॥ গিরিদর্পণ ডেস্ক ॥ জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্রের এক দশক পেরিয়ে গেলেও তার বাস্তবায়ন না করে সরকার আদিবাসীদের প্রতি ‘বৈরী ও দায়িত্বহীন আচরণ করছে’ বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে আদিবাসী দিবসে জাতিসংঘ ঘোষিত আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন করা হবে বলে বাণী দিয়েছিলেন। কিন্তু অতি দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, পরবর্তীতে তার সরকারের সময়েই আদিবাসীদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
জাতিসংঘ আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্রের এক দশক ও আদিবাসী দিবস উদযাপন উপলক্ষে শনিবার (৫ আগষ্ট) সকালে রাজধানীর সুন্দরবন হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনে তাদের ওপর নিপীড় ও নির্যাতনের নানা চিত্র তুলে ধরে তিনি এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রংয়ের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে ঐক্যন্যপের সভাপতি পংকজ ভট্টাচার্য, বিশিষ্ট কলামিস্ট ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ, মানবাধিকার কর্মী নুমান আহম্মদ খান, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক শক্তিপদ ত্রিপুরা, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রফেসর মেজবাহ কামাল উপস্থিত ছিলেন।
আদিবাসীদের উপর বৈরী আচরণের মাত্রা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে এমন মন্তব্য করে তিনি আরো বলেন, “আদিবাসীদের ভূমি নির্বিঘেœ অনায়াসে বেদখল হয়ে যাচ্ছে। অহঙ্কার ও ক্ষমতার দাপটে পাহাড়ি আদিবাসীরা আরো অসহায় হয়ে পড়ছে।
“মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো প্রতিকার নেই। যেন আদিবাসী ও প্রান্তিক মানুষের জন্য কোথাও কেউ নেই। রাষ্ট্র ও সরকার আদিবাসীদের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে।”
আদিবাসী ফোরামের আয়োজনে এই সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে সন্তু লারমা বলেন, আদিবাসীদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে আখ্যা দেওয়ায় দেশের ৩০ লাখ আদিবাসী জনগণ মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা থেকে ‘বঞ্চিত’ হয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে আদিবাসী দিবসের বাণীতে আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের ঘোষণা দিলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি বলে অভিযোগ করেন সন্তু লারমা। সম্পূর্ণ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে আদিবাসী ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনধারাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তাদের নিজভূমিতে সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হয়েছে। নিজস্ব আত্ম পরিচয় ও সংস্কৃতি নিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।
জাতীয় শিক্ষা নীতি, নারী উন্নয়ন নীতি, ষষ্ট ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় আদিবাসীদের উন্নয়ন ও অধিকারের কথা বলা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলছে বলেন সন্তু লারমা।
২০০৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। এতে আদিবাসীদের মৌলিক অধিকার, আত্ম নিয়ন্ত্রণ অধিকার, ভূমি, অঞ্চল বা টেরিটরি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর পূর্ণ অধিকার, ভূমির উপর ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ, আদিবাসীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, শিক্ষাসহ নিজস্ব ভাষা ও জীবনধারা সংরক্ষণের স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ।
এতে বলা হয়, আদিবাসীদের জীবনধারা, আদিবাসী এলাকা ও তাদের সহায় সম্পদকে প্রভাবান্বিত করে এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে গেলে আদিবাসীরে পূর্বানুমতি গ্রহণ, আন্তর্জাতিক নীতি ফ্রি, প্রায়োর অ্যান্ড ইনফরমড পলিসি মেনে চলতে হবে। আদিবাসীদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে তার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও বলা হয় এই ঘোষণাপত্রে। এই ঘোষণাপত্রের কিছুই বাস্তবে মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন সন্তু লারমার।
তিনি বলছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বেশকটি ধারা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেগুলো অনেকটা ‘ডিপ ফ্রিজে রেখে দেওয়া হয়েছে’। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের বিরোধাত্মক ধারা সংশোধনের পর ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির বিচারিক কাজ যথাযথভাবে শুরু করতে ভূমি কমিশনের কার্য বিধিমালা খসড়া তৈরি করে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ। কিন্তু চলতি বছর ১ জানুয়ারি তা সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হলেও ভূমি মন্ত্রণালয় বিষয়টি ‘ঝুঁলিয়ে রেখেছে’ বলে অভিযোগ করেন পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতারা।
সন্তু লারমা বলেন, “দেশে আদিবাসীদের বিষয়ে বলতে হয়, লাইফ ইজ নট আওয়ার্স। আদিবাসীদের ভূমি দখলের মহোৎসব চলছে। ভূমিলোভী চক্র নয়, কখনও কখনও বিভিন্ন প্রকল্পের নামে বিশেষত ন্যাশনাল পার্ক, ইকো পার্ক, রিজার্ভ ফরেস্ট, সামাজিক বনায়ন, সামরিক বাহিনীর ক্যাম্প ও স্থাপনা সম্প্রসারণ ইত্যাদির কারণে আদিবাসীরা ভূমি হারাচ্ছে। নতুন যন্ত্রণা শুরু হয়েছে, ইকোনমিক জোন গড়ার পরিকল্পনায় আদিবাসীরা ভূমি হারাতে শুরু করেছেন।”
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ ও বাগদাফার্ম, মৌলভীবাজারের ঝিমাই, আমুলি, মেঘাটিলা, নাহার, কাইলিন পুঞ্জি, পাল্লাথল পুঞ্জি; টাঙ্গাইলের মধুপুর; সীতাকুন্ড, কুমিরা, মিরেরসরাই, ফটিকছড়ি, চাঁদপুর, কুমিল্লা ও রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলায় আদিবাসীদের উপর হওয়া নানা নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরেন তিনি।
এসময় বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক ঘটনার প্রসঙ্গ এনে আদিবাসীদের মৃত্যুর পরিসংখ্যানও তুলে ধরেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির এই সভাপতি।
তার অভিযোগ, সরকার ভূমি কমিশনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ, জনবল নিয়োগ এবং রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় শাখা অফিস স্থাপনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর ১৯ বছর পার হলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলোর বিষয়ে এখনও ‘কাঙ্খিত অগ্রগতি’ লাভ করেনি।
এগুলোর মধ্যে বিশেষত, পার্বত্য চট্টগ্রামের জ্ম্মু উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদগুলোর নির্বাচন, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিকরণ, সেনা শাসন- অপারেশন উত্তরণসহ সব অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার, অস্থানীয়দের কাছে ভূমি ইজারা বাতিলকরণ, পার্বত্য অঞ্চলের সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে পার্বত্যদের অগ্রাধিকার, চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনের সংশোধন রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলন থেকে আদিবাসী দিবস উদযাপনের ঘোষণায় জানানো হয়, আগামী ৯ আগাস্ট সকাল সাড়ে ৯টায় রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত হবে আদিবাসী ফোরামের মূল অনুষ্ঠান।
এতে বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার পাশাপাশি লেখক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল উৎসব উদ্বোধন করবেন বলে কথা রয়েছে।
সেদিন দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলাতেও আদিবাসী দিবস উদযাপিত হবে। এ বছরের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্রের এক দশক’। দিবসটি উপলক্ষে জাতিসংঘ ঘোষিত ৯ অগাস্টকে আদিবাসী দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করাসহ বেশ কয়েকটি দাবি জানান সন্তু লারমা।
এর মধ্য জাতিসংঘ ঘোষিত আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র অবিলম্বে বাস্তবায়ন, এসডিজি ও রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও মনিটরিংয়ে আদিবাসীদের পূর্ণ অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা, আদিবাসীদের জীবন, উন্নয়ন ও ভবিষ্যতকে প্রভাবান্বিত করে এমন প্রকল্প বা উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণের আগে আদিবাসীদের সাথে অর্থপূর্ণ সংলাপ, ‘ফ্রি, প্রায়োর অ্যান্ড ইনফরমড পলিসি’ অনুসরণ, আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ও প্রথাগত ভীমি অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান ও সংবিধান সংশোধন করে আদিবাসীদের আত্ম পরিচয় ও অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া, মধুপুরে গারো, বর্মণ ও কোচদের ভূমিতে ঘোষিত রিজার্ভ ফরেস্ট বাতিল করা এবং মৌলভীবাজারের ঝিমাই ও নাহার খাসিয়া পুঞ্জিতে চা বাগানের লিজ বাতিল করা রয়েছে।
ঐক্যন্যাপের সভাপতি পংকজ ভট্টাচার্য বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন সেনাশাসন বিদ্যমান। যার ফলে সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যলঘু জনগোষ্ঠী। সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের সমতল এলাকার আদিবাসীদের প্রতি সরকারের বৈরী আচরন আরো বেড়ে গেছে। তিনি দেশকে প্রকৃত অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে আদিবাসীদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে প্রগতিশীল সমাজ, দেশের সুশীল সমাজ পাশে থাকবে বলে উল্লেখ করেন।
বিশিষ্ট কলামিস্ট ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, বাংলাদেশের আদিবাসীরা মোটেই ভালো নেই। তারা আজ উপেক্ষিত। অথচ দেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, রাজনীতির ক্ষেত্রে তারা অবদান রেখে চলেছে। তিনি দেশের সমস্ত প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালন করার জন্য আহ্বান জানান।
মানবাধিকার কর্মী নুমান আহম্মদ খান বলেন, বাংলাদেশকে একটি সুষ্ঠ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আদিবাসীদেরকে রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করার ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রফেসর মেজবাহ কামাল বলেন, রাষ্ট্র ও সরকার আদিবাসীদের থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে বলে আদিবাসীরা মনে করছে। আদিবাসীদের প্রতি রাষ্ট্রের যে বৈরী আচরণ তা অতীতের সমস্ত রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে গেছে। উগ্র বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ, উগ্র ধর্মান্ধতা মিলিয়ে রাষ্ট্র এক জাতির এক ধর্মের রাষ্ট্র হয়ে উঠছে। যার ফলে ভাষা বৈচিত্র্য, বর্ণবৈচিত্র্য, জাতিবৈচিত্র্য দেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় রাষ্ট্রের উচিত অতি শীঘ্রই আদিবাসীদের রাজনৈতিক অধিকারসহ সমস্ত মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা।