॥ মিল্টন বাহাদুর, জুরাছড়ি থেকে ঘুরে এসে ॥ রাঙ্গামাটি জেলার সবচেয়ে দুর্গম উপজেলা জুরাছড়ির ৩০ হাজার মানুষের স্বাস্থ্য-সেবার জন্য একমাত্র চিকিৎসা কেন্দ্র উপজেরা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির বর্তমানে বেহাল দশা। ভবনের জরাজীর্ণ অবস্থা, ডাক্তার নার্স সংকটসহ নানা সমস্যা জর্জরিত স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি। বর্তমানে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির এমন অবস্থা যে যেখানে রোগী গেলে ভালো হওয়ার তো দুরের কথা সেখানে সুস্থ মানুষ গেলে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
রাঙ্গামাটি জেলা শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দুরে জুড়াছড়ি উপজেলা। প্রায় ৪০ হাজার মানুষের বসবাস এ উপজেলায়। ১৯৭৮ সালের দিকে গড়ে উঠে ১০ শষ্যার আধাপাকা টিন সেডে নির্মিত স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি। ২০০১ সালে পার্শ্ববর্তী উপজেলা বরকলে প্রচন্ড ভূমিকম্পের কারনে জুরাছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবনটি বিভিন্ন অংশে মারাতœক ফাটল দেখা দেয়। ফাটলের কারণে যে কোন মুহুর্তে ভবনটি ধসে পড়তে পারে। ভবনের ছাদ নষ্ট হয়ে গেছে। অল্প বৃষ্টি হলে ছাদ থেকে পানি পড়ছে। কিন্তু এযাবত কোন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
এছাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য লোকবলের সংকট লেগেই রয়েছে। ৯ জন চিকিৎসক নিয়োগ দেয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাসহ ৩জন চিকিৎসক রয়েছেন। তবে চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হলেও কিছু দিন থাকার পর অন্যত্র বদলি হয়ে যাচ্ছেন। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে স্থাপিত এসব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র, কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিক চলছে অনেকটা নামেই।
জনবল সংকটসহ স্বাস্থ্য নানা সমস্যায় ভরপুর ৪০ হাজার মানুষের একমাত্র চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ১৯৭৮সালে নির্মাণের পর থেকে জোড়া-তালি দিয়ে চলছে চিকিৎসা সেবা। তারপরও দুর্গম এলাকার ৪০ হাজার মানুষ একটু চিকিৎসার আশায় ছুটে আসে রোগাক্রান্ত এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেটিতে। অনেক সময় মেডিকেল অফিসারের স্বাক্ষাত না পেয়ে ফিরে যেতে হয় দুর্গম পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথ বেয়ে নিজ বাড়িতে। চিকিৎসা নিতে হয় গ্রাম্য কবিরাজ কিংবা সাধারণ ওষুধ বিক্রেতার কাছ থেকে। এমনি একজন জুরাছড়ি ইউনিয়ন থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বারুদগলা গ্রাম থেকে আসা বৃদ্ধ ডাবলি মালা চাকমা (৫০) জানান, অনেক কষ্টে এসেছি আমার রোগ ডাক্তারকে দেখাবো বলে কিন্তু মেডিকেল কর্মকর্তা নেই, তাই ওষুধ বিক্রেতার নিকট থেকে ওষুধ নিয়ে যাব। আউটডোরে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অনেকের অভিযোগ, সারাদিন অপেক্ষার পরেও ডাক্তারের স্বাক্ষাত পাওয়া যায়না। আর তখন রোগীদের এমবিবিএস ডাক্তারের কাছটি সারেন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির পিয়ন অথবা নার্সদের কাছ থেকে।
রোগাক্রান্ত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিকে সরেজমিনে দেখতে গিয়ে অনেক সমস্যা প্রত্যক্ষ করা যায়, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভবনের অবকাঠামো নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। যে কোন সময় এই অবকাঠামো ভেঙ্গে গিয়ে বড় ধরনের দূর্ঘটনার ঘটে যেতে পারে। আর কমপ্লেক্সের পিছনে অসংখ্য অবৈধ বসতি। সর্বত্র দুর্গন্ধময় এক দমবন্ধ পরিবেশ। শিশু ওয়ার্ডের দরজা ভাঙ্গা, পুরো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিশুদ্ধ পানি ও বিদ্যুতের তীব্র সংকট। ইমার্জেন্সী ডিউটি রুম, ওয়ার্ড শাখার মেশিনতো নাই’ই, জরুরি মূহুর্তে অতি প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সিলিন্ডার দু-টিও নষ্ট। প্যাথলজি বিভাগে একটি পুরানো অণুবীক্ষণ যন্ত্র আছে, পরীক্ষা করার রি-এজেন্ট থাকলেও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নেই। অপারেশন থিয়েটারে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অর্ধেকও নেই। যেগুলো আসে সেগুলো বহুদিনের পুরোনো জং ধরা। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ কর্তৃক দেয়া একটি রিভার এ্যাম্বুলেন্স ছিল। দীর্ঘদিন ধরে এটির কোন হুদিস পাওয়া যাচ্ছেনা।
১০ বেডের দুই ওয়ার্ডের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মাত্র দশটি বেড রয়েছে। এগুলোও নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। অনেক সময় রোগীরা বেড থেকে পড়ে গিয়ে আহত হচ্ছেন। এখানে মেডিসিন, সার্জারী, গাইনি, শিশু রোগ, কলেরা ইত্যাদি বিভাগ থাকলেও কোন চিকিৎসক নেই। এক্স-রে বিভাগটি নামে মাত্র থাকলেও এ পর্যন্ত চালু করা হয়নি। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক নার্স ও কর্মচারীদের কোন আবাসনের কোন সুযোগ-সুবিধা নেই। তাই এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি কোন রকমে জোড়া-তালি দিয়ে চালানো হচ্ছে।
এব্যাপারে জুরাছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ বিপাশ খীসা বলেন, জুরাছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেটি বর্তমানে খুবই নাজুক হয়ে পড়েছে। বৃষ্টি হলে কমপ্লেক্সের প্রতিটি কক্ষে পানি চুয়ে পড়ে। একারণে আমাদের ঔষধপত্রসহ প্রয়োজনী কাগজপত্র ভিজে নষ্ট হয়ে যায়। আর এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি যে জরাজির্ন অবস্থায় রয়েছে তা সংস্কার করার মতো অবস্থা নেই। এই মুহুর্তে এই ভবনটি পরিত্যাক্ত ঘোষণা করা প্রয়োজন। যে কোন সময় ধ্বসে পড়ার আশংকা রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে আসলেও থাকার নিরাপদ বোধ করে না। কারণ যে কোন মুহুর্তে ধ্বসে পড়তে পারে। যারা নিরুপায় হয়ে এবং যাদের অবস্থা খুবই খারাপ তারাই ভয়ে মধ্যে বেডে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়। আর এখানে ডাক্তার ও ষ্টাফদের নেই কোন কোয়ার্টার। যা আছে খুবই জরাজির্ণ যা থাকার পরিবেশ নেই। তাই অচিরেই এইসব সমস্যাগুলো সমাধান করা দরকার বলে তিনি মনে করেন।
এদিকে এ ব্যাপারে রাঙ্গামাটি জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ শহীদ তালুকদার বলেন, জুরাছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির যে অবকাঠামো আসলেই খুব ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। তবে বর্তমানে সরকারের যে স্বাস্থ্য সেক্টর কর্মসূচী চলছে এখানে কিন্তু স্বাস্থ্য প্রকৌশলীর মাধ্যমে সব উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো ৫০ বেডের উন্নিত করার জন্য অনুমোদন দেয়া আছে। এব্যাপারে আমি প্রধান স্বাস্থ্য প্রকৌশলীকে অবহিত করা হয়েছে। যদি বরাদ্দ আছে তা হলে সবার আগে জুরাছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভবনটি নির্মাণ কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা হবে।