প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে ২ হাজার ৩১২ কেটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। পুরোপুরি সরকারি অর্থায়নের এ প্রকল্পের কাজ ২০১৯ সালের নভেম্বরের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে।
মঙ্গলবার এনইসি সম্মেলন কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ‘আশ্রয়ণ-৩ (নোয়াখালী জেলার হাতিয়া থানাধীন চর ঈশ্বর ইউনিয়নস্থ ভাসান চরে ১ লক্ষ বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের আবাসন এবং দ্বীপের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ)’ শীর্ষক এ প্রকল্প চূড়ান্ত অনুমোদন পায়।
পরে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে ইতোমধ্যে মিয়ানমারের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে। কিন্তু এত অভিবাসীকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য সময় দরকার। বর্তমানে অনেক রোহিঙ্গা খোলা আকাশের নিচে অমানবিক পরিবেশে বসবাস করছে। এ পরিস্থিতিতে তাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।”
প্রকল্পের কার্যপত্রে বলা হয়েছে, নোয়াখালী জেলার চর ঈশ্বর ইউনিয়নে ভাসান চরের অবস্থান। নোয়াখালী থেকে এর দূরত্ব ২১ নটিক্যাল মাইল।
“বিপন্ন রোহিঙ্গাদের বিশাল স্রোত দেশের নিরপাত্তা ও পরিবেশ দুটোর জন্যই হুমকি হিসাবে দেখা দিয়েছে। বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত অসহায় মিয়ানমারের নাগরিকদের কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে বসবাসের স্থান সঙ্কুলান করা কঠিন হয়ে পড়ছে। প্রতিনিয়ত পাহাড়ি জমি ও বনাঞ্চল নষ্ট হচ্ছে।”
টেকনাফ ও উখিয়ায় স্থানীয় অধিবাসীদের সংখ্যা যেখানে ৫ লাখ ৭ হাজার, সেখানে নতুন-পুরনো মিলিয়ে দশ থেকে ১২ লাখ রোহিঙ্গা ওই এলাকায় আশ্রয় নেওয়ায় নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে এবং পর্যটন এলাকা কক্সবাজারের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় প্রকল্পের কার্যপত্রে।
এ প্রকল্পের মাধ্যমে মূলত ভাসান চরের ভূমি উন্নয়ন ও সমুদ্রতীরের নিরাপত্তা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। এক লাখের বেশি মানুষের বসবাসের জন্য সেখানে ১২০টি গুচ্ছ গ্রামে ১৪৪০টি ব্যারাক হাউজ ও ১২০টি আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে।
এছাড়া থাকবে উপাসনালয়, নিরাপত্তার জন্য নৌবাহিনীর অফিস ও বাসভবন, অভ্যন্তরীণ সড়ক, পানি নিষ্কাশন অবকাঠামো, নলকূপ ও পানি সরবরাহ অবকাঠামো এবং ওয়াচ টাওয়ার।
গত কয়েক দশক ধরে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির ও তার বাইরে অবস্থান নেওয়া চার লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে নিয়ে সামাজিক নানা সমস্যা সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে তাদের নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার কাছে মেঘনার মোহনার বিরান দ্বীপ ভাসান চরে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করে সরকার।
এই চরের আয়তন জোয়ারের সময় ১০ হাজার এবং ভাটার সময় ১৫ হাজার একর। জনমানবহীন চরটি মূলত গরু-মহিষের চারণভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হত। ২০১৩ সালে এ চরকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল এলাকা ঘোষণা করা হয়। ইঞ্জিনচালিত নৌযান ছাড়া সেখানে যাতায়াতের সুযোগ নেই। হাতিয়া থেকে যেতেও তিন থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা সময় লাগে।
এক দশক আগে জেগে ওঠা এই চরকে ‘ঘূর্ণিঝড় ও বন্যাপ্রবণ’ এবং জলদস্যুর উৎপাতের কারণে বসবাসের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে বর্ণনা করে চলতি বছরের শুরুতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ বন বিভাগের এক প্রতিবেদনেও দ্বীপটিকে মানুষ বসবাসের অনুপযোগী বলা হয়।
মাসখানেক পরে নোয়াখালী জেলা প্রশাসনের আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভাসান চরের পরিবেশ অন্যান্য চরের মতই। আনুষঙ্গিক অবকাঠামো তৈরি করা হলে সেখানে জনবসতি স্থাপনে সমস্যা হবে না।
এর মধ্যে অগাস্টের শেষে মিয়ানমারের রাখাইনে নতুন করে সেনা অভিযান শুরু হলে আবারও রোহিঙ্গার ঢল নামে। এ দফায় প্রায় সোয়া ছয় লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে এসে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়ায় ভাসান চরকে দ্রুত বসবাসের উপযোগী করার উদ্যোগ নেয় সরকার।
এক প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনা মন্ত্রী বলেন, এ প্রকল্পের বিষয়ে দাতাদের সঙ্গেও কথা হয়েছে। তারা এগিয়ে এলে সরকার তাদের স্বাগত জানাবে।
“সরকার সর্বোচ্চ সক্ষমতা দিয়ে মন উজার করে মানবিক সহায়তার উদ্দেশ্যে এ কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।”
মঙ্গলবার একনেকের বৈঠকে ভাসান চরের প্রকল্পসহ মোট ১৪টি উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে জানান মন্ত্রী।
এসব প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১০ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ১০ হাজার ৪৮ কোটি টাকা এবং প্রায় ৫১ কোটি টাকা সংশ্লিষ্ট সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে যোগানো হবে।
প্রকল্পগুলো হল–
>> ময়মনসিংহ জোনের বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্প; ব্যয় ১ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা।
>> মাদারিপুর, শরিয়তপুর ও রাজবাড়ী জেলা গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প: ব্যয় ১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।
>> বরিশাল, ঝালকাঠি ও পিরোজপুরে গুরুত্বপূর্ণ পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প: ব্যয় ৯৫০ কোটি টাকা।
>> সিরাজগঞ্জ জেলার গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প: ব্যয় ৪৪৬ কোটি টাকা।
>> গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্য়ায়): ব্যয় ৩৫৩ কোটি টাকা।
>> নোয়াখালী ফেনী ও লক্ষ্মীপুর জেলায় ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন প্রকল্প: ব্যয় ১৪৩ কোটি টাকা।
>> আজিমপুর সরকারি কলোনিতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বহুতল আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্য়ায়): ব্যয় ৯৯০ কোটি টাকা।
>> ঢাকার জিগাতলায় সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের (গণপূর্ত ও স্থাপত্য অধিদপ্তর) জন্য ২৮৮টি আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প: ব্যয় প্রায় ৩০৪ কোটি টাকা।
>> ঢাকার মতিঝিল সরকারি কলোনিতে (হাসপাতাল জোন- স্টোর-কম্পাউন্ড) বহুতল আবাসিক ভবন নির্মাণ প্রকল্প: ব্যয় ২৫৭ কোটি টাকা।
>> কুমিল্লা শহরের শাসনগাছা রেলওয়ে ওভারপাস নির্মাণ প্রকল্প: ব্যয় ৯৪ কোটি টাকা।
>> শেরপুর (আখের বাজার লঙ্গরপাড়া শ্রীবর্দী (মামদাবারি) সড়ক প্রশস্তকরণ ও মজবুতিকরণ প্রকল্প: ব্যয় ৮২ কোটি টাকা।
>> উচ্চ মাধ্যমিক উপবৃত্তি প্রকল্প: ব্যয় প্রায় ৭৯৮ কোটি টাকা।
>> চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্প: ব্যয় ২৩৩ কোটি টাকা।