আন্তর্বতীকালিন সরকার পাহাড়ের বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিলে নিতে হবে গভীর বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে

॥ সৈয়দ ইবনে রহমত ॥ ছাত্র-জনতার বিপ্লবে স্বৈরাচার বিদায় হয়েছে। এটা আমাদের জাতীয় ইতিহাসে অন্যতম বড় বিজয়। কিন্তু সেটি এখনো নিরাপদ কিংবা নিশ্চিন্ত হয়নি। পদে পদে ক্যু, ষড়যন্ত্রের নীলনকশার জাল আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতে চাইছে বিপ্লবী সরকারকে। বিচারবিভাগ, নির্বাহী বিভাগসহ সকল খাত গত সাড়ে ১৫ বছর হাসিনা শাহীর খুঁটি হিসেবে কাজ করেছে। এসব খাতে হাসিনার চাকর-বাকররা এখনো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। নানা রদবদল করেও তাদের কিনারা করা সম্ভব হচ্ছে না। আর সেই সুযোগে তারা যেভাবে পারছে অন্তর্বতী সরকারকে বিপদে ফেলতে বা ছাত্র-জনতার বিল্পবকে ব্যর্থ করে দিতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ৬ আগস্ট মধ্যরাতেই ক্যু করার পরিকল্পনা করা হয়, যা ভেস্তে যায় দেশপ্রেমিক ও বিচক্ষণ অফিসারদের তৎপরতায়। এরপর বিচারবিভাগীয় ক্যু নস্যাৎ করে দেয় ছাত্র-জনতার প্রবল প্রতিরোধ। ভারত তার নিজের স্বার্থ রক্ষায় দীর্ঘদিন অবৈধভাবে বাংলাদেশের ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে শেখ হাসিনাকে। কিন্তু সেই ক্ষমতার মসনদ যখন চুরমার হয়ে গেছে, তখন শুধু শেখ হাসিনা নয়, বরং ভারতও দিশেহারা হয়ে পড়েছে। এখন একের পর এক ষড়যন্ত্রের চোরাগলিতে ছুটে বেড়াচ্ছে তারা। শুরুতে ভাড়াটে ডাকাত দিয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে লুটপাট চালিয়ে অরাজকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা করেছে। কিন্তু নাগরিকদের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে তা ব্যর্থ হয়েছে। পরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাঠে নামিয়ে সংখ্যালঘু কার্ড খেলার অপচেষ্টা করেছে। সামাজিক এবং গণযোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে হাজারো গুজব ছড়িয়ে দাঙ্গা লাগানোর চক্রান্ত করেও সুবিধা করতে পারেনি।
এখনো তারা থামেনি। অতিবৃষ্টির সুযোগ নিয়ে রাতের অন্ধকারে উজানে দেওয়া সকল বাঁধের গেইট খুলে দিয়েছে। এতে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১২টি জেলার লক্ষ লক্ষ মানুষকে নজিরবিহীন বন্যায় ভাসিয়েছে। সর্বস্তরের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, অন্তর্বতী সরকার গঠনের পর থেকেই দেশের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সাবেক ফ্যাসিস্ট সরকারের এজেন্টদের উসকানি দিয়ে মাঠে নামানো হয়েছে। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ও নানা দাবি-দাওয়ার ফিরিস্তি নিয়ে শাহবাগ, প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন, সচিবালয় ঘিরে বিক্ষোভ মিছিল যেন থামছেই না। ইতোমধ্যে পুলিশ, রেলওয়ে পুলিশ-কর্মচারী, গার্মেন্ট শ্রমিক, চৌকিদার-দফাদার, তথ্য আপা, ম্যাটস, আনসার, পল্লীবিদ্যুৎ, রিকশাওয়ালাসহ বিভিন্ন সেক্টরের লোকজন তাদের দাবি আদায়ের কর্মসূচি দিয়েছে। আরো যে কত সেক্টর সামনে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে তা হয়তো এই মুহূর্তে চিন্তাও করা সম্ভব না। এ কথা সত্য যে, যারা তাদের বঞ্চনার ইতিহাস সামনে রেখে নানা দাবি বাস্তবায়নের আন্দোলনে নেমেছে বা নামছে তাতে কমবেশি যৌক্তিকতা আছে। তবে একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের সাড়ে ১৫ বছর যখন তারা চুপ করে থাকতে পারল, তখন নতুন সরকারকে তারা কেন এক মাস সময়ও দিতে পারল না, প্রশ্নটা সেখানেই। আগের সরকার সকল সেক্টরে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, লুটপাট, অর্থপাচারের মাধ্যমে গোটা দেশটাকেই ধ্বংস করে গেছে। তখন যারা মুখ ফুটে একটি কথাও বলেনি বরং ফ্যাসিস্ট সরকারের সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে এখন তাদের সব বঞ্চনার দাবি নিয়ে তাড়াহুড়া করা মোটেই স্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়, এটা বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
যাহোক, সাবেক ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষকদের সকল চক্রান্ত এখন পর্যন্ত সফলভাবে মোকাবিলা করে স্বপ্নের আগামী বাংলাদেশ গঠনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে ছাত্র-জনতার মিলিত শক্তি। তাদের এই সফলতা ধারাবাহিক রাখতে হলে সামনে আরো বেশি সচেতন এবং কৌশলী হয়ে এগুতে হবে। কেননা, একের পর এক ষড়যন্ত্র করে ব্যর্থ হয়েও ভারত তার চক্রান্তের জাল বিস্তার কখনো থামাবে, সেই চিন্তা করা বৃথা। ১৯৪৭ থেকেই তারা বিরামহীনভাবে ষড়যন্ত্রের জাল বুনে যাচ্ছে, কখনো থামেনি। তাদের লোকসভার দেয়ালে গ্রেটার হিন্দুস্তানের যে মানচিত্র এঁকে রেখেছে সেখানে বাংলাদেশ নামের কোনো রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নেই। তাদের এই মানচিত্র পূরণ করতে হলে বাংলাদেশের অস্তিত্বকে বিলীন করতেই হবে; যে কথা কোনো রাখডাক না রেখেই বিজেপি এবং আরএসএস নেতারা প্রায়ই বলে থাকেন। এবারো তাদের মুখ থেকে বাংলাদেশে সরাসরি হামলা চালানোর দাবি করতে দেখা গেছে। কিন্তু আজকের বিশ্ববাস্তবতায় চাইলেই অন্য একটি দেশ দখল করা সহজ কোনো ব্যাপার নয়। সে কারণেই তারা সব সময় চায় এখানে অন্তত তাদের আজ্ঞাবহ সরকার থাকুক। আর আজ্ঞাবহ ও একান্ত অনুগত হিসেবে তাদের প্রথম এবং একমাত্র পছন্দের দল আওয়ামী লীগ। বিপ্লবের পর মুখে মুখে বা কটনীতির ভাষায় যাই বলুক না কেন, আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুতি তারা কোনোভাবেই হজম করবে না। বরং, সম্ভাব্য সকল সুযোগকে কাজে লাগাবে। বাঁধ ছেড়ে দিয়ে বন্যায় ভাসানোর পর হুট করে খাদ্যশস্য রপ্তানি বন্ধ করে দিতে পারে।
আমরা বিশ্বাস করি, ভারত যত ষড়যন্ত্র এবং চক্রান্তই করুক না কেন, দেশের ছাত্র-জনতা অতন্দ্রপ্রহরীর ভূমিকায় থেকে সেসব মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে। তবে তাদের সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা যে সহজ হবে তা কিন্তু নয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম তেমনই একটি জটিল এবং স্পর্শকাতর ক্ষেত্র। ইতোমধ্যে সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সক্রিয় হওয়ার আভাস-ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরের ইতিহাস এবং বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করলে এর সত্যতা অনুধাবন করা কিছুটা সহজ হবে। সেই সময় ভারত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বহু ষড়যন্ত্র করেছে। তার মধ্যে ‘শান্তিবাহিনী’কে মদদ দেওয়া ছিল অন্যতম। পাহাড়ি এলাকার দুর্গমতার সুযোগ নিয়ে শান্তিবাহিনী যথেষ্ট ভুগিয়েছে দেশ এবং দেশের মানুষকে। এই বাহিনীর সদস্য রিক্রুট থেকে শুরু করে তাদের দেরাদুনের সামরিক একাডেমিতে নিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া, অস্ত্র-গোলা-বারুদ সরবরাহ, ত্রিপুরা এবং মিজোরামের অভ্যন্তরে নিরাপদ শেল্টার, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কটনৈতিক সহযোগিতাসহ সবই দিয়েছে ভারত। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত এক চুক্তির মাধ্যমে যার আপাত অবসান হয়েছে। কিন্তু তার আগেই শান্তিবাহিনীকে মোকাবিলা করতে গিয়ে বাংলাদেশকে চড়া মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে। কথিত আছে, চুক্তির আগেই অন্তত ৩০ হাজার বাঙালিকে প্রাণ দিতে হয়েছে শান্তিবাহিনীর হাতে। সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি), আনসার-ভিডিপি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যে কত সংখ্যায় হতাহত-অপহরণের শিকার হয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন করে তেমনই পরিস্থিতি সৃষ্টির আলামত দেখা দিতে শুরু করেছে। বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে না নিলে অদূর ভবিষ্যতে তার মাশুল দিতে হবে।
শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়েছে মূলত শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলনের চূড়ান্ত ফসল হিসেবে। কিন্তু শুরু থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে। কারণ, সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের জন্য ৫ শতাংশ কোটা ছিল, যা ২০১৮ সালে সরকারের এক প্রজ্ঞাপনে বাতিল হয়ে যায়। এবার যখন জুন মাসে হাইকোর্ট সেই প্রজ্ঞাপন বাতিল করে কোটা ব্যবস্থাকে পুনর্বহাল করে তাতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি কোটাও আবার বলবত হয়ে যায়। এতে তারা খুশি হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যখন কোটা সংস্কারের ব্যাপারে আবারো আন্দোলন শুরু করে, তখন তারা নিজেদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি কোটা বহাল রাখার দাবিতে মিছিল-মিটিং করে। সারাদেশে যখন শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠে তখন অবস্থা বেগতিক দেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির শিক্ষার্থীরা নিশ্চুপ হয়ে যায়। কিন্তু ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর হঠাৎ করেই ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির কিছু শিক্ষার্থী নিজেদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী পরিচয় দিয়ে দেয়ালে দেয়ালে বিভিন্ন বিতর্কিত শ্লোগান সম্বলিত গ্রাফিতি আঁকতে শুরু করে। পাশাপাশি নানা রাজনৈতিক দাবিতে মিছিল-মিটিংও করছে। ইতিহাসের সাক্ষ্য হলো, এরা আসলে এমনই। এরা এই রাষ্ট্রের বড় পরিবর্তন এবং অর্জনগুলোর সাথে মোটাদাগে কখনই সম্পৃক্ত হতে পারেনি, বরং ইতিহাসের সন্ধিক্ষণগুলোতে সব সময়ই উল্টো স্রোতে গা ভাসিয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার হাজির হয়েছে নিজেদের স্বার্থের দাবিমালা নিয়ে। ১৯৪৭ সালে তারা ভারতের পতাকা উড়িয়েছে, ১৯৭১ সালে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অথচ, স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারের বয়স ২ মাস হওয়ার আগেই তারা স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি নিয়ে ধর্না দিয়েছে। ২০২৪ সালে এসেও তারা তাদের আগের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ রেখেছে। শুরুতে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের বিরোধিতা করেছে, শেষ দিকে নিশ্চুপ থেকেছে। যখন ছাত্র-জনতার বিপ্লব সফল হয়েছে, তখন আবার নিজেরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জামা গায়ে দিয়ে নিজেদের মনে দীর্ঘদিন ধরে লুকিয়ে তাকা বাসনা পূরণে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
ইতোমধ্যে পাহাড়ের স্বার্থান্বেষি কিছু চিহ্নিত মানুষ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির শিক্ষার্থীদের উসকানি দিয়ে সংঘটিত করছে এই বলে যে, ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি না দিয়ে রাষ্ট্র তাদের সাথে বৈষম্য করছে। তাই দেশে বৈষম্যবিরোধী বিপ্লব সফল হওয়ার পর তারা এখন এই বৈষম্যের অবসান চায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের বিপুল পরিমাণ ভুমি দখল হয়ে গেছে, সেসব ভূমি ফেরত না দিয়ে তাদের সাথে বৈষম্য করা হচ্ছে, এখন তারা এই বৈষম্যের অবসান চায়। সামরিক বাহিনীকে বৈষম্যের প্রতীক বানিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে তাদের প্রত্যাহারের পুরনো দাবি জোরদার করছে। একই সাথে সরকারি চাকরিতে আবারো ৫ শতাংশ কোটা নিশ্চিত করে বৈষম্য দূর করার দাবি জানাচ্ছে! এসব দাবিতে নতুন করে পাহাড়কে অস্থিতিশীল করার মতো লোকের অভাব পার্বত্য চট্টগ্রামে কখনোই ছিল না। এখনো আছে, বরং আগের চেয়ে বেশিই আছে। তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরের ইতিহাস পর্যালোচনা করে শান্তিবাহিনীর গঠন, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র-গোলা-বারুদ, শেল্টার, আন্তর্জাতিক সমর্থন যোগানোর ব্যাপারে ভারতের তৎরতার যে চিত্র পাওয়া যায়, ৫ আগস্টের পর সেই তারা যে আবারো একই প্রক্রিয়ায় নতুন করে যুক্ত হবে না বা হচ্ছে না, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। তাছাড়া ১৯৯৭ সালে চুক্তি হলেও ভারত কখনোই শান্তিবাহিনী এবং পিসিজেএসএসের মাথার উপর থেকে তাদের ছাতা সরিয়ে নেয়নি। কিছুদিন আগেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছবিসহ সংবাদ হয়েছে, মিজোরামের অভ্যন্তরে পিসিজেএসএসের সামরিক শাখা জেএলএ বাহিনী (চুক্তির পূর্বে ছিল শান্তিবাহিনী) ক্যাম্প করে অত্যাধুনিক অস্ত্রসহ সামরিক প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এর আগে দেখেছি, পার্বত্য চট্টগ্রামের আরেক সশস্ত্র গোষ্ঠি ইউপিডিএফের কেন্দ্রীয় নেতাদের আসামে নাগরিকত্ব নিয়ে বসবাস করার প্রমাণ। অন্যদিকে অতিসপ্রতি বান্দরবানে সক্রিয় কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির মূল ঘাঁটিও মিজোরামে। এখন শোনা যাচ্ছে, পিসিজেএসএস এবং ইউপিডিএফ সম্মিলিতভাবে পাহাড়কে নতুন করে অস্থিতিশীল করার একটা সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। আলামত এবং অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করে এর সঙ্গে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ইন্ধন থাকাটাকে অস্বাভাবিক ভাবার কোনো কারণ দেখছি না।
পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে দেশে যদি সত্যিই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয় তাহলে অন্তর্র্বতী সরকারের পক্ষে তা মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, পার্বত্য চট্টগ্রাম ‘গরিবের সুন্দরী স্ত্রীর মতো অনেকেরই ভাবী’। এখানে ভারতের স্বার্থ এবং সংশ্লিষ্টতা কারো অজানা নেই। আবার পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং তার সন্নিহিত ভারত-মিয়ানমারের পাহাড়ি অঞ্চল নিয়ে একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা ১৯৪৭ সালের আগে থেকেই ব্রিটিশদের ছিল, যা ‘কুপ ল্যান্ড প্ল্যান’ নামে পরিচিত। সে সময় তারা সফল না হলেও খ্রিস্টান মিশনারী, এনজিও এবং দাতা সংস্থার আবরণে তাদের পরিকল্পনা এগিয়ে নেওয়ার কাজে সবসমই সক্রিয় ছিল, এখনো আছে। ব্রিটিশদের এই পরিকল্পনায় আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং তাদের সমমনা দেশগুলোর সমর্থন-পৃষ্ঠপোষকতাও আছে। জাতিসংঘ এবং এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনও একই পরিকল্পনা দ্বারা প্রভাবিত। সেকারণেই দেখা যায়, ইউএনডিপি, অস্ট্রেলিয়ান এইড, ডানিডা, ইউরোপীয়ান ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠি পার্বত্য চট্টগ্রামে যেসব উন্নয়ন প্রকল্প বা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে তার পেছনে মূল টার্গেট থাকে পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নানাভাবে পৃষ্টপোষকতা দিয়ে শক্তিশালী করা। অন্যদিকে মিশনারীদের দিয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মানুষদের ধর্মান্তরিত করে খ্রিস্টানাইজেশনের গতিকে ত্বরান্বিত করা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় তারা অনেকটা সফলও হয়েছে। তাদের চেষ্টায় পাহাড়ের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির বিপুল সংখ্যক মানুষ ইতোমধ্যে খ্রিস্টান হয়েছে। তবে এ অঞ্চলে খ্রিস্টান রাষ্ট্র তৈরির পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে আছে সেখানে বসবাস করা বাঙালি মুসলমানরা। তাই তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালিদের ছলেবলে উচ্ছেদ করতে চায়। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই এর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালিদের সরিয়ে দেশের অন্য কোথাও পুনর্বাসনের প্রস্তাব দেয়া আছে। এমনকি এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়নের প্রতিশ্রুতিও দিয়ে রেখেছে তারা। শুধু তাই নয়, তারা তাদের লক্ষ্যপূরণে দেশের এনজিওগুলোকেও নিয়মিত ফান্ডিং করে, যার মাধ্যমে এনজিওকর্মী, দেশের মিডিয়া এবং তথাকথিত সুশীলদের মধ্যেও যথেষ্টসংখ্যক সমর্থক তৈরি হয়েছে। তার সাথে আছে বামপন্থী কিছু রাজনীতিকও। আরো আশঙ্কার কথা হচ্ছে, এই সমর্থকদের মধ্যে অনেকেই এখন অন্তর্র্বতী সরকারের অংশ। কেউ কেউ মনে করেন, শুধু অংশ নয়, বরং এই সরকারের মেজরিটিই তাদের নিয়ন্ত্রণে। ইতোমধ্যে তাদের কারো কারো বক্তব্য-কথাবার্তায় ‘আদিবাসী’ শব্দের উচ্চারণের মধ্য দিয়ে তার আভাসও পাওয়া গেছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যখন সংবিধান প্রণীত হচ্ছিল তখন সংসদে দাঁড়িয়ে পার্বত্য অঞ্চলের প্রতিনিধি হিসেবে এম এন লারমা বলেছিলেন, ‘আমি বাঙালি নই, আমি চাকমা।’ পরে অবশ্য তিনি নিজেদের ‘জুম্ম জাতি’ হিসেবে দাবি করে, পাহাড়ে স্বাধীন ‘জুম্ম ল্যান্ড’ গঠনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। জেএসএস এবং শান্তিবাহিনী গঠন করে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করেন সেই লক্ষ্যেই। দলীয় অন্তর্দ্বদ্বর শিকার হয়ে এম এন লারমা নিহত হওয়ার পর তার ছোট ভাই সন্তু লারমা শান্তিবাহিনী এবং পিসিজেএসএসের প্রধান হন। ১৯৯২ সালের ২৭ ডিসেম্বর তার জীবনের প্রথম সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের জাতীয় পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা উপজাতি নই, ক্ষুদ্র জাতি।’ সেই তিনি যখন ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, তখন নিজেদের জাতীয় পরিচয় হিসেবে ‘উপজাতি’ উল্লেখ করেই স্বাক্ষর করেন। চুক্তির আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংশ্লিষ্ট যেসব আইন সংশোধন, পরিমার্জন এবং প্রণয়ন হয়েছে তার প্রত্যেকটিতেই তারা নিজেদের পরিচয় ‘উপজাতি’ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। বান্দরবানের প্রয়াত বোমাং সার্কেল চিফ অং শৈ প্রু চৌধুরীর একটি বক্তব্য এখনো ইউটিউবে পাওয়া যায়। যেখানে ক্যামারার সামনে তিনি বলেছেন, ‘আসলে আমরা আদিবাসী নই। আমাদের পূর্বপুরুষ বার্মা থেকে এখানে এসেছিল।’ ওয়ান-ইলেভেনের সকারের সময় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়। সেই সময় পার্বত্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই।’ কিন্তু সেই তারাই এখন নিজেদের ‘আদিবাসী’ দাবি করছে। এর কারণটি হলো, ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে ‘আদিবাসী’ বিষয়ক যে ঘোষণা গৃহীত হয়েছে, তাতে এটা নিশ্চিত যে কোনো জনগোষ্ঠি যখন ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে তারা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার পাবে, সেখানকার ভূমি উপর তাদের শতভাগ নিয়ন্ত্রণ থাকবে, খনিজ সম্পদ তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে, সর্বোপরি সেনাবাহিনীর অবস্থান করা না করাও হবে তাদের ইচ্ছাধীন। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব বলে সেখানে কিছু থাকবে না, সবকিছুই হবে তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ভিত্তিতে। এর কোনো ব্যত্যয় ঘটলে জাতিসংঘ সেখানে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারবে।
এবার চিন্তা করার বিষয় হচ্ছে এম এন লারমা পিসিজেএসএস এবং শান্তিবাহিনী গঠন করে বিদ্রোহী হয়েছিলেন স্বাধীন ‘জুম্ম ল্যান্ড’ করার লক্ষ্যে। সেই থেকে এই সশস্ত্র গোষ্ঠিটি নানা চড়াই-উৎড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে গেলেও তাদের লক্ষ্য থেকে পিছপা হয়নি। ধাপে ধাপে অস্ত্রবিরতি, সরকারগুলোর সাথে ধারাবাহিক আলোচনা, চুক্তি সবই তাদের সেই পরিকল্পনার অংশ। কারণ, চুক্তির আগেই তারা ৩০ হাজার বাঙালিকে হত্যা করেছে। চুক্তির অনুযায়ী তাদের হাতে থাকা সকল অস্ত্র জমা দিয়ে শান্তির পথে আসার কথা থাকলেও তারা সেটা কখনো করেনি। বরং চুক্তির পর শান্তিবাহিনীর প্রধান জ্যোতিরিন্দ্রবোধিপ্রিয় লারমা প্রকাশ সন্তু লারমা ১৯৯৯ সালের ১২ মে থেকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় গত ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন। অন্যদিকে তিনি নিজের মুখে টিভি ক্যামেরার সামনে স্বীকার করেছেন, ২০০০ সাল থেকেই তার অনুগত সশস্ত্র সদস্যরা পাহাড়ে সক্রিয় আছে! শুধু যে আছে তাই নয়, বরং চাঁদাবাজি, গুম, খুন, অপহরণসহ সকল ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম করছে। এটাকে শান্তির নমুনা হিসেবে ভাবা কীভাবে সম্ভব? আসলে তারা ‘গাছেরটাও খাচ্ছেন, তলারটাও কুড়াচ্ছেন।’ সেই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করার অনুকূল সময়ের জন্য ওৎপেতে আছেন। হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারতের বাংলাদেশবিরোধী মনোভাব তাদের সেই সুযোগের পালে নতুন হাওয়া হয়ে আসতে যাচ্ছে বলেই মনে করছেন তারা। এখন যদি দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গোষ্ঠির চাপ, এনজিও, মিডিয়া এবং বামপন্থীদের মধ্যে থাকা তাদের সমর্থকদের দিয়ে সরকারকে রাজি করিয়ে নিজেদের ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি আদায় করে নিতে পারেন তাহলে পূর্বতিমুর কিংবা দক্ষিণ সুদানের মতো স্বাধীনতা লাভের রাস্তাটা সহজ হয়ে যায়। আর যদি সেটা সম্ভব না-ও হয় তাহলে ভারত তো তাদের পাশে আছেই।
ভারত তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়াতে পারে কয়েকটা কারণে। আর তা হলো শেখ হাসিনা পরবর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল রেখে অনুগত করার চেষ্টা। সেভেন সিস্টার্সের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা থেকেও তারা এটা করতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অস্থিতিশীল কিংবা বিচ্ছিন্ন হলে বাংলাদেশ দুর্বল হবে। আর তাতে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের বিপরীতে তাদের প্রতিবিপ্লব কার্যকর হবে, যা এর আগে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরেও তারা করেছে। আর সেই কারণেই উত্তপ্ত করা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামকে। অতএব, যারা অন্তর্র্বতীকালিন সরকারে আছেন এবং যারা সরকারের পৃষ্ঠপোষক তাদের বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। তাদের এটাও মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগের চেয়েও ভয়ঙ্কর পিসিজেএসএস এবং পাহাড়ের সন্ত্রাসী গোষ্ঠিগুলো। তার প্রমাণ হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ছিল সাড়ে ১৫ বছর, কিন্তু জেএসএস প্রধান সন্তু লারমা ক্ষমতায় আছে ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ধরে রাখতে কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করেছে, কিন্তু পাহাড়ে পিসিজেএসএস চুক্তির আগেই ৩০ হাজার বাঙালিকে হত্যা করেছে। গত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের ভয়ে কোনো রাজনৈতিক দল সারাদেশে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। অথচ, পার্বত্য চট্টগ্রামে পিসিজেএসএস এবং ইউপিডিএফের মতো সশস্ত্র গোষ্ঠিগুলোর ভয়ে আওয়ামী লীগ বহু জায়গায় নির্বাচনে প্রার্থী দেয়ার মতো লোক পায়নি। বরং তাদের ভয়ে দলে দলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। অতএব, পাহাড়ের বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিলে তা নিতে হবে গভীর বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমেই। (লেখক : সাংবাদিক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক)।

দারুল আরকাম প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নত জাতি গঠনে কাজ করছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ——বোরহান উদ্দিন উন্নয়নমূখী পার্বত্য চট্টগ্রাম গড়তে হলে প্রশিক্ষণের প্রকৃত জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে —-এ কে এম মকছুদ আহমেদ প্রশিক্ষণের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে আপনারা শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন ——মুহাম্মদ ইকবাল বাহার চৌধুরী

Archive Calendar
Mon Tue Wed Thu Fri Sat Sun
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
252627282930