মিয়ানমারের ২৪টি পুলিশ পোস্টে হামলার ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনীর ১১ সদস্যসহ ৩২ নিহত

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে এক রাতে ২৪টি পুলিশ পোস্টেরোহিঙ্গা বিদ্রোহীদেরহামলার ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনীর ১১ সদস্যসহ অন্তত ৩২ জন নিহত হয়েছে বলে খবর দিয়েছে রয়টার্স

শুক্রবার মিয়ানমার সরকারের এক বিবৃতিতে বলা হয়, রাখাইনের মংডু এলাকার বিভিন্ন গ্রামে স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার রাত ১টার দিকে সমন্বিত এই হামলার সূচনা হয়।

রাখাইনের পরিস্থিতি নিয়ে কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বড় ধরনের এই সমন্বিত হামলার ঘটনায় সঙ্কট নতুন মাত্রা পেল।

হামলায় নিহত নিরাপত্তা বাহিনীর ১১ সদস্যের মধ্যে ১০ জন পুলিশ ও এক সেনা সদস্য রয়েছেন; নিহত বাকি ২১ জন ‘রোহিঙ্গা বিদ্রোহী’ বলে জানায় রয়টার্স।

তাদের খবরে বলা হয়, হামলার বিষয়ে শুক্রবার ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ)’ নামে একটি গ্রুপ দায় স্বীকার করেছে। এক সময়ে ‘হারাকা আল-ইয়াকিন’ নামে পরিচিত এই গ্রুপটিই গত বছরের অক্টোবরে পুলিশ ক্যাম্পে হামলা চালিয়েছিল।

মিয়ানমার সরকারের বিবৃতির বরাত দিয়ে মিজিমার খবরে বলা হয়, রোহিঙ্গা গেরিলাদের সঙ্গে স্থানীয় গ্রামবাসী ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পুলিশ পোস্ট ঘিরে ফেলে এই হামলা চালায়। তাতে পাঁচ পুলিশ সদস্য এবং অন্তত সাতজন হামলাকারী নিহত হন।

ভোর ৩টার দিকে প্রায় দেড়শ হামলাকারী খামারা এলাকায় একটি সেনা ক্যাম্পে ঢোকার চেষ্টা করলেও প্রতিরোধের মুখে পিছিয়ে যায় বলে জানানো হয়েছে সরকারের বিবৃতিতে।

গত অক্টোবরে প্রায় একই ধরনের হামলায় নয় পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার পর বড় ধরনের দমন অভিযানে নামে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ওই অভিযানে বেসামরিক রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া এবং ধর্ষণের মত অভিযোগ ওঠে।

সেনাবাহিনীর ওই দমন অভিযানের মুখে ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান রাখাইন থেকে পালিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সে সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হয় বলেও জাতিসংঘের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়।

রয়টার্স বলছে, চলতি মাসে নিরাপত্তা বাহিনী রাখাইনের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায়গুলোয় নতুন করে দমন অভিযান শুরুর পর থেকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। বৃহ্স্পতিবার রাতে শুরুর পর কিছু কিছু এলাকায় সেনা ও বিদ্রোহীদের মধ্যে এখনও সংঘর্ষ চলছে।

নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর দুইটি সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে সংবাদ সংস্থাটি।

এদিকে ঘটনার পর এক বিবৃতিতে হামলাকারীদের বাঙালি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সাং সুচির কার্যালয়ের প্রেস উইং।

বিবৃতিতে বলা হয়, “উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের মংডু এলাকার একটি পুলিশ স্টেশনে হাতে তৈরি বোমা নিয়ে চরমপন্থি বাঙালি বিদ্রোহীরা আক্রমণ করে। রাত ১টার দিকে আরও কয়েকটি পুলিশ পোস্টে তারা সমন্বিত হামলা চালায়।”

 

রোহিঙ্গাদের বিষয়ে মিয়ানমারে ব্যাপক বিরোধিতা বিদ্যমান। দীর্ঘদিন ধরে সেনা শাসনে থাকা দেশটির রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে দমন-পীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। তিন দশক ধরে ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গার ভার বহন করছে বাংলাদেশ।

রাখাইন জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী হিসেবে দেখে থাকে। সু চির নিজ দলেরও অনেকে এই অবস্থানে আছেন। এই কারণে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও মৌলিক অধিকার দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে মিয়ানমার। গত বছরের মে মাসে মিয়ানমারে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রাষ্ট্রদূত স্কট মার্শিয়েলকে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার না করার পরামর্শ দেন সু চি।

গত বছরের অক্টোবরে দমন অভিযান শুরুর প্রেক্ষাপটে নতুন করে আশ্রয় নেওয়া সব রোহিঙ্গাসহ দেশটির সব জনগোষ্ঠীকে ফেরত নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের অভ‌্যন্তরীণ সঙ্কট থেকে উদ্ভূত এই শরণার্থী সমস‌্যা সমাধানে পদক্ষেপ নিতে বারবার আহ্বান সত্ত্বেও আগের শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো উদ‌্যোগও নিচ্ছে না দেশটির সরকার।

সু চির প্রেস উইং জানিয়েছে, ১৫০ জন রোহিঙ্গা আক্রমণকারী একটি সেনা ক্যাম্প ভাঙার চেষ্টা চালিয়েছিল, সেনা বাহিনী পাল্টা হামলা করেছে।

সাম্প্রতিক অভিযানের প্রসঙ্গ টেনে মিয়ানমার পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র কর্নেল মায়ো থু সোয়ি বলেন, “আমরা তাদের ক্যাম্প, গুহা ও বোমা এবং গুহার ভেতর মুখোশ খুঁজে পেয়েছি বলেই তারা হামলার পরিকল্পনা করেছে।”

এদিকে এবার হামলাকারীর সংখ্যা গত অক্টোবরের হামলাকারীদের থেকে অন্তত পাঁচগুণ বেশি হবে জানিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।

রয়টার্স জানায়, অন্তত ৫০টি গ্রামের এক হাজার বিদ্রোহী হামলায় অংশ নেয় বলে সেনা সদস্যদের মনে করছেন।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বরাত দিয়ে তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইনে ২০১২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর সৌদি আরবে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গারা তৈরি করে এআরএসএ গ্রুপ, যারা ইতোমধ্যে হামলার দায় স্বীকার করেছে।

গ্রুপটির নেতা আতা উল্লাহ বলেছেন, শত শত তরুণ রোহিঙ্গা তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।

মানবাধিকার রক্ষায় সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে ন্যায্য প্রতিরোধ তারা চালিয়ে যাবে বলছে গ্রুপটি।

 

এআরএসএ এর নামে করা একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে এক পোস্টে হামলার দায় স্বীকার করে বলা হয়, “বার্মিজ নির্যাতনকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে ২৫টির বেশি জায়গায় আমরা প্রতিরোধ কার্যক্রম চালিয়েছি। শিগগির আরও আসছে।”

বৃহস্পতিবারের হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান রাখাইনের পরিস্থিতি নিয়ে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির কাছে হস্তান্তর করেন।

পরে ইয়াংগুনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, নাগরিকত্ব না পাওয়ায় এবং নিদারুণ বৈষম্যের কারণ মুসলমান রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে। তাদের ওপর বলপ্রয়োগের পথ ছেড়ে মিয়ানমার সরকারকে যৌক্তিক সমাধানের পথে আসতে হবে।

Archive Calendar
Mon Tue Wed Thu Fri Sat Sun
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30