মোহাম্মদ সাইদুল হক * যে সমস্ত বরকতময় রজনীতে আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের প্রতি করুণার দৃষ্টি দান করে থাকেন,লাইলাতুল বারা’আত তারই অন্যতম।তাফসীর, হাদিস ও বিজ্ঞ আলিমদের পরিভাষায় এ রাতকে”লাইলাতুন নিছফি মিন শা’বান” বা শা’ বানের মধ্য রজনী নামে অভিহিত করা হয়।যে রাতটি হলো শা’বান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত।প্রিয়নবী (দঃ),বুযুর্গানে দ্বীন ও বিজ্ঞ মনীষীগন রাতটি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে পালন করেছেন।অনুরুপ, যুগে যুগে মুসলমানগণ এরই ধারাবাহিকতায় রাতটি শরীয়ত সম্মত পন্থায় পালন করে আসতেছেন।বর্তমানে কিছু সংখ্যক লেবাসধারী আলেম এ রাত টি উদযাপন করা বিদ’আত ফতোয়া দিয়ে সাধারণ মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করতেছে। ঐ সব জ্ঞানপাপী আলেমদের থেকে সতর্ক থাকার জন্য আপামর মুসলমানদেরকে আহ্বান জানাচ্ছি।
কুরআনের আলোকে শবে বারা’আতঃ আল্লাহ বলেন, ” .হা- মীম।শপথ ঐ সুস্পষ্ট কিতাবের; নিশ্চয়ই আমি সেটাকে বরকতময় রাতের মধ্যে অবতীর্ণ করেছি।নিশ্চয়ই আমি সতর্কবাণী শুনাই।তাতে বন্টন করে দেয়া হয় প্রত্যেক হিকমতময় কাজ।( পারাঃ২৫,সূরা দুখান,আয়াত:১-৪) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে জালালাইন শরীফে উল্লেখ আছে ” নিশ্চয়ই আমি সেটাকে ( কুরআন) বরকতময় রাতের মধ্যে অবতীর্ণ করেছি।সেই বরকতময়ী রাত হচ্ছে হয়তো “শবে ক্বদর” অথবা অর্ধ শা’বানের রাত্রি — শবে বরাত।( তাফসীরে জালালাইন:৪১০ পৃঃ) জালালাইন শরীফে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায়…. ২৪ নং টীকায় আরো উল্লেখ আছে যে, ঐ বরকতময়ী রাত হচ্ছে, অর্ধ-শা’বানের রাত( শবে বরাত)।এটা হযরত ইকরামা ও তাফসীরকারকদের একটা দলে অভিমত।তাঁরা এর কতিপয় কারণও উল্লেখ করেছেন।যেমন—অর্ধ-শা’বানের রাতের কতিপয় নাম আছে–১. আল লাইলাতুল মুবারাকাহ ( বরকতময় রাত)২. লাইলাতুল বারা’আত ( মুক্তির রাত)৩.লাইলাতুর রাহমাহ্ (রহমতের রাত) এবং ৪.লাইলাতুস্ সক্কি( অঙ্গিকারের রাত) ইত্যাদি।তাছাড়া এই রাতে ইবাদত বন্দেগী করার ফলে বান্দা অনেক ফযীলত লাভ করবে।(হাশিয়াহ্ জালালাইনঃ৪১০ পৃঃ) এভাবে আরো বিভিন্ন তাফসীরের কিতাব যেমন – তাফসীরে কাশশাফ,তাফসীরে কুরতুবী সহ গুণিয়াতুত ত্বালিবীন কিতাবে লাইলাতুল বারা’আতে অকাট্য প্রমাণ রয়েছে।এরপরও যারা লাইলাতুল বারা’আতের বিরোধীতা করে তারা যেন উক্ত তাফসীরের কিতাব দেখার আহ্বান জানাচ্ছি।
হাদিসের আলোকে লাইলাতুল বারা’আতঃলাইলাতুল বারা’আত তথা শবে বরাত( ফার্সী শব্দ) এর তাৎপর্য ও ফযীলত সম্পর্কে বহু বিশুদ্ধ হাদিস শরীফ বর্ণিত হয়।নিম্নে কয়েকটা উল্লেখ করা হলো….১.হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন,রাসুল (দঃ) একাধারে (এতবেশী) রোযা রাখতেন ( শা’বান মাসে) আমরা বলাবলি করতাম,তিনি আর রোযা পরিত্যাগ করবেন না।আবার কখনো এমনভাবে রোযা ছেড়ে দিতেন,আমরা বলাবলি করতাম,তিনি আর রোযা রাখবেন না।আমি রাসুল (দঃ) কে রমজান ব্যতীত কোনো পুরো মাস রোজা রাখতে দেখিনি এবং শা’বান মাসের চেয়ে কোনো মাসে বেশী রোযা রাখতে দেখিনি।( বুখরী শরীফ, ১ম খন্ড,পৃঃ২৬৪)সহীহ্ ইবনুল হিব্বান এ হযরত মুয়াজ (রাঃ) থেকে বর্ণিত,যখন শা’বানের মধ্য রজনী (শবে বরাত)উপস্থিত হয়,তখন এক আহ্বানকারী এ আহ্বান করতে থাকে যে, ” কোনোও ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছো কি?আমি তাকে ক্ষমা করব,কোনো প্রার্থী বা ফরিয়াদি আছো কি?আমি তার ফরিয়াদ কবুল করব।এভাবে যে যা প্রার্থনা করবে তাকে তা দেয়া হবে– একমাত্র যিনাকারী ও মুশরিক ব্যতীত।
এভাবে লাইলাতুল বারা’আত সম্পর্কে নিম্নের কিতাব তথা– মা ছবাতা বিস্ সুন্নাহ,পৃঃ ১৮৮;ফাযায়েলুল আওকাত,পৃঃ ১১৬,১১৩;১১৪;আবু দাউদ শরীফ,২য় খন্ড,গুণিয়াতুত ত্বালিবীন, ১ম খন্ড,পৃঃ২৪৬ — কিতাব সমুহে উল্লেখ আছে।
হযরত আলী (রাঃ) প্রায়ই শা’বান মাসের ১৫তম রাত তথা ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে ঘর থেকে বের হতেন।একবার এভাবে শবে বরাতে বের হয়ে আসমানের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললেন, ” একবার হযরত দাউদ (আঃ) শা’বানের ১৫তম রাতে আসমানের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলেছেন,এটা ঐ সময়, ডে সময় যে যা দোয়া আল্লাহর নিকট করেছে,আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেছেন আর যে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে,আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।তবে,দোয়া প্রার্থনাকারী যেন অন্যায়ভাবে কর আদায়কারী,গণক,অত্যাচারী শাসক বা নেতা,চুগলখোর,গায়ক বা বাদ্য- বাজনা বাদক না হয়।অতঃপর এই দোয়া করলেন–” হে আল্লাহ! হে দাউদ (আঃ) এর পালনকর্তা!যে এ রাতে তোমার নিকট দোয়া করে অথবা ক্ষমা প্রার্থনা করে, তুমি তাঁকে ক্ষমা করে দাও।( মা ছাবাতা বিস্ সুন্নাহ,পৃঃ ৩৫৪)
শবে বরাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রাত।কেউ জানেনা তার অদৃষ্টে কি লিখে দেয়া হয়েছে।কাজেই কোনো অবস্হাতেই এ রাতটি অবহেলায় কাটিয়ে দেয়া উচিত নয়।এ রাতে বিশেষভাবে রহমতের বৃষ্টি মুষলধারে বর্ষিত হয়।এ মুবারক রাতে আল্লাহ “বনী কালব” গোত্রের ছাগল গুলোর লোম অপেক্ষা বেশী উম্মতের গুনাহ ক্ষমা করে দেন।কিতাবে উল্লেখ রয়েছে যে,বনী কালব গোত্র আরবের গোত্র গুলোর মধ্যে বেশি ছাগল পালন করত।দুর্ভাগ্য! কিছু হতভাগ্য লোক এমন ও রয়েছে যাদেরকে এ শবে বরাত তথা মুক্তির রাতেও ক্ষমা করা হয় না।যেমন ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) বলেন,১.মদ্যপানে অভ্যস্ত ২.যিনা বা ব্যভিচারে অভ্যস্ত ৩.মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান- সন্ততি ৪.আত্বীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী ৫.ফিৎনা ( বিশৃংখলা)সৃষ্টিকারী ও চুগলখোরদের এ রাতে ক্ষমা করা হয় না।(মুকাশাফাতুল কুলুব,পৃঃ৩০৪)
অনুরুপভাবে,গণক,যাদুকর,অহংকার সহকারে পায়জামা অথবা লুঙ্গি ( প্যান্ট,জুব্বা ইত্যাদি) গোড়ালীর নিচে ঝুলিয়ে পরিধান কারী,দু’ জন মুসলমানের মাঝে বিরোধ সৃষ্টিকারী ও হিংসা বিদ্ধেষ পোষণকারীও এ রাতে ক্ষমার সৌভাগ্য লাভ থেকে বঞ্চিত থাকে।সুতরাং সকল মুসলমানের উচিত,উপোরক্ত গুনাহ্ সমুহ থেকে যদি কোন একটির মধ্যে লিপ্ত থাকে তবে তারা যেন এ শবে বরাত আসার পূর্বেই সত্যিকার অর্থে তাওবা করে নেয়।
শা’বান মাসের ১৫তম রাতে কেউ যদি বড়ই গাছের সাতটি পাতা পানিতে সিদ্ধ করে ঐ পানি দিয়ে গোসল করে, ইনশা আল্লাহ!সারা বছর যাদুর প্রভাব থেকে নিরাপদে থাকবে।(ইসলামী যিন্দেগী,পৃঃ১১৩)।
হে আল্লাহ!আমাকে সহ উম্মতে মুহাম্মদী (দঃ) কে লাইলাতুল বারা’আত নসীব করে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ দান করুন।আমিন,বিহুরমাতি শাফিয়িল মুযনেবীন।
সহকারি শিক্ষক
পোয়াপাড়া সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়
কাউখালী,রাংগামাটি পার্বত্য জেলা।