মাহের ইসলাম: সকাল বেলায় একটা ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিন শট দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম ! আবার !!! আরেকটি লংগদুর অবতারনা হতে যাচ্ছে না তো ?
আমারই বা দোষ কি ? ঘর পোড়া গরু তো সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাবেই; আমার নিজের ঘর না পুড়ুক, অন্যের ঘর পোড়ার ভয়াবহতা তো এখনো চোখের সামনে জ্বলমান। আগুনে সর্বস্ব হারিয়ে, রাতারাতি নিঃস্ব হওয়া মানুষের চোখের কান্নার জল এখনও থামেনি। তাই, মধ্যরাতে কোন গণ্যমান্য ব্যক্তি যদি তার ফেসবুকে পোস্ট করে যে, অমুক গ্রামে শতাধিক সেটলার সংবদ্ধভাবে হামলা চালাচ্ছে, গ্রামটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে লুটপাট চালানো হয়েছে। বা, অমুক গ্রামটিতে চলছে নির্বিচার হামলা, মারধোর আর লুটপাট। সেটেলারদের সাথে এইসব হামলায় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও অংশ নিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে স্থানীয়রা,গ্রামের মানুষজন প্রাণভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছে,আপনারাই বলেন, তখন ভয় না পাওয়ার বিন্দুমাত্র কোন কারণ থাকতে পারে ? সবার জানার স্বার্থে সেই পোস্ট টা হুবহু তুলে ধরলাম।
(“একটু আগে মাত্র খবর পেয়েছি খাগড়াছড়ির জেলার রামগড় উপজেলার ১নং সদর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের অন্তর্গত সৌনায়া গা ও ব্রত চন্দ্র কার্বারী পাড়াতে পাশ্ববর্তী কালাঢেবা নামক এলাকা থেকে শতাধিক সেটলার সংবদ্ধভাবে হামলা চালাচ্ছে। এই গ্রামগুলিতে ত্রিপুরা আদিবাসীদের বাস। রাত এগারোটার দিকে সৌনায়া গা গ্রামটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে লুটপাট চালানো হয়েছে এবং এগারোটার দিকে ব্রত চন্দ্র কার্বারী গ্রামটিতে চলছিল নির্বিচার হামলা, মারধোর আর লুটপাট। সেটেলারদের সাথে এইসব হামলায় স্থানীয় চৌচালা বিজিবি ক্যাম্প থেকে বিজিবি সদস্যরাও অংশ নিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে স্থানীয়রা।
গ্রামের ত্রিপুরা আদিবাসী মানুষজন প্রাণভয়ে পালাচ্ছে বাড়িঘর ছেড়ে।“)
এমন একটা পোস্ট যদি কোন গণ্যমান্য ব্যক্তি গভীর রাতে তার ফেসবুকে দেয়, আপনারাই বলেন, ভয় না পাওয়ার বিন্দুমাত্র কোন কারণ থাকতে পারে ?
যাই হোক, সাথে সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করলাম; ঐ অঞ্চলের যার কাছ থেকেই কিছু না কিছু তথ্য পাওয়া যেতে পারে, তাদের সাথে। যা জানলাম, তাতে আমার ভয় দূর হয়ে গেলো। কিন্তু একটু পরেই, এক নতুন এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের ভয় আমাকে গ্রাস করে ফেললো। আর তা হল এই ঘটনা নিয়ে আবার শুরু হবে অপরাজনীতি।তাই আঞ্চলিক ভাবে পাওয়া তথ্য হুবহু তুলে ধরলাম।
যা জানতে পারলাম, তা হলো, গত্ রাতে ( ৩০ জুন ২০১৭) আনুমানিক রাত সাড়ে দশটার দিকে কয়েকজন সশস্ত্র পাহাড়ি সন্ত্রাসী রামগড়ের কালাডেবাতে (প্রধানত বাঙালী অধ্যুষিত) এসে কয়েকজন বাঙালীর কাছে চাঁদা দাবী করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে, কালাডেবার অন্য বাঙালীরা এবং পার্শ্ববর্তী লামকোপাড়ার (প্রধানত বাঙালী অধ্যুষিত) বাঙালীরা একত্রিত হয়ে তাদেরকে ধাওয়া করে। সন্ত্রাসীদের ধাওয়া করতে করতে তারা সোনাইয়াগা ( ত্রিপুরা এবং মারমা অধ্যুষিত ) এর মধ্যে দিয়ে বড় চন্দ্র কারবারিপাড়া ( ত্রিপুরা অধ্যুষিত) পর্যন্ত চলে যায়। কিন্তু কাউকে ধরতে ব্যর্থ হয়। চাঁদাবাজরা পালানোর সময় কয়েক রাউন্ড গুলি করে, তবে কেউ হতাহত হয়নি। এই ধাওয়ার সময় ঐ এলাকার পাহাড়িরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। কয়েকজন বাঙালির অভিযোগ থেকে আর ও জানা যায় যে, কয়েকদিন আগেই তাদের কাছে ইউ পি ডি এফ এর সন্ত্রাসিরা চাঁদা দাবি করে বলেছিল, চাঁদা না দিলে এলাকায় থাকতে দিবে না; এমনকি বাঙালি মেয়েদের তুলে নেওয়ারও হুমকি দিয়েছিল। ইত্যবসরে, বাঙালীদের কাছ থেকে সশস্ত্র চাঁদাবাজদের সংবাদ পেয়ে বি জি বি সদস্যরা উপস্থিত হয়। তারা উত্তেজিত সকলকে আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে, বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত রাখে। ফলে, ঘটনা অন্য কোন দিকে মোড় নেয়নি। রাত প্রায় ১২ টার দিকে, পুরো এলাকায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরতে শুরু করে।
আজ(১ জুলাই ২০১৭) প্রায় সকাল সাড়ে ১১ টার দিকে, সোনাইয়াগা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে এলাকার জনগণ এক মিটিং করে, যেখানে পাহাড়ি এবং বাঙালি সবাই ছিলো। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, চাঁদা দিবে না, চাঁদাবাজদের প্রতিরোধ করবে এবং ঐ এলাকায় একটি আর্মি অথবা বি জি বি ক্যাম্প স্থাপনের দাবিও জানিয়েছে।
অনেকেই মনে করতে পারেন, একটু চাঁদা চাইতে এলেই এভাবে উত্তেজিত হওয়ার কি আছে ? আসলেই তাই, শুধুমাত্র একদিন বা একবার চাঁদা চাইলে সম্ভবত কস্মিনকালে ও গতকালের ঘটনার পুনরাবৃত্তি অসম্ভব। তাহলে ? যারা এমনটি ভাবছেন, তাদের কথা ভেবে আমার লেখাটাকে একটু লম্বা করতে দ্বিধায় পড়ে গেলাম।
যাই হোক, বিষয়টি সংক্ষিপ্ত ভাবে খোলাসার চেষ্টা করে দেখতে পারি।
রামগড় এলাকায় উপজাতীয় সশস্ত্র সন্ত্রাসীদল ইউ পি ডি এফের দৌরাত্ম্য একটু বেশি, একথা যারা জানেন না, শুধুমাত্র তাদের জ্ঞাতার্থে অতি সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করছি (শুধুমাত্র রামগড়ের, জুন মাসের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে)
৫ জুনঃ ইউপিডিএফের ডাকে অবরোধ চলাকালে খাগড়াছড়ির রামগড়ে অবরোধকারীদের পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ ও পুলিশের পাল্টা ১৫ রাউন্ড শর্টগানে গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। অবরোধ থেকে ২টি সিএনজি, ও ১টি মাহেন্দ্র, ১টি ট্রাক ও ১টি নৈশকোসের গ্লাস ভাংচুর করে এতে কয়েকজন যাত্রী আহত হয়।
৭ জুনঃ কোন কর্মসূচি ছাড়াই ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) কর্মীরা বুধবার দুপুরে আকস্মিকভাবে খাগড়াছড়ির রামগড়ে বেপরোয়া গাড়ি ভাংচুর ও মানিকছড়িতে গাড়িতে অগ্নি সংযোগ করে পুড়িয়ে দিয়েছে। এ ঘটনায় এলাকায় বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। ইউপিডিএফ’র তাণ্ডবে ২৫টি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত ও কয়েকজন আহত হয়েছে। ২৫টি গাড়ির মধ্যে ২৪টি গাড়ি ভাংচুর ও একটিতে আগুন দিয়েছে সন্ত্রাসীরা।…… হামলায় বাসের কয়েকজন যাত্রীও আহত হয়।
০৯ জুন: চাঁদা দিতে দেরী হওয়াতে জেলার রামগড়ের পাতাছড়া ইউনিয়নের দুর্গম দক্ষিণ বালুখালী এলাকায় দিন দুপুরে দুই ধাপে প্রায় দুই শতাধিক রাবার গাছ কেটে ফেলেছে উপজাতী সন্ত্রাসীরা। ক্ষতিগ্রস্থ বাগান মালিকরা জানান, এর আরো তিন মাস আগেও প্রায় দেড় শতাধিক গাছ কেটে দিয়েছিলো। তাঁরা জানান, দীর্ঘদিন যাবৎ ইউপিডিএফের সন্ত্রাসীরা চাঁদা দাবী করে আসছিলো।
১১ জুনঃ জীবন চাকমা নামের এক ইউ পি ডি এফ চাঁদাবাজকে একটি মোটর সাইকেলসহ আটক করে এলাকাবাসী বিজিবি ক্যাম্পে সোপর্দ করা হয়। এদিকে জীবন চাকমাকে আটক ও থানায় মামলা দায়েরের কারণে সংগঠনটির সশস্ত্রকর্মীরা ক্ষুব্দ হয়ে উঠে। একই রাতে সাবেক এক ইউ পি চেয়ারম্যানের কয়েক শত রাবার গাছ কেটে ফেলে সন্ত্রাসিরা। তার লেকের বাঁধ কেটে দিয়ে প্রায় ৫০-৬০ হাজার টাকার মাছ লুট করে নিয়ে যায়। লেকের পাড়ের নারিকেল, তেজপাতাসহ বিভিন্ন গাছও তারা কেটে ফেলেছে। একই রাতে অপর এক ব্যক্তির বাগানের ২৫টি রাবার গাছ ও ৩০টি ফলন্ত কলাগাছ কেটে দেয়া হয়। সেসময় তারা ৫-৬ রাউন্ড ফাঁকা গুলিবর্ষন করে এলাকায় আতংক সৃষ্টি করে। ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন, ইউপিডিএফের সন্ত্রাসীরা মুঠো ফোনে তাঁকে অবিরাম হুমকী দিচ্ছে গ্রেফতার হওয়া জীবন চাকমাকে ছাড়িয়ে আনতে এবং মামলা তুলে নিতে। নয়তো তাঁর বাগানের সবগুলো গাছই কেটে ফেলা হবে।
এ ধরনের ঘটনা ইতিপূর্বে ও ঘটেছে। তাই, ঐ এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা যেমন
নেহায়েতই কম নয়, তেমনি কম নয় ক্ষুদ্ধ লোকের সংখ্যাও। স্থানীয় বাংগালীদের অনেকেই আতঙ্কের মধ্যেই দিন কাটাচ্ছিল। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ না করলেই নয়, , গত এপ্রিলে খাগড়াছড়ির রামগড়ে এক ত্রিপুরা নারী চা শ্রমিক বাঙালি ছেলেকে ভালবেসে পালিয়ে বিয়ে করার জের ধরে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা ১৯টি ত্রিপুরা শ্রমিক পরিবারের ৭৮ জনকে তুলে নিয়ে যায়।
যেহেতু কোন ধরনের হামলা, লুটপাট বা মারধোরের ঘটনা ঘটেনি এবং কেউই বাড়ি ছেড়ে পালায়নি; তাই আমার মন বলছে, আপাতত বাহ্যিকভাবে স্বস্তিদায়ক মনে হতে পারে, কিন্তু এই ঘটনার অন্তর্নিহিত এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাবের ব্যাপকতা আসলেই কি স্বস্তিদায়ক ? না কি, উৎকণ্ঠিত হওয়ার মতো ?
দিনের পর দিন, প্রতিনিয়ত সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে যখন নিরীহ গ্রামবাসী একতাবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলে – তখন যদি কেউ বলে “শতাধিক সেটলার সংবদ্ধভাবে হামলা চালাচ্ছে ……গ্রামটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে লুটপাট চালানো হয়েছে …… চলছিল নির্বিচার হামলা, মারধোর আর লুটপাট” ; কিংবা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন সাধারণ মানুষের নিরাপত্তায় শত প্রতিকূলতা তুচ্ছ করে, জাত-কাল ভুলে, এমনকি নিজের জীবনের মায়া না করে দায়িত্ব পালনে এগিয়ে যায় – তখন যদি এমন কথা উঠে যে, “এইসব হামলায় ……সদস্যরাও অংশ নিচ্ছে” – তখন কি করা উচিৎ, এটা আসলে আমার বোধগম্য নয় !!
প্রকৃত সত্য আড়াল করে, মিথ্যা কাহিনীকে যদি ‘খুবই জরুরী এবং আশঙ্কাজনক একটি খবর’ – বলে প্রচার করা হয়, এমনকি প্রতিরোধের ও আহবান জানানো হয়; আমি ও বলবো সত্যিই এটা আশংকাজনক।এবং এই মিথ্যা খবর ছড়ানোকে প্রতিহত করা আরো বড় দায়িত্ব হয়ে পড়ে।
আশংকাজনক এই কারনে যে, যেখানে অত্যাচারিতদের প্রতি সমবেদনা আর সমর্থন ব্যক্ত করার কথা, সেখানে তাদেরকে অত্যাচারী হিসেবে প্রমাণের জন্যে অনেকেই আদাজল খেয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। এটি অত্যন্ত ভয়াবহ।আর এই অপচেষ্টা অনেক দিন ধরেই চলছে এবং অনেকেই জেনে বা না জেনে, বুঝে বা না বুঝে এই অপচেস্টায় সামিল হয়েছেন।
সুতরাং এখন সময় এসেছে সত্যকে সামনে তুলে ধরার। আর আমরা যারা পার্বত্য চট্টগ্রামের মত একটা স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে দিনের পরে দিন মিথ্যার জাল বিছিয়ে এভাবে আতঙ্ক সৃষ্টি করছি ফলাফলে সত্যিই কি আমরা লাভবান হচ্ছি? প্রকৃত পক্ষে যারা এই গুরুদায়িত্ব পালন করছেন তারা কতখানি লাভবান হচ্ছেন এটা বুঝতে না পারলেও দেশের সার্বভৌমত্ব যে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এটা বুঝতে বাকি থাকেনা।
অবশেষে বলব মিথ্যা প্রচার করে আতঙ্ক ছড়িয়ে সাধারন মানুষকে বিভ্রান্ত না করে সত্য সংবাদ দিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখান তাতেই দেশ ও জাতি লাভবান হবে।