ভরা বর্ষায় দেড় মাসে তিন দফা পাহাড় ধ্বস : এখনো এলাকা পরিদর্শন শেষ করতে পারেনি উচ্চ পর্যায়ের জাতীয় কমিটি

॥ গিরিদর্পণ ডেস্ক ॥ ভরা বর্ষায় দেড় মাসে তিন দফা পাহাড় ধসে প্রাণহানি ঘটে গেলেও এখনও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনই শেষ করতে পারেনি করণীয় নির্ধারণে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে গঠিত ২৭ সদস্যের এই কমিটির প্রতিবেদনে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী কর্ম-পরিকল্পনার সুপারিশ থাকার কথা। কিন্তু সেই প্রতিবেদন পেতেই হয়ত বর্ষা শেষ হয়ে যাবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কমিটির প্রতিবেদনের জন্য বসে না থেকে এখনই কিছু স্বল্প মেয়াদী কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। পরে মনোযোগ দিতে হবে পাহাড়ের দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থাপনায়।
স্বল্প মেয়াদী পদক্ষেপ হিসেবে ক্ষতিগ্রস্তদের দ্রুত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি নতুন করে দুর্যোগের আগেই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারীদের সরিয়ে আনার ওপর জোর দিচ্ছেন তারা। বর্ষা এলেই প্রতিবছর ছোটবড় পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে বাংলাদেশে। তবে ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম শহরে ১২৭ জনের মৃত্যুর পর সরকার নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়।
এরপর পাহাড় কাটা বন্ধ করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও পাহাড় ধসে মৃত্যু থামেনি। চলতি বছর ১১ থেকে ১৩ জুনের ভারি বর্ষণে অন্তত ১৬০ জনের মৃত্যু হয় চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি ও মৌলভীবাজার জেলায়। এর মধ্যে রাঙ্গমাটিতেই মৃত্যু হয় ১২০ জনের। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার কক্সবাজারে পাঁচজন এবং ২১ জুন সীতাকুন্ডে পাঁচ জনের মৃত্যু হয় পাহাড় ও ভূমিধসের কারণে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল গত ১৬ জুন পাহাড় ধসের ‘ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ, সমস্যা চিহ্নিতকরণ, সম্ভাব্য করণীয় নির্ধারণ’ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করার কথা জানান। সে সময় তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে সরেজমিন পরিদর্শন শেষে এক মাসের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দেবে ওই কমিটি।
কমিটির প্রধান সত্যব্রত সাহা পরে জানিয়েছিলেন, পাহাড়ি এলাকায় পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন, গাছপালা কেটে পাহাড় ন্যাড়া করা, যত্রতত্র বসতি স্থাপন ও পুনর্বাসন, ইঞ্জিনিয়ারিং কৌশল, ভূমি ধ্বস প্রবণ পয়েন্ট চিহ্নিত করাসহ সমস্যা সমাধানে সবার সঙ্গে কথা বলে ‘যত দ্রুত সম্ভব’ প্রতিবেদন দেবেন তারা।
গত ২০ জুন আন্তঃমন্ত্রণালয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠকে জানানো হয়, এ বছরের মতো এত বৃষ্টিপাত গত ৫০ বছরে হয়নি। ফলে পাহাড় ধস এবার মারাত্মক রূপ পেয়েছে।
একটি সুষ্ঠু পাহাড় ব্যবস্থাপনা নীতিমালা প্রণয়ন ও পাহাড় ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা স্বেচ্ছাসেবক দল গঠনের উপর গুরুত্ব আরোপ করার পাশাপাশি পাহাড়ে নতুন করে বনায়নের জন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয় ওই সভায়।
কিন্তু কমিটি গঠনের পর এক মাসে মাত্র একটি জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে গেছেন সংশ্লিষ্টরা। সুপারিশসহ তাদের প্রতিবেদন দিতে এখনও অনেক কাজ বাকি।
কমিটির আহ্বায়ক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সত্যব্রত সাহা বলেন, জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে তারা রাঙ্গামাটি পরিদর্শন করেছেন। জেলা প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মত বিনিময় করেছেন।
“আমরা বান্দরবান ও কক্সবাজারেও যাব। সরেজমিনে পরিদর্শন, বিশেষজ্ঞ ও ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে মতবিনিময় করে অগাস্টের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেব। আশা করি সবার মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত তা সরকারে কাছে হস্তান্তর করা সম্ভব হবে।”
এ কর্মকর্তা আরো জানান, ২০০৭ সালেও পাহাড় ধসের একডজন কারণ চিহ্নিত করে তিন ডজন সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছিল। এ ধরনের দুর্যোগ প্রতিরোধে সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বাস্তবসম্মত প্রতিবেদন দিতে চেষ্টা করবেন তারা।
পাহাড় ধসের পর যারা আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছে তাদের তো আগের জায়গায় আর ফেরানো সম্ভব না। তাদেরকে সহায়তার বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন কাজ করছে। বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়েই আমাদের এগোতে হবে।
চট্টগ্রামে দশ বছর আগে পাহাড় ধসে শতাধিক মানুষের প্রাণহানির পর যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তার সদস্য ছিলেন চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের তৎকালীন পরিচালক জাফর আলম।
বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য পদে থাকা জাফর আলম জানান, সেই সময়ের সব সুপারিশ ছিল চট্টগ্রাম শহরকেন্দ্রিক। তা বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন বেশ কিছু পদক্ষেপও নিয়েছিল।
একটা কাজ হল, পাহাড়কে পাহাড়ের মত রাখতে হবে। এখন অগ্রাধিকার হল পাহাড়কে বাঁচাতে হবে। পাহাড়কে রক্ষা করতে পারলে মানুষও রক্ষা পাবে। এ জন্য সব উদ্যোগ নিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক মো. শহীদুল ইসলাম ১০ বছর আগেও পাহাড় ধসের কমিটিতে কাজ করেছিলেন। এবারের জাতীয় কমিটির সদস্য হিসেবেও রাঙ্গামাটি ঘুরে এসেছেন তিনি।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, পাহাড় ধসের কারণগুলো ১০ বছর ধরেই সক্রিয়। এর ফলাফল ভোগ করতে হচ্ছে এখন। বর্ষাকালে বৃষ্টি হলে সব পক্ষ তৎপরত হয়, পরে আর কেউ খোঁজ রাখে না। পাহাড় ধসের কারণে মানুষ, পরিবেশ, অবকাঠামো ও কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
এখন স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগ নিয়ে তা বাস্তবায়নে জোর দিয়ে শহীদুল ইসলাম বলেন, বর্ষা শেষ হয়ে যাচ্ছে, পাহাড় ধস অব্যাহত রয়েছে। এ অবস্থায় অগ্রাধিকার হচ্ছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের পুনর্বাসনে এখনই বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা নিতে হবে। আর যারা ঝুঁকিতে রয়েছেন তাদের যে কোনোভাবে, প্রয়োজনে জোর করেই সরিয়ে আনতে হবে, যাতে নতুন করে প্রাণহানি না ঘটে।
তিনি বলেন, দ্বিতীয় পর্বে পাহাড় ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিতে হবে। কোন কোন এলাকা ধস হয় তা চিহ্নিত করতে যথাযথ ভূতাত্ত্বিক জরিপ করে ‘পাহাড় ব্যবস্থাপনা’ গড়ে তুলতে হবে।

॥রাঙ্গামাটিতে দৈনিক গিরিদপর্ণ সম্পাদক মরহুম এ কে এম মকছুদ আহমেদের স্মরণসভা ও ইফতার মাহফিল পার্বত্য চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার পথিকৃৎ প্রয়াত একেএম মকছুদ আহমেদকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় ভুষিত করার দাবি

Archive Calendar
MonTueWedThuFriSatSun
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31