নেতৃবৃন্দের অদূরদর্শিতা, সরকারের ভীতি এবং সাধারণ পাহাড়িদের দুর্দশা

লিখেছেন: মাহের ইসলাম : পার্বত্য চট্রগ্রামের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে, কিছু কিছু শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি শুধুমাত্র পাহাড়িদের বঞ্চনা এবং অত্যাচারিত হওয়ার নির্বাচিত অংশবিশেষের উপর আলোকপাত করেন এবং কোন এক অজানা কারণে পুরো সত্য এড়িয়ে যান। এতে হয়তো, পাহাড়িদের প্রতি সহানুভূতি আদায় করা সহজ হয়; কিন্তু প্রকৃত সত্য আড়ালের দায় এড়ানো যায় না। পাহাড়িদের প্রতি ভালোবাসা থেকে কেউ কেউ এমন করতে গিয়ে হয়ত ভুলে যান যে, কিছু লোকের জন্যে সহানুভূতি আদায়ের এই পদ্ধতি অন্য অনেক লোকের প্রতিও এক ধরনের বঞ্চনার সৃস্টি করছে। সহজ কথায়, একই এলাকার মানুষের একাংশের প্রতি সুবিচারের প্র্ত্যাশায় অন্য অংশের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে।

কোন সন্দেহ নেই যে, পাকিস্তান আমলে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে হাজার হাজার পাহাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটাও ঠিক যে, চাকমা বা মারমারা বাংলাদেশী – বাঙ্গালী নয়। তেমনি এটাও অনস্বীকার্য যে, পার্বত্য চট্রগ্রামে ভুমি সমস্যার অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি কারণ হলো বাংলাদেশের অন্য স্থান হতে বাঙ্গালীদের পার্বত্য চট্রগ্রামে পুনর্বাসন।

পার্বত্য চট্রগ্রামের ব্যাপারে যথাযথ ধারনা লাভের জন্যে এই তিনটি বাস্তবতার আংশিক নয় বরং সম্পূর্ণ প্রেক্ষাপট এবং এর সাথে জড়িত তৎকালীন পাহাড়ি নেতাদের ভূমিকা খাটো করে দেখার অবকাশ রয়েছে বলে মনে হয় না। প্রকৃতপক্ষে, পাহাড়ি নেতাদের ভুমিকাই অনেকাংশে এই তিনটি ঐতিহাসিক বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে – দেশের পরিবর্তে জাতির স্বার্থ দেখতে গিয়ে এই নেতারা তাদের জাতির সাধারণ মানুষের জন্যে বয়ে এনেছেন দুর্ভোগ। যদিও তাদের উদ্দেশ্যে খারাপ কিছু ছিল না, কিন্তু তাদের অদূরদর্শীতা সমগ্র জাতির জন্যে বঞ্চনা আর দুর্দশা নিশ্চিত করেছে। সবচেয়ে ভয়াবহ দিকটি এই যে, এখনকার নেতৃবৃন্দগণও কেন জানি তাদের পূর্বপুরুষের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে বদ্ধ পরিকর – যেখানে আবার আমাদের দেশেরই কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী যোগ দিয়েছেন।

১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময় পাহাড়ের কোন নেতাই পার্বত্য চট্রগ্রামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে ছিলেন না। বরং অনেক নেতাই যারপরনাই চেষ্টা করেছিলেন ভারতে অন্তর্ভুক্তির জন্যে। এমনকি পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির ব্রিটিশ সিদ্ধান্তের পরেও, তৎকালীন জনসমিতির সাধারণ সম্পাদক স্নেহ কুমার চাকমার নেতৃত্বে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের অফিসের সামনে প্রকাশ্যে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। এক্ষেত্রে তিনি স্থানীয় পাহাড়ী পুলিশদেরকে সশস্ত্র প্রতিরোধের জন্যে প্রস্তুত রাখার পাশাপাশি “গ্রামস্থ বহু পাহাড়ীকেও বন্দুক প্রভৃতি আগ্নেয়াস্ত্র লইয়া উপস্থিত হইতে নির্দেশ প্রদান” করেন। অবশ্য সশস্ত্র প্রতিরোধের পরিকল্পনা জানতে পেরে গভর্নর জেনারেল বলেছিলেন, “হিন্দুস্তান ভুক্তির চেষ্টা পরিহার করুন, অন্যথা শুধু শক্তির অপব্যয় করা হইবে এমন নহে, ইহাতে তোমরা বিশেষ কষ্টে পতিত হইবে” (দেওয়ান, ১৯৭০)।

পরবর্তীতে, পাহাড়ী নেতৃবৃন্দের সশস্ত্র প্রতিরোধ ব্যর্থ করে পাকিস্তানের বেলুচ রেজিমেন্ট ২১ আগস্ট ভারতের পতাকা নামিয়ে ফেলে। “এরপর পাকিস্তান সরকার ঢালাওভাবে উপজাতীয়দের প্রো-ইন্ডিয়ান বা ভারতপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করে। এবং সেই থেকে শুরু হয় তাদের ওপর বিমাতাসুলভ আচরণ প্রদর্শনের পালা।” (খীসা, ১৯৯৬, p. 34)

পতাকা নামালেও পাহাড়ি নেতারা দমে যাননি, অপরপক্ষে ভারতীয় নেতারাও তাদের দেশবিভাগপূর্ব সেন্টিমেন্ট বজায় রাখেন। যার প্রকাশ ঘটে দেশ বিভাগের প্রায় দুই বছর পরে ভারতের কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সরদার প্যাটেল পূর্ব পাকিস্তানী সংখ্যালঘূদের খুশী করার জন্যে যখন বলেন যে, “শুধুমাত্র একটা দাগের অন্যপাশে আছে বলেই যারা আমাদের রক্ত এবং মাংস, যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের পাশে থেকে লড়াই করেছে, হঠাৎ করে তারা আমাদের কাছে বিদেশী হতে পারে না।” (চৌধুরী মোঃ নাজমুল হাসান, ২০০৬, p. 40)। তাই পাহাড়ি নেতাদের সাথে ভারতীয় নেতাদের যোগাযোগের বিষয়টি বুঝতে পেরে, পাকিস্তান সরকার স্বাভাবিকভাবেই তা বন্ধ করার চেষ্টা করেন।

পাকিস্তান সরকারের প্রচেষ্টার মধ্যে পার্বত্য চট্রগ্রামকে বাঙ্গালীদের প্রবেশের জন্যে খুলে দেয়া অন্যতম। যার ধারাবাহিকতায়, ১৯৬২ সালের সংবিধানে পার্বত্য চট্রগ্রামকে ‘এক্সক্লুডেড এলাকা’ হতে ‘ট্রাইবাল এলাকা’র মর্যাদা দেয়া হয়। এমনকি ১৯৬৪ সালে, ‘ট্রাইবাল এলাকা’র বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করে এই অঞ্চলে বাইরের অধিবাসীদের প্রবেশ, বসবাস এবং জমি অধিগ্রহণ এর উপর হতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। অপরপক্ষে, ১৯৬০ হতে ১৯৭০ সালে, এই অঞ্চল হতে বেশীরভাগ পাহাড়ী সরকারী কর্মচারীদের অন্যত্র বদলি করে দিয়ে শুধুমাত্র প্রধানত বাঙ্গালিদেরকেই এখানে সরকারী প্রশাসনের দায়িত্বে রাখা হয়। একই সময়, সোভিয়েত ব্লক ও ভারতের বিপক্ষে আমেরিকাকে সমর্থনের অংশ হিসেবে পাকিস্তান পার্বত্য অঞ্চলে ভারতের নাগা ন্যাশনাল আর্মি এবং মিজো গেরিলাদের সাহায্য করে। এরই পাশাপাশি, এই এলাকার উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্রগ্রামকে ‘ট্যাক্স ফ্রি জোন’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। একই লক্ষ্যে, ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলা ও এই অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে ১৯৫৭ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এই সমস্ত কিছু করা হয় প্রধানত পার্বত্য অঞ্চলকে ভারতে অন্তর্ভুক্তির হাত থেকে রক্ষা করতে। স্মরণযোগ্য যে, ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পরে জম্মু ও কাশ্মীর, হায়দ্রাবাদ, গোয়া, সিকিম, জুনাগর ইত্যাদির ভাগ্যের দিকে তাকালে পাকিস্তানের এহেন ভারতভীতি থাকা মোটেও অস্বাভাবিক মনে হয় না।

(চলবে)

তথ্যসুত্রঃ
খীসা, প. (১৯৯৬). পার্বত্য চট্রগ্রামের সমস্যা. ঢাকা। : সাহিত্য প্রকাশ.
চৌধুরী মোঃ নাজমুল হাসান. (২০০৬, অক্টোবর – ডিসেম্বর). The Resistance Movement in the Chittagong Hill Tracts: Global and Regional Connections. এশিয়ান এফেয়ারস, ২৮(৪), ৩৬-৫১.
দেওয়ান, শ. ক. (১৯৭০). পার্বত্য চট্রলের এক দীন সেবকের জীবন কাহিনী . রাঙামাটি : দেওয়ান ব্রাদার্স এন্ড কোং

Archive Calendar
MonTueWedThuFriSatSun
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31