॥ নন্দন দেবনাথ ॥ রাঙ্গামাটির মানুষ এখন আকাশে মেঘ দেখলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। মানুষের মাঝে মৃত্যু আতংক এতো বেশী বেড়েছে যে, আকাশে মেঘ দেখার সাথে সাথে পাহাড়ের খাদে বসবাস করা মানুষ নিরাপদ স্থানে সরে যাচ্ছে। তার মাঝে গতকাল দিন ভর রাঙ্গামাটিতে থেমে থেমে বৃষ্টি পাতে আবারো ভ’মি ধ্বসের আশংকা করা হচ্ছে। দিন ভর থেমে থেমে বৃষ্টির ফলে আশ্রয় কেন্দ্র গুলোতে দুর্গত মানুষের সংখ্যা দিন দিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে। বর্তমানে রাঙ্গামাটি শহরে ১৯ টি আশ্রয় কেন্দ্রে ২ হাজারের বেশী মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।
পার্বত্য রাঙ্গামাটি জেলায় স্মরণকালের ভয়াবহ ভূমি ধসে স্বজন ও সহায়-সম্পদ হারানো লোক গুলো আবারও বৃষ্টি বা পাহাড় ধসের শঙ্কার পাশাপাশি কিভাবে বিধ্বস্ত ভিটেবাড়িতে নতুন করে বাঁচার লড়াই শুরু করবেন, তা ভেবে আঁতকে উঠছেন তারা। ফের পাহাড় ধস হতে পারে- এমন আশঙ্কায় দিন কাটছে অসহায় মানুষদের।
রাঙ্গামাটি অবস্থা নিয়ে চলছে হাহাকার ও আহাজারি। পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ যে, প্রশাসনের সবকটি সংস্থা একযোগে মাঠে নামলেও অরণ্যের এসব এলাকার পরিস্থিতি স্বল্প সময়ে স্বাভাবিক করা রীতিমতো কষ্ঠ পেতে হচ্ছে। তবে মানুষের আন্তরিকতার ঘাটতিও নেই, কমতিও নেই। পাহাড়ী-বাঙালী, সেনা, সিভিল প্রশাসন, পাহাড়ী রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক দল ও সংস্থার সদস্যরা সকলেই দুর্যোগ থেকে উত্তরণে প্রাণান্তকর প্রয়াসে কাজ করে যাচ্ছে।
৫০ শয্যার রাঙ্গামাটি সদর হাসপাতালে সৃষ্টি হয়েছে রীতিমতো মানবিক বিপর্যয়। ধারণ ক্ষমতার প্রায় চারগুণ চিকিৎসা প্রার্থীর ভিড়ে হাসপাতাল ও এর চত্বরজুড়ে চলছে নারী-পুরুষের আর্তনাদ। আর যারা প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন তাদের নিত্যদিনের জীবন ব্যবস্থায় বিপর্যয় নিয়েই বেঁচে থাকার নতুন সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছেন। কিন্তু সঙ্কটের তো শেষ নেই। বেঁচে থাকার সবকটি উপকরণের তীব্র সঙ্কট। আর যারা বাড়িঘর সহায়-সম্পদ হারিয়েছেন তারা জীবনের তরে রীতিমতো পঙ্গুত্বের শিকার হয়েছেন। এখন লোকজন বলছে খাবার দাবার অনেক পেয়েছি আমরা। কবে নাগাত আমরা আমাদের বাড়ী ঘরে ফিরতে পারবো। সরকার আমাদের যদি এই ব্যাপারে একটি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতো তাহলে আমাদের অনেক উপহার হতো। ক্ষতিগ্রস্থ মানুষেরা সহযোগিতা পাওয়ার পর পুনরায় আগের অবস্থায় ফিরে আসা তাদের জন্য কঠিন যে হবে তা নিয়ে চিন্তিত।
এদিকে গতকাল রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান বলেন, আশ্রয় কেন্দ্রে আগত লোকজনকে খাবার সহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌছে দিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রিতদের নিয়মিত খাবার ও পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এজন্য প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে কার্যক্রম চলছে। পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। আগামী দুই দিন যদি বৃষ্টি না দেয় তাহলে পরিস্থিতি আরো স্বভাবিক হয়ে আসবে বলে তিনি আশা আশা প্রকাশ করেন।
আবার পাহাড় ধসের আশঙ্কায় ঝুঁকিতে বসবাসকারী লোকজনকে দ্রুত নিরাপদে সরে যেতে সতর্ক করা হচ্ছে। এজন্য মাইকিং অব্যাহত রয়েছে। রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন সড়কে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। রাস্তা সচল করতে অপসারণসহ সংস্কারকাজ চলছে। এতে সেনাবাহিনীর একটি শক্তিশালী টিমও অংশ নিচ্ছে। এলজিইডি এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগ রাস্তা মেরামত ও সংস্কারকাজ করছে। খুব শিগগির চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়কে সমায়িকভাবে যান চলাচল উপযোগী হয়ে উঠবে।
অপরদিকে দুর্যোগের ৬ দিন পরও বাইরের সঙ্গে রাঙ্গামাটির সড়ক যোগাযোগ এখনও বিচ্ছিন্ন। বিকল্প যোগাযোগ হিসেবে রাঙ্গামাটি-কাপ্তাইয়ে পানি পথে তিনটি লঞ্চ সার্ভিস শুক্রবার হতে চালু করা হয়েছে। পণ্য পরিবহনের জন্য সম্পূর্ণ বিনা খরচে রাঙ্গামাটির যে কোন ব্যবসায়ী কাপ্তাই থেকে পণ্য সামগ্রী রাঙ্গামাটিতে নিয়ে আসতে পারবে বলে জানিয়েছেন রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান।
রাঙ্গামাটি লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি মোঃ মঈন উদ্দিন সেলিম জানান রাঙ্গামাটিতে পাহাড় ধ্বসের ঘটনায় দুই এক দিন দূর্ভোগ থাকলেও বর্তমানে অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। জেলা প্রশাসনের তরিৎ ব্যবস্থার কারণে রাঙ্গামাটি জেলার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। গতকাল রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান ও পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসান রাঙ্গামাটির লঞ্চ ঘাটে এসে যাত্রীদের সাথে কথা বলেছেন এবং তাদের খোঁজ খবর নিয়েছেন। তিনি বলেন জেলা প্রশাসকের নির্দেশে আমরা আরো দুটি লঞ্চ বাড়িয়ে দিতে প্রস্তুত রয়েছি।
এদিকে রাঙ্গামাটির সাম্প্রতিক দূর্যোগ পরবর্তী বাজারের দ্রব্যমুল্য নিয়ন্ত্রণ ও বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে জেলা প্রশাসন ৪ টি বাজার মনিটরিং সেল ও অভিযোগ কেন্দ্র গঠন করা হয়েছে। এছাড়া রাঙ্গামাটিতে জ্বালানী তেলের সংকট নেই। ৩০ হাজার লিটার তেল ইতিমধ্যে সরবরাহ করা হয়েছে। তেলের পাম্প সমূহে আরো তেল সংগ্রহের প্রক্রিয়া চলছে।
আমাদের কাপ্তাই সংবাদদাতা জানান, রাঙ্গামাটিতে ভূমি ধসে ক্ষতিগ্রস্ত দুর্গত পরিবারের মধ্যে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি জরুরি ত্রাণ ও চিকিৎসাসেবা শুরু করেছে নৌবাহিনী। আইএসপিআর জানায়, রাঙ্গামাটিতে ব্যাপক ভূমি ধসের ঘটনায় বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় নিত্যপণ্য সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়। এতে সেখানকার স্থানীয় লোকজন চরম খাদ্য, পানীয় এবং চিকিৎসা সংকটে পড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নৌবাহিনী গত শুক্রবার থেকে কাপ্তাই এলাকার ব্যাঙছড়ি, ছিটমোড়ল, শিলছড়ি, বড়ইছড়ি, চন্দ্রঘোনা ও রায়পুরা এলাকায় জরুরি ত্রাণসামগ্রী ও চিকিৎসা সহায়তা প্রদান শুরু করে। ইতিমধ্যে ৫০০ পরিবারের মাঝে তাজা ও শুকনা খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করা হয়েছে। প্রতিটি তাজা খাদ্যসামগ্রীর প্যাকেটে রয়েছে চাল ৫ কেজি, ডাল ১ কেজি, আলু ২ কেজি, পেঁয়াজ ১ কেজি, সয়াবিন তেল ১ লিটার, বিশুদ্ধ খাবার পানি ৪ লিটার, ম্যাচ ১ ডজন, মোমবাতি ১ ডজন, লবণ ১ কেজি ও শুকনা মরিচ। এ ছাড়া শুকনা খাবারের প্রতিটি প্যাকেটে রয়েছে চিঁড়া ৩ কেজি, বিস্কুট ১ কেজি, গুড় ২ কেজি, মুড়ি ১ কেজি, ম্যাচ ১ ডজন, মোমবাতি ১ ডজন ও বিশুদ্ধ খাবার পানি ৪ লিটার। এ ছাড়া ভূমি ধসের ঘটনার পরপরই নৌবাহিনীর ডুবুরি দলসহ একাধিক উদ্ধারকারী দল উদ্ধার অভিযানে অংশগ্রহণ করে। উদ্ধার কাজের পাশাপাশি দুর্গত এলাকায় জরুরি চিকিৎসা সহায়তার জন্য নৌবাহিনীর ১০ সদস্যের একটি বিশেষ মেডিকেল টিম কাজ করছে। তারা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও খাবার স্যালাইন বিতরণের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। দুর্যোগ পরিস্থিতির উন্নতি না