তিনি বলেছেন, এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে স্বাধীন বিচার বিভাগকে ঝুঁকি ও অবৈধ হস্তক্ষেপের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে, যা আইনের শাসনকে বিপন্ন করেছে।
উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নেওয়া অবৈধ ঘোষণা করে হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরিয়া হিসেবে একথা বলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী কামাল হোসেন।
দুই বছর আগে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনের মাধ্যমে এই পরিবর্তন আনার পর নয়জন আইনজীবী এর বিরুদ্ধে রিট আবেদন করেন। গত বছর হাই কোর্টের দেওয়া রায় এই সংশোধন বাতিল করা হয়।
এর আপিলের শুনানিতে সর্বোচ্চ আদালত কামাল হোসেনসহ ১২ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে অ্যামিচি কিউরি নিয়োগ দেয়।
রাষ্ট্র ও আবেদনকারী পক্ষের যুক্তি উপস্থাপনের পর গত সপ্তাহে অ্যামিচি কিউরিদের বক্তব্য শোনা শুরু করে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ।
সোমবার নবম দিনের শুনানিতে কামাল হোসেন ছাড়াও বক্তব্য রাখেন এ এফ হাসান আরিফ, আব্দুল ওয়াদুদ ভূইয়া ও আজমালুল হোসেন কিউসি।
কামাল হোসেনের মতো হাসান আরিফ ও ওয়াদুদ ভূঁইয়াও মনে করেন, ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়েছে।
এই সংশোধনীটি আইনত বৈধ বলেছেন আজমালুল হোসেন। তার বক্তব্য অসমাপ্ত থাকার মধ্যে মঙ্গলবার পর্যন্ত শুনানি মুলতবি হয়েছে।
কামাল হোসেন শুনানিতে বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ। সুপ্রিম কোর্ট বেশ কয়েকটি রায়ে তা বলে দিয়েছে। এর মধ্যে অষ্টম সংশোধনী, মাসদার হোসেন ও ইদ্রিসুর রহমান মামলার রায়ে এ বিষয়ে বলা হয়েছে।
“হাই কোর্ট ষোড়শ সংশোধনীকে বাতিল ও অবৈধ বলে যে রায় দিয়েছে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে এ রায়কে আমি পুরোপুরিভাবে সমর্থন করছি।”
হাই কোর্ট বিভাগের এক বিচারক ষোড়শ সংশোধনী মামলার মূল রায়ে দ্বিমত পোষণ করে একমাত্র পাকিস্তানে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান থাকার যে কথা বলেছিলেন, তা সম্পূর্ণ ভুল ধারণাপ্রসূত বলে মন্তব্য করেন কামাল হোসেন।
তিনি বলেন, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা, হংকং, জার্মানি, সুইডেন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইসরাইল, জাম্বিয়া, ত্রিনিদাদ ও টোবাকোসহ বিভিন্ন দেশে বিচারক অপসারণের সংক্রান্ত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল অথবা অনুরূপ পদ্ধতি রয়েছে।আপিল আদালতকে ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক হিসেবে বাতিল করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে কামাল হোসেন বলেন, ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদকে বলা হয়েছে সংবিধানের মৌলিক নীতির একটি। এখানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, যা থাকবে রাষ্ট্রের অন্য দুটি অঙ্গের হস্তক্ষেপমুক্ত, যা সংবিধানের ৯৪ (৪), ১৬ (ক), ১৪৭ অনুচ্ছেদেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
“এখানে (বাংলাদেশে) বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য জনগণের একটি ঐতিহাসিক সংগ্রামের নজির রয়েছে।”
সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায়ের উল্লেখ করেন তিনি; ওই রায়ে বলা হয়েছে, গণতন্ত্র, প্রজাতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতার পৃথকীকরণ, স্বাধীন বিচার বিভাগ, মৌলিক অধিকার হল সংবিধানের মৌলিক কাঠামো।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সংবিধানে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই ছিল, যে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন কামাল হোসেন।
বঙ্গবন্ধু আমলে ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনের সময় ওই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়, তখন কামাল হোসেন ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। পরে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসে সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনী এনে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করেন।
কামাল হোসেন বঙ্গবন্ধুর আমলেই বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতাটি সংসদ থেকে প্রত্যাহার করার বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে রায় দেওয়া হলেও এই ব্যবস্থা রেখে দেওয়া হয়েছে। ওই রায়ে বলা হয়েছে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল একটি স্বচ্ছ পদ্ধতি।
“ষোড়শ সংশোধনী স্বাধীন বিচার বিভাগকে ক্ষুণ্ন করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে, যা দেশের বিচার বিভাগকে ঝুঁকি ও অবৈধ হস্তক্ষেপের মুখে ফেলেছে। আইনের শাসনকে বিপন্ন করেছে।”
এই প্রসঙ্গে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের দলের বিপক্ষে ভোট দিতে না পারার অক্ষমতার বিষয়টিও তুলে ধরেন সাবেক মন্ত্রী কামাল হোসেন।
তিনি বলেন, “বিচারক অপসারণের ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যরা নিরপেক্ষ ও উন্মুক্তভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন কি না, সে প্রশ্ন ওঠে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও চাপের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সংসদের মাধ্যমে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া বিচার বিভাগকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।”
আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া
সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলকে সমর্থন জানিয়ে ওই কাউন্সিল গঠনের ক্ষমতাও প্রধান বিচারপতির হাতে রাখার পক্ষে অবস্থান জানিয়েছেন আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া।
শুনানিতে তিনি বলেছেন, “সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের ক্ষমতা প্রধান বিচারপতির হাতে থাকতে হবে। যদি এটা সংসদের হাতে দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে ভারসাম্য নষ্ট হবে।
“ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে দুটি জিনিস করা হয়েছে। এক. বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। দুই. সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ (২) লঙ্ঘন করে এ সংশোধনী করা হয়েছে। ফলে ষোড়শ সংশোধনীটি অবৈধ।”
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ (২) এ বলা হয়েছে– জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে৷
ওয়াদুদ ভূঁইয়া বলেন, “পঞ্চদশ সংশোধনীর পর সংবিধানে কিছু মার্শাল ল ইনস্ট্রমেন্ট থেকে থাকলেও সংসদে পাশ হওয়ার পর এটি সংসদেরই আইন হয়ে গেছে। আর পঞ্চম সংশোধনীর কারণে সংসদে আইন পরিবর্তন করার ক্ষমতা সীমিত।”
হাসান আরিফ
সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল হাসান আরিফ শুনানিতে বলেন, শুধু বিচারকদের প্রয়োজনে নয়, জনগণের অধিকার সুরক্ষার জন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রয়োজন।সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায়ে স্বাধীন বিচার বিভাগকে সংবিধানের ‘বেসিক স্ট্রাকচার (মৌলিক কাঠামো)’ বলার নজির তুলে তিনি বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা মৌলিক অধিকারও বটে।
“কেউ যদি আদালতের সামনে উপস্থিত হয়, আদালত যেন স্বাধীনভাবে বিচার করতে পারে। সংসদ বা নির্বাহী বিভাগের চাপে পড়ে যেন জনগণের অধিকার ক্ষুণ্ন না হয়।”
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়েছে মন্তব্য করে হাসান আরিফ বলেন, “এর ফলে বিচার বিভাগকে সংসদের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। আজকে সংসদ এবং সরকার এক। যেহেতু একই সদস্য দিয়ে কেবিনেট ফর্ম করেছে। সুতরাং সেক্ষেত্রে সেপারেশন অব পাওয়ার পুরোপুরি এখানে লঙ্ঘন ঘটছে।
“একমাত্র বিচার বিভাগকে যদি আমরা এর বাইরে রাখি, তবেই একমাত্র সেপারেশন অব পাওয়ারটা থাকে। আর সেপারেশন অব পাওয়ারটা যদি না থাকে, তাহলে জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা হবে না।”
বিচারক অপসারণের পদ্ধতির ক্রমবিকাশ নিয়ে তিনি বলেন, “সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আসল পার্লামেন্টের যে ক্ষমতা সেটিকে সরিয়ে দিয়ে নয়; রাষ্ট্রপতিকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল, সেটা বাতিল করে।
“এটা একটা ভুল ধারণা যে পার্লামেন্টের ইমপিচমেন্টের ক্ষমতা মার্শাল ল এসে সরিয়ে দিয়েছে, এটা ঠিক না। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিলো বিচারকদের অপসারণের। মার্শাল ল এসে সেই ক্ষমতাটা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে দিয়েছে।”
আদালতের রায়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল রাখার বিষয়টি তুলে ধরে হাসান আরিফ বলেন, “যে বিষয়টি দুই বার আদালতের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেটিকে সংশোধন করার এখতিয়ার তাদের (সংসদ) নেই।”
আজমালুল হোসেন কিউসি
আজমালুল হোসেন কিউসি শুনানিতে বলেন, সংসদের হাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা দিয়ে যে সংশোধনী আনা হয়েছে এটি কার্য়কর সংশোধনী এবং একইসঙ্গে এটি বৈধ আইন হিসেবে বিবেচিত।
ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে তা বিচার বিভাগকে উপলব্ধি করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এর সঙ্গে তাদের স্বার্থের বিষয়টি সরাসরি জড়িত।
তখন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেন, বিচার বিভাগ কখনও বিচারকদের স্বার্থে রায় দেয় না। রায় দেওয়া হয় জনগণ ও বিচার বিভাগের স্বার্থে। সংবিধান ও আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখতেই রায় দেওয়া হয়।
“এখানে বিচারকদের ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ নেই। তবে এই মামলার রায় কী হবে, আমরা জানি না। এখনও সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।”
আজমালুল হোসেন বলেন, “কীভাবে বিচারক অপসারণ করা হবে সে বিষয়টি এই মামলার সঙ্গে জড়িত। একটি মৌলিক প্রশ্ন হল-বিচারক অপসারণের পদ্ধতি কে নির্ধারণ করবে? উত্তর হচ্ছে, অবশ্যই সংসদ। আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে, কে এই পদ্ধতির আইনগত বৈধতা দেবে? উত্তর, অবশ্যই সুপ্রিম কোর্ট।
“স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, একজন বিচারক নিজের মামলার বিচার কি নিজেই করবেন? অথচ এই মামলায় বিচার বিভাগের স্বার্থ জড়িত। তাই এ মামলায় সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে খুবই সতর্ক থাকতে হবে।”
ষোড়শ ষংশোধনীর মাধ্যমে আদি সংবিধানে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই সংশোধনী অবশ্যই আইনত বৈধ। কানাডায় এ ধরনের পদ্ধতিতে বিচারক অপসারণ করা হয়।”
আজমালুল হোসেন বলেন, বিচারক অপসারণটা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ কিন্তু অপসারণের পদ্ধতিটা মৌলিক কাঠামোর অংশ না।
“সংসদের হাতে বিচারক আপসারণের যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা পরিবর্তনের দরকার নেই।”