
বর্তমান সরকারের সৃষ্ট তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার ‘হাতিয়ারটি’ রাষ্ট্র ও সমাজবিরোধী তথা ভয়ংকর অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের কথা থাকলেও তা কার্যত পেশাদার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেই দেদারছে ব্যবহৃত হওয়ায় সাংবাদিক সমাজ আতংকিত। অজামিনযোগ্য ভয়ংকর এই ৫৭ ধারার প্রথম শিকার স্বনামখ্যাত সাংবাদিক প্রবীর সিকদার। ২০১৫ সালের ১০ আগষ্ট প্রবীর সিকদার তাঁর ফেইসবুক পাতায় নিজের জীবন শঙ্কার কথা জানিয়ে লিখেন,”আমি খুব স্পষ্ট করেই বলছি,নিচের ব্যক্তিবর্গ আমার জীবন শঙ্কা তথা মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকবেন – ১.এলজি আরডি মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার সোশারফ হোসেন,২. রাজাকার লুনা মুসা ওরফে ড.মুসা বিন সমসের, ৩. ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী বাচ্চু রাজাকার ওরফে মাওলানা আবুল কালাম আযাদ এবং এই তিনজনের অনুসারী-সহযোগীরা।” এই লেখার জেরে প্রবীর সিকদার ২০১৫ সালের ১৬ আগষ্ট গ্রেফতার হন। এলজিআরডি মন্ত্রীর ভাবমূর্তি ক্ষুন্নের অভিযোগ তুলে ৫৭ ধারায় প্রবীর সিকদারের বিরুদ্ধে মামলাটি করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এ্যাডভোকেট স্বপন পাল।
ফরিদপুরে শহীদ পরিবারের কৃতী সন্তান এক পা হারানো সাংবাদিক প্রবীর সিকদার গ্রেফতার হওয়ার পর সাংবাদিক সমাজ প্রতিবাদে বিক্ষোভে সোচ্চার হলে দুইদিন পর তিনি জামিনে মুক্তি পান। আমি নিজেও জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে লাগাতার ওই প্রতিবাদ বিক্ষোভ ও অনশন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করি।
উল্লেখ্য, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রবীর শিকদারের বাবাসহ পরিবারের ১৪ জন শহীদ হন। অভিযোগ আছে, ফরিদপুরের চিহ্নিত রাজাকার আলবদরদের বিরুদ্ধে জোড়ালো লেখালেখির কারণে দুস্কৃতিদের বোমার আঘাতে প্রবীর সিকদার তার একটি পা হারান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সানুগ্রহে বিদেশে গুরুতর আহত প্রবীর সিকদার চিকিৎসা নিয়ে এক পা হারিয়ে দেশে ফিরেন।
প্রবীর সিকদার গ্রেফতারের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাংবাদিক সমাজের জোর দাবী ছিল স্বাধীন সাংবাদিকতার স্বার্থে অনতিবিলম্বে এই ৫৭ ধারা প্রত্যাহার করা হোক। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই ৫৭ ধারাটি আজো প্রত্যাহার তো হয় নি বরং আরো জোরেশোরে যত্রতত্র প্রয়োগ হচ্ছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাটির অপপ্রয়োগের ফলে আপনার সহযোদ্ধা বেশিরভাগ সাংবাদিকরাই আজ বলির পাঠায় পরিণত হচ্ছেন। আপনি খবর নিয়ে জানুন অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যমে মন্ত্রী,এমপিসহ সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এমনকি ধর্মীয় অনুভূতিতে ক্রমাগত আঘাত করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারার প্রয়োগ নেই বললেই চলে। পক্ষান্তরে সাংবাদিক ও নিরীহ মানুষই ৫৭ ধারায় বেশী আক্রান্ত হচ্ছেন।
এই ৫৭ ধারার সর্বশেষ শিকার নারায়ণগঞ্জের ৬ সাংবাদিক-দৈনিক যুগের চিন্তার সম্পাদক ও প্রকাশক মোরছালিন বাবলা,ডাণ্ডিবার্তার সম্পাদক হাবিবুর রহমান বাদল, নারায়ণগঞ্জের আলোর সম্পাদক রাজু আহমেদ, প্রকাশক মোবারক হোসেন কমল,অনলাইন নারায়ণগঞ্জ বার্তার সিফাত আল লিংকন ও মাহমুদুল হাসান কচি। তবে, এই ছয় জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের হলেও এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হননি। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত অব্যহত।
ইতোমধ্যে দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও ৫৭ ধারায় সাংবাদিকদের হয়রানী করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এদের মধ্যে অনলাইন নিউজ পোর্টালের সম্পাদক রুকুনুর জামান রনি (দিনাজপুর),নির্মল বড়ুয়া(রাঙামাটি),জুঁই চাকমা (রাঙামাি), সারোয়ার আলম(কক্সবাজার) প্রমুখ সবাই বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ শেষে জামিনে আছেন।
অন্যদিকে পরিকল্পিতভাবে ফেইসবুকের মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওইসব সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারার প্রয়োগ দেখা না গেলেও সাংবাদিক ও নিরীহ রসরাজ দাসদের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারা প্রয়োগে পুলিশের তৎপরতা বেশ জোরালো। উল্লেখ্য, গত কয়েক মাস আগে বি,বাড়িয়া জেলার নাসিরনগরে জেলে পরিবারের সদস্য রসরাজ দাসের ফেইসবুক আইডি থেকে ধর্মীয় অনুভূতিতে কথিত আঘাতের অভিযোগে রসরাজ দাসকে দ্রুততম সময়ে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অথচ কয়েক সপ্তাহ আগেও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড.তুহিন মালিক সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে তার ফেইসবুকের পাতায় কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য পোষ্ট করার পরও আইন প্রয়োগকারীর সংস্থার নীরবতা লক্ষ্য করেছি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশে আইনের অপপ্রয়োগ নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে একসময় বিশেষ ক্ষমতা আইন চালু ছিল। দুস্কৃতিদের জন্য বঙ্গবন্ধু ওই আইনটি জারি করেছিলেন। কিন্তু ৭৫ পরবর্তীকালে সেই বিশেষ ক্ষমতা আইনের বেশী বলি হয়েছিলেন আপনার আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরাই।
আজ যাদের ৫৭ ধারার ভয় দেখানো হচ্ছে তারা সবাই কিন্তু আপনার শত্রু নন। প্রবীর সিকদারের মতো অগনিত সাংবাদিক আপনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সহযাত্রী। আজ তাঁরাই হয়রানির ভয়ে তটস্থ। ভারত-বাংলাদেশ চুক্তির বিরুদ্ধে যারা অনুমান নির্ভর বিষোদগাড় করছেন, আপনার বিরুদ্ধে দেশ বিক্রির অভিযোগ করছেন,নারীদের অগ্রগতির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মন্তব্য করছেন,সংবিধানের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিচ্ছেন তখন কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নিশ্চুপ!
সাংবাদিকদের কোন লেখায় মানহানি হলে তদন্ত সাপেক্ষে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা যেতে পারে। উদ্দশ্যমূলকভাবে একাধিকবার কারো মানহানি করা হলে শো কজ করে তৃতীয় দফায় প্রকাশনা স্থগিত করার বিধান চালু করার বিষয়টিও দেখা যেতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রবিরোধী বা সমাজবিরোধী কোন কর্মকাণ্ডে জড়িত না থাকলে শুধুমাত্র মানহানির অভিযোগে সাংবাদিক গ্রেফতার অনভিপ্রেত। তাহলে প্রেস কাউন্সিলের আর দরকার কী? ৫৭ ধারার অবাধ প্রয়োগের ফলে সৎ সাংবাদকেদের কলম ভোতা হতে চলেছে। এ অবস্থা অব্যহত থাকলে দেশ ও সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। পক্ষান্তরে উৎসাহিত হবে দুস্কৃতিরা। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আপনার উন্নয়ন ধারার সহযাত্রীরা আজ বিপাকে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি এই ৫৭ ধারার খড়গটি সাংবাদিকদের মাথার উপর থেকে সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিন। অন্যথা আপনার অনুপস্থিতিতে আপনার অনুগত সাংবাদিক, রাজনীতিক,সমর্থকদের জন্য এ ৫৭ ধারাটি সন্দেহাতীতভাবে বুমেরাং হবেই। তাই আর বিলম্ব নয়, দ্রুত এর একটা বিহিত করুন এ আমাদের বিনীত নিবেদন।—
নিবেদক, সুভাষ সাহা, সম্পাদক,বিষেরবাঁশীডটকম,নিউজ২৪ডটওয়েবসাইট ও সভাপতি, বাংলাদেশ নিউজ পোর্টাল এসোসিয়েশান (বনপা)