॥ চট্টগ্রাম ব্যুরো ॥ সরকারের অনুমোদন ছাড়া ‘ওয়েলফেয়ার ফান্ডের’ নামে লটারির টিকেট বিক্রির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার সঙ্গে জড়িত এক প্রতারক চক্রের ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, যাদের মধ্যে চীনের এক নাগরিকও রয়েছেন। গ্রেপ্তাররা লটারির টিকেট বিক্রির বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয়ের খাত সম্পর্কে কোনো ধারণা না দিতে পারায় পুলিশ কর্মকর্তাদের ধারণা, চক্রটি টাকা পাচারে জড়িত।
বৃহস্পতিবার নগরীর দক্ষিণ খুলশী ১ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে গোয়েন্দা পুলিশ ও কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সদস্যরা অভিযান চালিয়ে ১২ জনকে আটক করে।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (বন্দর) আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, চীনা ও বাংলাদেশের কিছু ব্যক্তি এ চক্রটির সাথে জড়িত। পিবিডিএফ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নামে তারা লটারি বিক্রি করে থাকে। চক্রটি নিম্ন আয়ের লোকজনকে টার্গেট করে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত পুরষ্কারের প্রলোভন দিয়ে লটারি বিক্রি করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনুমোদন দিয়ে সরকারি সংস্থা ছাড়া অন্য কোনো সংস্থা লটারি বিক্রি করতে পারে না। তবে চক্রটি ‘সরকারি অনুমোদিত’ উল্লেখ করে ২০, ৫০ ও ১০০ টাকার লটারির টিকিট বিক্রি করছে।
লটারিতে সরকারি অনুমোদনের বিষয়টি লেখা থাকলেও তারা কোনো বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেনি উল্লেখ করে এডিসি বক্কর বলেন, চক্রটি নিম্ন আয়ের লোকজনের যেখানে বসতি বেশি সেখানেই টিকিটগুলো বিক্রি করে থাকে। এভাবে করে তারা দৈনিক ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকা শ্রমজীবী মানুষদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে।
এ চক্রটির সাথে ১১ জন চীনা নাগরিকের পাশাপাশি বাংলাদেশি বেশকিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির সম্পৃক্ততার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, লটারি প্রিন্ট থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজ চীন থেকে হয়ে থাকে। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটি তাদের আর্থিক লেনদেনসহ বিভিন্ন কাজ করে থাকে অনলাইনের মাধ্যমে।
তারা আগে ইয়েমেন ও নাইজেরিয়ায় এ ধরনের ব্যবসা করলেও কয়েকবছর ধরে বাংলাদেশে শুরু করেছে। বর্তমানে নাইজেরিয়া ও বাংলাদেশে তারা ব্যবসাটি করে আসছে বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তা বক্কর।
তিনি বলেন, দৈনিক ১০ থেকে ২০ কোটি টাকা লটারি বিক্রি করে আয় করলেও সামান্য কিছু টাকা তারা পুরস্কার বাবদ খরচ করে। তারা ওয়েলফেয়ার ফান্ডে টাকাটা খরচ করে বলে দাবি করলেও সুনির্দিষ্টভাবে কোথায় এ টাকা খরচ হয় তার কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। টাকাগুলো পাচার হয়ে যাচ্ছে নাকি কোনো জঙ্গি সংগঠনকে পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে সেটা খতিয়ে দেখব আমরা।
পিবিডিএফ লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠানটির চট্টগ্রাম ছাড়াও ঢাকা, সিলেট ও কুমিল্লায়ও শাখা রয়েছে।
চট্টগ্রামের দক্ষিণ খুলশী ১ নম্বর রোডের গৌরী নামে একটি ভবনের পাঁচ তলায় প্রতিষ্ঠানটি তাদের চট্টগ্রাম কার্যালয় করেছে।
গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার (বন্দর) আসিফ মহিউদ্দিন জানান, প্রতিষ্ঠানটি এক স্থানে বেশিদিন থাকে না; ঘন ঘন ঠিকানা পরিবর্তন করে। গত বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রামে তাদের ব্যবসা শুরু করে। ১০ মাসে তার চারবার স্থান পরিবর্তন করেছে।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার পলাশ কান্তি নাথ জানান, নগরীর ইপিজেড, আকবর শাহ, তুলাতলী, আমবাগানসহ যেসব এলাকায় নিম্ন আয়ের লোকজনের বসবাস বেশি সেখানেই এসব লাটারি বিক্রি করে থাকে। লটারির টিকেট ঘষে গ্রাহকরা তাদের টাকা গ্রহণ করে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গ্রাহকরা লটারি কেনে প্রতারিত হন বলে জানান তিনি। নগরীর বিভিন্ন স্থানে ৪১ দোকানের মাধ্যমে লটারিগুলো বিক্রি করা হয়ে থাকে বলে জানান তিনি।
তিন লটারির তিন নাম
২০ টাকা দামের লটারিটি ‘সমুদ্রের গুপ্তধন’, ৫০ টাকা দামেরটি ‘ঝাল মরিচ’ ও ১০০ টাকা দামের লটারিটির নাম ’১০ গুণ বেশি ভাগ্যবান’।
২০ টাকার লটারিতে সর্বোচ্চ ৪০ হাজার থেকে সর্বনিম্ন ২০ টাকা, ৫০ টাকার লটারিতে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ থেকে সর্বনিম্ন ৫০ ও ১০০ টাকার লটারিতে ১০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকার পুরষ্কার লেখা আছে।
প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বাইরে সাইনবোর্ড না থাকলেও ভেতরে পিবিডিএফ লেখা আছে। যার পূর্ণাঙ্গ নাম পেট্রো নজরুল বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট বলে জানিয়েছে পুলিশ।
প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের একটি ট্রেড লাইসেন্সের কপি টাঙ্গানো রয়েছে। সেখানে নজরুল ইসলাম মোল্লা (চেয়ারম্যান) নাম লেখা আছে। ওই ব্যক্তির ঠিকানা উল্লেখ করা আছে ১৯/৯ পল্লবী, মীরপুর ঢাকা।
গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আবু বক্বর জানান, আটক চীনা নাগরিক শিন জিয়াং (৩৬) নিজেকে কম্পিউটার প্রকৌশলী বলে পরিচয় দিয়েছে। তিনি দুই মাসের ‘বিজনেস ভিসা’ নিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। আটক অন্যরা প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারী বলে জানান তিনি।