখান নি। কারণ হয়তবা, পাহাড়ে নারীদের অধিকারের সংজ্ঞা ভিন্ন। আর এখানে প্রতিবাদতো করা হয় অপরাধী দেখে, অপরাধ দেখে নয়। আয়না চাকমার মতো, দিপা ত্রিপুরার পাশেও কোন ভলান্টিয়ার ছিলো না তাকে মানসিক স্বস্তি দেয়ার জন্যে; আজ যেমন আছে বিলাইছড়ির দুই নির্যাতিতা বোনের জন্যে।
সাংগঠনিকভাবে পরিচিত রেটিনা চাকমাকে বিয়ে করায় দীর্ঘ দিনের সহযোদ্ধা ও প্রথম আলোর ফটো সাংবাদিক সৈকত ভদ্র হয়ে যান প্রতিপক্ষ ‘বাঙালী’। অথচ দুজনই ছিলেন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সদস্য যারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে অত্যন্ত সোচ্চার।কিন্তু “চাকমাদের দৃষ্টিতে যা ভয়াবহ অন্যায় সেই পাহাড়ী-বাঙালী বিয়ের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল। সংগঠনের নেতারাও ‘বিশেষ স্বার্থে’ সৈকত-রেটিনার প্রেম-বিয়ে সংক্রান্ত জটিলতার সমাধানে এগিয়ে আসেনি।
এমনকি উপজাতীয় অধিকারের পক্ষে সোচ্চার জাতীয় সংবাদপত্র প্রথমআলোও তার স্টাফ ফটোগ্রাফারের কোনো অন্যায় নেই জেনেও তার পক্ষে না দাঁড়িয়ে বরং বিশেষ মহলের চাপে চাকুরিচ্যুত করেছে।”। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, স্বয়ং সৈকত ভদ্রের ভাষ্য অনুযায়ী, “একবিংশ শতাব্দীতে এসে বাংলাদেশেও মেয়েদের উপর নিলামে তোলার মত মধ্যযুগীয় বর্বরতা সংঘটিত হতে পারে সেটা জেনে আপনারা অবাক হতে পারেন।” ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫ তারিখে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলনের যদি প্রচার সীমিত হয়ে থাকে বা ২০১৫ সালের এই ঘটনা যদি আপনি না জানেন, আমি অবাক হবো না, কারণ এমন ঘটনাতো প্রচার নাও পেতে পারে !
নারীবাদী যারা আছেন, তারা তো আর কোন সংগঠনের বাইরের কেউ না, তাই কোন অজ্ঞাত কারণে কোন বিশেষ ঘটনা নিয়ে তেমন কিছু না বলাটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়।একইভাবে কোন বিশেষ ঘটনা নিয়ে সংহতি ও সহমর্মিতা প্রকাশ করা বা খুবই সরব হওয়াও স্বাভাবিক মনে হতেই পারে, কারো কারো বিশেষ বিবেচনায়।
বান্দরবানের রোয়াংছড়ির ১১ পাহাড়ী মারমা কিশোরীর মিয়ানমারে পাচারের ঘটনায় কয়জন ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলো, মনে পড়ে না। সোশ্যাল মিডিয়াতে এ নিয়ে আদৌ কোন প্রতিবাদ বা পোস্ট ছিলো কিনা, সেটি নিয়েই আমার সন্দেহ আছে। অথচ, একজন বা দু’জন নয়, ১১ জন ‘শিশু কন্যাকে ধর্ষণের আলামত সংগ্রহ ও স্বাস্থ্যপরীক্ষা’ করতে বান্দরবান সদর হাসপাতালে ৫ সদস্যের মেডিকেল টিম কাজ করেছিলো। ভয়াবহ বিষয় হলো, “উদ্ধারকৃত পাচার হওয়া ১১ মারমা কিশোরী পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, প্রতিদিন বৌদ্ধ ভিক্ষু উসিরি তাদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করতো।” তাদের মধ্যে কমপক্ষে দুজনকে দুপাশে নিয়ে বিছানায় যেতো।
কিন্তু, ঢাকার রাজপথে কয়জন মানববন্ধন করেছিলো বা বিবৃতি দিয়েছিলো? কয়টি জাতীয় দৈনিক এই সংবাদটিকে গুরুত্ব সহকারে ছেপেছিলো? রাজশাহী বা চট্টগ্রামে কি কেউ কোন প্রতিবাদের আয়োজন করেছিলো? পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে কাজ করেন এমন কয়জন বুদ্ধিজীবী এই ঘটনায় শাহবাগে গিয়ে অবস্থান ধর্মঘট করেছিলেন বা বিবৃতি দিয়েছিলেন? যেহেতু এই ঘটনায় আটক করা হয়েছিলো একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুসহ ২ পাচারকারীকে, তাই তথাকথিত অনেক প্রতিবাদী, নারীবাদী বা বুদ্ধিজীবীগণ প্রতিবাদের প্রয়োজন মনে করেননি বোধ হয়। যেভাবে দুই মারমা বোনের জন্যে প্রচার হয়েছে আর আমরা প্রতিবাদে এগিয়ে এসেছি, ঐ ১১ জনের জন্যে তা হয়নি আর আমরাও কিন্তু প্রতিবাদে এগিয়ে আসিনি। কারণ কি হতে পারে, তা নির্ণয়ের ভার পাঠকের হাতেই ছেড়ে দেয়া ছাড়া আমার কোন উপায় আসলেই নেই।
তাই মনে হচ্ছে, বিলাইছড়ির ঘটনা নিয়ে যত প্রতিবাদ, সংবাদ সম্মেলন, সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট, মানববন্ধন আর প্ল্যাকার্ডের ছবি দেখছি তার সবই করা হচ্ছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে, শুধুমাত্র বিশেষ কাউকে ছোট করার জন্যে; নির্যাতিতার প্রতি প্রকৃত দরদ বা নারীর প্রতি আন্তরিকতা থেকে নয়। আর এজন্যেই যখন সংবাদ পাই যে, ‘বিলাইছড়িতে নির্যাতিতা দুই কিশোরীর শরীরে শুক্রানুর আলামত পাওয়া যায়নি’– তখন নারীর প্রতি সংবেদনশীলতা ও মানবতার কারনে পাহাড়ের যে পূজনীয় ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভক্তিতে মাথা নোয়াতাম তাদের প্রতি ঘৃণা জন্ম হয় মনের গভীরে।
ভাবতে কস্ট হয় যে, দুইজন অসহায় মেয়ের কষ্ট আর বিশ্বাস উনারা কত সহজে নিজেদের স্বার্থে অপব্যবহার করলেন। মাটিরাঙ্গার কুলসুম আকতার, আলীকদমের সেলতিপাড়ার পাখি আক্তার, মহালছড়ির মাইসছড়ি এলাকায় শাহদা বেগম কিংবা খাগড়াছড়ির আলুটিলাস্থ ইমাং রেস্টুরেন্টে গণধর্ষণের শিকার হওয়া জান্নাতুল ফেরদৌসদের মতো অনেক লোমহর্ষক আর ভয়াবহ ঘটনাগুলো লোকচক্ষুর অন্তরালে হারিয়ে গেছে।
আমি জানি, যে ঘটনাগুলো আমি তুলে ধরেছি, এর বাইরেও এমন অনেক অনেক ঘটনা আছে। সেগুলোর বেশিরভাগই পাঠককুলের অজ্ঞাত। কারণ, স্বগোত্রের দূর্বৃত্ররা নারীর প্রতি কোন অন্যায় করলে, ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়; ধর্ষকের বিচার চেয়ে কোন আন্দোলন হয় না, কোনো মিছিল হয় না, পত্রিকার পাতায়ও কোনো খবর হয় না।
যেহেতু পাহাড়ের বেশিরভাগ সংবাদপত্রের স্থানীয় প্রতিনিধি পাহাড়ি, তাই তাদের বিবেচনায় হয়ত এ ধরনের ঘটনা সংবাদ হওয়ারও যোগ্যতা রাখে না। কারণ, হয় এই ঘটনাগুলোর শিকার মেয়েরা বাঙ্গালির সাথে প্রেমের মতো ঘৃণ্য অপরাধ করেছে, নয়তো পার্বত্য অঞ্চলের বাঙালিদের এই ঘটনাগুলোর সাথে কোন সংশ্লিষ্টতা নেই বরং পাহাড়ের উপজাতি সন্ত্রাসিরাই এগুলো ঘটিয়েছে। এমনকি এটা যদি পার্বত্য অঞ্চলের স্থানীয় কোন বিশেষ বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত কোন অপরাধ হতো, তাহলেতো এটা নিয়ে কোন নিউজ করারও হয়ত অনেকে সাহস করতো না। যেমনটি হয়েছে, রেটিনা চাকমা, আয়না চাকমা, দিপা ত্রিপুরা বা জোছনা চাকমার ক্ষেত্রে।
লেখিকা রোকেয়া লিটার ডুমুরের ফুল নামক অভিজ্ঞতা লব্ধ গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি, কোনো পাহাড়ী ছেলে যখন কোনো পাহাড়ী মেয়েকে ধর্ষণ করে তখন তথাকথিত প্রথাগত বিচারের নামে দোষী সাব্যস্ত হলে ওই পাহাড়ী ছেলেকে একটি শুকর জরিমানা করে স্থানীয় হেডম্যান/কার্বারীরা। জরিমানাকৃত শুকর জবাই করে তার রক্ত পাড়াময় ছিটিয়ে পাড়া পবিত্র করা হয় এবং জবাইকৃত শুকরের মাংস রান্না করে পাড়ার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের খাওয়ানো হয়। এতে ধর্ষিতা মেয়েটি কি পায় বা তার নারীত্বের যে অসম্মান করা হয় সে বিষয়ে প্রথাগত বিচারের প্রণেতা ও সর্বময় কর্তা রাজা বা রাণীরা কি কখনো ভেবে দেখেছেন? বরং ধর্ষিতা নারী বা তার পরিবার যদি এই বিচারে সন্তষ্ট না হয়ে রাষ্ট্রীয় আইনের আশ্রয় নিতে চান তাদেরও নিবৃত করা হয় এই প্রথাগত বিচারের কথা বলেই। নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা পাহাড়ের শত শত এনজিওগুলোও কোনোদিন এদিকে নজর দেননি।
বিলাইছড়িতে সেদিন আসলে কী ঘটেছিলো সেটা সময় হলে সবাই জানতে পারবে- তবে এখন পর্যন্ত অন্তত একটা বিষয় পরিস্কার হয়ে গেছে; তা হলো, পাহাড়ে যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নারীর প্রতি সহিংসতা কিংবা একই ধরণের কিন্তু আরো অনেক জঘন্য ও ভয়াবহ ঘটনার পরেও অনেক নেতা-নেত্রী ও ভলন্টিয়ারদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোন প্রতিবাদ, সংবাদ সম্মেলন বা হাসপাতালে ছুটোছুটি করতে দেখা যায়নি। সেখানে বিলাইছাড়ির দুই মারমা বোনের জন্যে উনাদের দৌঁড়াদৌঁড়ি আর যাই হোক আন্তরিকতাপ্রসূত হতে পারে না, মানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণে হতে পারে না। এই মায়াকান্নার মুখোশের আড়ালে, কী লূকানো আছে, সেটি উন্মোচিত হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
আন্তরিকতার পরিবর্তে পক্ষপাতদুষ্ট, লোকদেখানো বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বিশেষ বিশেষ ঘটনায় অন্যদের উত্তেজিত করার চেষ্টাতে আর যাই হোক, ফায়দা হবে না। এসব করে, সরল পাহাড়িদের বেশিদিন বোকা বানানো সম্ভব হবে না। বরং সকলের সামনে মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যাবে– সবাই বুঝে যাবে যে, মানবতা নয় বরং অন্য কিছুই এখানে মুল নিয়ামক, যার কারণে আপনি শুধুমাত্র নির্বাচিত কয়েকটা ঘটনার প্রতিবাদে এতটা সরব, এতই উচ্চকণ্ঠী।
তাই আসুন, পাহাড়ি রঙ্গে না রাঙ্গিয়ে মানবতাকে তার প্রকৃত রঙ্গে বিকশিত হতে সাহায্য করি। রাজনীতির স্বার্থে মানবদরদী না হয়ে, একজন মানুষ হিসেবে দল-মত নির্বিশেষে প্রকৃত মানবদরদী হতে চেষ্টা করি। নারীর প্রতি সংবেদনশীলতার মত একটা স্বর্গীয় বিষয়কে ব্যক্তিস্বার্থে অপব্যবহার না করে সকল নির্যাতিতার প্রতি সমানভাবে সহানুভূতিশীল হই। প্রকৃত ঘটনা না জেনে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে ঢালাওভাবে কাউকে দোষারোপ করার পরিবর্তে, সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেই আসল অপরাধীকে ধরতে এবং তার যথোপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে।
॥ মুহাম্মদ জুবাইর,টেকনাফ ॥ মিয়ানমারের সৃষ্ট সহিংসতায় সে দেশের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মানবিক পরিস্থিতি দেখতে কক্সবাজারের টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শণ করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থার বিশেষ দূত ইয়াং হি লি। শনিবার (২০ জানুয়ারি) সকাল ৯টার দিকে তিনি টেকনাফের দমদমিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প আসেন এবং পরিদর্শন করেন। এরপর তিনি টেকনাফ নেচার পার্কের অভ্যার্থনা কেন্দ্রে পালিয়ে আসা মিয়ানমারের ১০ পুরুষ ও ১০ জন নারীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন। এ সময় রোহিঙ্গারা তাদের ওপর নির্যাতনের কথা বর্ণনা করেন। সফর কালে তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) ও ক্যাম্পে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার কর্তকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এরপর বেলা ১২টার দিকে নয়াপাড়া নিবন্ধিত ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন এবং সেখানেও পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের কথা শুনেন। এসময় রোহিঙ্গারা ব্যানার ফেস্টুনে ‘স্বদেশে ফেরত যেতে হলে মিয়ানমারে নির্যাতন বন্ধ করতে হবে, মিয়ানমার কারাগারে থাকা রোহিঙ্গাদের মুক্তি দিতে হবে, নিজেদের পুরান বসত-ভিটায় থাকতে দিতে হবে, চাকরি ও ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে সমান নাগরিক সুযোগ-সুবিধা এবং স্বাধীনভাবে ধর্ম-কর্ম পালনের সুযোগ দিতে হবে’ দাবীগুলো তুলে ধরেন।
এই দলের একজন রোহিঙ্গা মোহাম্মদ রফিক (৩০) বলেন, উক্ত দাবীগুলো মেনে নিলে আমরা ফিরে যেতে চায়।
এরপর বিকালে তিনি হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উনছিপ্রাংয়ের রইক্ষ্যংস্থ পুটিঁবনিয়া ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। সেখানে কর্মরত এনজিও সমুহের কাজেরমান পর্যবেক্ষণ করে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মতামত গ্রহণসহ বিশেষ বৈঠক করেন। তিনি বিভিন্ন ক্যাম্প পরিদর্শনকালে মিয়ানমারে ফেরত যাবে কিনা এবং কোন কোন পদক্ষেপ নিলে তারা ফেরত যাবে সে বিষয়েও জানতে চান।
এরপর সন্ধ্যায় তিনি কক্সবাজারের উদ্দেশ্য ক্যাম্প ত্যাগ করেন। এসময় আর্ন্তজাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এবং বিভিন্ন দাতা সংস্থার লোকসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত, জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াং হি লি বুধবার রাতে ঢাকায় পৌছান এবং শুক্রবার দুপুরে তিনি কক্সবাজার আসেন। চলতি মাসে তার মিয়ানমার সফরের কথা থাকলেও সে দেশের নিষেধাজ্ঞার কারণে তিনি মিয়ানমারের পরিবর্তে বাংলাদেশে সফরে আসেন। এবার সাত দিনের সফরে ৫ দিন বাংলাদেশে থেকে ২৩ জানুয়ারি থাইল্যান্ড সফরে যাওয়ার কথা রয়েছে।
॥ কক্সবাজার সংবাদদাতা ॥ কক্সবাজারের টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীরদ্বীপের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ৩৭টি পরিবারের দেড় শতাধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। রবিবার (৭ জানুয়ারি) সকাল থেকে শাহপরীরদ্বীপের জালিয়াপাড়া, দক্ষিণপাড়া, পশ্চিমপাড়াসহ আরো কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে দেড় শতাধিক রোহিঙ্গা নারী পুরুষ ও শিশু ঢুকেছে। টেকনাফ উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন দেড় শতাধিক রোহিঙ্গা ঢুকেছে জানিয়ে বলেন, তাদের মানবিক সহায়তা পূর্বক নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া গতকালও শাহপরীরদ্বীপের ঘোলাচর পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশকালে ৫৪ জন রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুকে কোস্টগার্ড সদস্যরা আটক করে। পরে তাঁদের সাবরাং সেনা বাহিনীর ত্রাণ কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হোসেনে ছিদ্দিক। এদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুর কারণে সেন্টমার্টিনেও পর্যটক তুলনামূলক কমে এসেছে বলে জানা গেছে।