তিন গুণী ব্যক্তিত্বকে সম্মাননা প্রদান করলো সুর নিকেতন, নিজের দায়বদ্ধতা থেকেই আজীবন বাংলা ভাষা তথা দেশের সাহিত্য সংস্কৃতির উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে গেছিঃ মাকছুদ আহমেদ

তিন গুণী ব্যক্তিত্বকে সম্মাননা প্রদান করলো সুর নিকেতন,
নিজের দায়বদ্ধতা থেকেই আজীবন বাংলা ভাষা তথা দেশের সাহিত্য সংস্কৃতির উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে গেছিঃ মাকছুদ আহমেদ

॥ নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ অমর একুশে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘিরে পাহাড়ি তিন গুণী ব্যক্তিত্বকে সম্মাননা প্রদান করেছে রাঙ্গামাটির ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সুর নিকেতন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সংবর্ধিত অতিথি এ কে এম মকছুদ আহমেদ বলেন, আমরা স্বীকৃতি বা পুরষ্কার পাওয়ার আশায় কাজ করিনি, জাতির প্রয়োজনে নিজের দায়বদ্ধতা থেকে আজীবন বাংলা ভাষা তথা এদেশে সাহিত্য সংস্কৃতির উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে গেছি। উদ্দেশ্য ছিল পিছিয়ে পড়া পার্বত্য অধিবাসীদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করা, তবে কাজের স্বীকৃতি মানুষকে আরো পরিণত এবং দায়বদ্ধ হতে উদ্বুদ্ধ করে। তাই আজ সে সম্মাননা পেলাম এর জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে সুর নিকেতনকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
প্রবীণ এই সাংবাদিক আরো বলেন, আমি না চাইলেও বহু প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা আমাকে কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বিভিন্ন পদক প্রদান করেছে। তবে এর মধ্যে মাদার তেরেসা পদক পাওয়ার অনুভূতিটি আমার কাছে কাছে একটু ভিন্ন এবং অত্যন্ত প্রেরণা দায়ক। কারণ নোবেল পুরস্কার পাওয়া এই মহিয়সী নারী সারা বিশ্বে শান্তিকামী মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি বলেন, এখন থেকে প্রায় চার দশক আগে যখন আমি পার্বত্য চট্টগ্রামে সংবাদপত্র প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করি তখন একটি পত্রিকা বের করা অনেক কঠিন ও কষ্টসাধ্য বিষয় ছিল। কিন্তু শত অভাব ও প্রতিবন্ধকতার মাঝে আমি পত্রিকা প্রকাশ করে গেছি। আজ অনেক ভালো লাগছে আমার প্রকাশিত গিরিদর্পণে লেখালেখি করে দেশে আজ অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখকের সৃষ্টি হয়েছে। কেউ পাহাড়ের মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জনের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে, আবার কেউ একুশে পদক পেয়েছে।
রাঙ্গামাটির সামাজিক সংগঠন ও সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সুর নিকেতনের নিজস্ব মিলনায়তনে একুশে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে মাদার তেরাসা পদক পাওয়ার জন্য দৈনিক গিরিদর্পণ ও সাপ্তাহিক বনভূমির সম্পাদক এ কে এম মকছুদ আহমেদ, পাহাড়ের একমাত্র ব্যক্তিত্ব হিসেবে একুশে পদক পাওয়ার জন্য লেখক কবি ও গবেষক মংছেন চিং (মংছিন) এবং মুনীর চৌধুরী পদক পাওয়ার জন্য বিশিষ্ট লেখক কবি মৃত্তিকা চাকমাকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন প্রবীণ সাংবাদিক ও রাঙামাটি প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি সুনীল কান্তি দে ও দৈনিক রাঙামাটি সম্পাদক এবং রাঙ্গামাটি প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার আল হক। সুর নিকেতনের সভাপতি ওস্তাদ মনোজ বাহাদুর গুর্খার সভাপতিত্বে এতে অন্যান্যে মধ্যে বক্তব্য রাখেন জুন ঈসথেটিক কাউন্সিলের সভাপতি শিশির চাকমা।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শেষে সুর নিকেতনের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনায় ছিল ঘন্টাব্যপী সঙ্গীত পরিবেশনা। এর আগে অতিথিগণ অনুষ্ঠান স্থলে এসে পৌঁছলে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি তাদের উত্তরীয় পরিয়ে সম্মান জানানো হয়। পরে সুর নিকেতনের সভাপতি সংবির্ধত অতিথিবৃন্দের হাতে মানপত্র তুলে দেন।
সংবর্ধনার জবাবে লেখক কবি ও গবেষক মংছেন চিং (মংছিন) বলেন, আমি যখন লিখালেখি শুরু করি তখন ভাবিনি যে একুশে পুরস্কার পবো। নিজের অন্তর থেকে গরজ অনুভব করেছি বলেই আজীবন লিখে গেছি। তিনি বলেন, লেখালেখি একজন মানুষের দায়বদ্ধতা ও মনোজাগতিক নেশা। এই নেশা থেকেই নিজের প্রতিষ্ঠা, বাড়ি গাড়ি বিত্ত বৈভব কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে লিখেই গেছি। আজ সমাজ এবং রাষ্ট্র যে ভাবে স্বীকৃতি দিচ্ছে তাতে এই দায়বদ্ধতা আরো বেড়ে গেল। তিনি বলেন, লেখক হিসেবে আজকে মংছিন গিরিদর্পনেরই সৃষ্টি। গিরিদর্পণের কারণেই আমি লেখালেখির জগতে এতদূর এগিয়েছি।
কবি মৃত্তিকা চাকমা বলেন, গিরিদর্পণ দিয়েই আমার লেখালেখির জীবনে প্রবেশ ঘটে। সেউ তরুণ বয়েসে লেখার একটি ক্ষেত্র পেয়েছিলাম বলে আজও লিখে যাচ্ছি। জাতির জন্য সমাজ ও সংস্কৃতির জন্য কিছু করার চেষ্টা করছি। গিরিদর্পণে লেখালেখির সুযোগ পেয়ে অনেক মানুষ আজ এই জগতে বেশ নাম করেছে। তাই পাহাড়ের মানুষ সব সময় মকছুদ ভাইকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। তিনি বলেন, দেশে বেশ কিছু পদক ছাড়াও পাশ্ববর্তী দেশ থেকে আমার স্বীকৃতি পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে, তবে নিজের এলাকায় নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে যে সম্মাননা পেলাম, এর অনভ’তি যেন ভিন্নতর।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সুনীল কান্তি দে বলেন, গুণীর কদর না হলে সে সমাজে গুণীর জন্ম হয় না। আজ গুণীদের সম্মাননা জানিয়ে সুর নিকেতন যে দায়িত্ব পালন করেছে সে দায়িত্ব ছিল আমাদের। এই প্রসংশনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা আমি সুর নিকেতনকে সাধাবাদ জানাচ্ছি। তিনি বলেন, পাহাড়ের সাহিত্য সংস্কৃতিক বিকাশে মকছুদ আহমেদের এ অঞ্চলের মানুষ সব সময় শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। তিনি তৎকালীন সময়ে পত্রিকা প্রকাশনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলেই পাহাড়ের সাংবাদিকতা বিকশিত হয়েছে। সুনীল কান্তি দে আরো বলেন, পাহাড়ের গবেষক মংছেন চিং একুশে পদক পেয়ে পার্বত্য বাসীর জন্য যে সম্মান বয়ে এনেছেন তার জন্য আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনি উল্লেখ করেন সম্মাননা পাওয়ার পর গুণীদের দায়িত্ব আরো বেড়ে যায়, আমরা আশা করি এই সম্মানীত ব্যক্তিবর্গ আগামী দিনে পার্বত্য সমাজ ও মানুষের উন্নয়নে আরো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবেন।
দৈনিক রাঙামাটি সম্পাদক তার বক্তব্যে বলেন, একুশের এ দিনটি আমাদের জাতীয় জীবনের জন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। একুশে ফেব্রুয়ারি নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে যারা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। তারা শুধু আমাদের ভাষার অধিকার ও মর্যাদাই প্রতিষ্ঠা করেনি। এই আন্দোলনের সূত্র ধরেই আমাদের বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক মর্যাদা পেয়েছে, আমাদের শহীদ দিবস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সম্মান পেয়েছে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিনে সুর নিকেতন ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্য কাজ করে যাওয়া তিন গুণী ব্যক্তিত্ব সম্মান জানিয়ে যে নতুন একটি ইতিহাসের জন্ম দিল। তিনি বলেন, আমাদের ভাষা যতদিন বিশ্বের বুকে টিকে থাকবে, ততদিন পাহাড়ের মানুষ দৈনিক গিরিদর্পণ ও এর সম্পাদক একেএম মকছুদ আহমেদের নাম শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারণ করবে। কারণ মানুষের মনোজগত ও বস্তুজগতের যে অসীম বিস্তার এবং প্রসার আজ বিশ্বের বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর সংস্কৃতিতে আমরা দেখতে পাই, তা ভাষারই সৃষ্টি, ভাষারই অবদান। ভাষার সাথে সাহিত্য এবং সাংবাকিতা অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। আর পার্বত্য চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার কথা উচ্চারণ করতে হলে সবার আগে একেএম মকছুদ আহমেদের নাম উচ্চারণ করতে হবে।

Archive Calendar
Mon Tue Wed Thu Fri Sat Sun
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
2425262728