ড্রাগন ফল খেতে স্সুাধু ও দেখতে অনেক সুন্দর-বিদেশী ড্রাগন ফল চাষ করে সফল নাইক্ষ্যংছড়ির তরুন ইউসুফ আজাদ

॥ এস.কে খগেশপ্রতি চন্দ্র খোকন,লামা ॥

দ্বিতীয় বারে বড় আকারে ড্রাগন ফল চাষ করে কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন নাইক্ষ্যংছড়ির মোঃ ইউসুফ আজাদ নামের এক তরুন উদ্যোক্ত। আড়াই বছর পূর্বে প্রথম বিদেশী জাতের ড্রাগন ফল চাষ করে সফল হয়েছেন মোঃ ইউসুফ আজাদ। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি হর্টিক্যালচার সেন্টারের সহায়তায় তার নিজের ৪০ শতক জমির উপর ২০১৬ সালে ১৬০টি ড্রাগন ফলের চারা রোপন করেন। বিদেশী এ ড্রাগন ফল এখন গাছে থোকায় থোকায় পাকা শুরু হয়েছে । স্থানীয় বাজারে বিক্রিও শুরু করে দিয়েছে চাষী ইউসুফ আজাদ।

নাইক্ষ্যংছড়ি হর্টিক্যালচার সেন্টারের উদ্যান তত্ববিদ  মোঃ এমরান কবির বলেন, বছর ব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ছয়জন চাষীর মাধ্যমে ২০১৬ সাল থেকে ড্রাগন ফল চাষ শুরু করা হয়। নাইক্ষ্যংছড়ির সদর ও সোনাইছড়ি ইউনিয়ন, ঘুনধুম ইউনিয়নে ৬ জন চাষীর মাধ্যমে ছয়টি প্লটে ড্রাগনের চাষ করা হয়। হর্টিক্যালচার সেন্টার থেকে চাষীদের ড্রাগন চারা(কলব), সার, কিটনাশক, পিলার ও স্প্রেমেশিনসহ সকল ধরনের সহগীতা দিয়ে প্রদর্শনী প্লটের চাষ শুরু করি।

ড্রাগন ফল চাষে সফল নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের আদর্শ গ্রাম এলাকার হাজী মোঃ নবীরের ছেলে মোঃ ইউসুফ আজাদের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, বাড়ির পাশে নিজের ৪০ শতক জমিতে নাইক্ষ্যংছড়ি হর্টিক্যালচার সেন্টারের সহায়তায় ২০১৬ সালে ১৬০টি ড্রাগন চারা লাগাই। তারা আমাকে শুরু থেকে ড্রাগন ফলের চারাসহ সকল ধরনের সহায়তায় প্রদান করেন। চারা লাগানোর দশ মাস পর ফুল চলে আসে। ফুল আসার ২৫ থেকে ৩০ দিনে ফল গুলো পাকতে শুরু করে। চলতি এপ্রিল মাসের ২৯ তারিখ প্রথম পাঁচ কেজি পাকা ড্রাগন ফল কেটেছি। এলাকার মানুষ নতুন ধরনের লোভনীয় ফল দেখতে পেয়ে প্রতি কেজি পাঁচশত টাকা মূল্যে ক্রয় করে নিয়ে যায়। যারা এ ফল নিয়েছে তারা পুনরায় এ ফল কিনতে আসে। গত ৮ জুলাই ২য় বারে আরো ৪৫ কেজি পাকা ফল একই মূল্যে বিক্রি করেছি। চাষের এ ফল আগামী অক্টোবর মাস পর্যন্ত আরো ১শত ২০ কেজি এ  ড্রাগন ফল বিক্রি করতে পারবো। এলাকার মানুষের কাছে এ ফলটি একধম নতুন এবং খুব সুসাধা বিধায় অনেক বেশী চাহিদা রয়েছে। স্বল্প সময়ে এবং বাজারে বিক্রি মূল্য বেশী পাওয়া যাওয়ায় চলতি বছরে বড় আকারে ড্রাগন ফল চাষ করবো। যার আয় থেকে আগামী দুই বছরের মধ্যে আমি কোটি টাকার মালিক হতে পারবো।

এমনই আরেক সফল চাষী বান্দরবানের সুয়ালক ইউনিয়নের চিম্বুক এলাকার বসন্ত পাড়ার তৈয় ম্রো বলেন,  ২০১৬ সালে সুয়ালক হর্টিক্যালচার সেন্টারের পরামর্শে ও সহায়তায় নিজের জায়াগার উপর ৩শতটি ড্রাগন ফল চারা রোপন করে চাষ শুরু করি। এ চাষে মোট খরচ হয়েছে ৭০ হাজার টাকা। জুন মাস পর্যন্ত আমি ১ লক্ষ ১৭ হাজার টাকা বিক্রি করেছি। আমি আরো ৩ লক্ষ টাকার ড্রাগন ফল বিকি করতে পারবো। এ চাষে লাভবান বেশি হওয়ায় আমি ২০১৭ সালে আরো একটি ১ একর জায়গায় ১৮শত ৬০টি ড্রাগন ফলের চারা লাগাই। এখন কিছু কিছু গাছে ফুল আসতে শুরু করেছে।

এ বিষয়ে বান্দরবান জেলা হর্টিক্যালচার সেন্টারের উপ-পরিচালক মোঃ মিজানুর রহমান  বলেন,  ড্রাগর ফলটি বিদেশী ফল। গত ২০১২-১৩ সালে  সরকার দেশে প্রথম ভিয়েতনাম থেকে ড্রাগন  ফল গাছের চারা আমদানি করে। ড্রাগন ফল গাছ বিদেশী হলেও পার্বত্য চট্রগ্রাম অঞ্চলে ড্রাগন চাষ খুব ভালই হচ্ছে। ড্রাগন ফল চাষের জন্য এখানকার মাটি, জলবায়ু ও আবহাওয়া দেশের অন্যান্য যায়গা থেকে খুব উপযোগী। বান্দরবান জেলায় বর্তমানে ১০ একর ড্রাগন ফল চাষ রয়েছে। তার মধ্যে শতভাগই ড্রাগন ফল চাষ সফল । জেলায় তিনটা হর্টিক্যালচার সেন্টার বালাঘাটা হর্টিক্যালচার সেন্টার ,  লামার আজিজ নগর হর্টিক্যালচার সেন্টার ও নাইক্ষ্যংছড়ি হর্টিক্যারচার সেন্টার থেকে চাষী নির্বাচন করে তাদের চারা সারসহ সবকিছু দিয়ে ২০১৫ সাল থেকে বান্দরবান জেলায় চাষ আরম্ভ করি। ১২ থেকে ১৮ মাস বয়সের একটি গাছে ১০ থেকে ২৫টি ফল পাওয়া যায়। কিন্তু পূর্ণবয়স্ক একটি গাছে ১৫০ থেকে ২০০টি ফল পাওয়া যায়। হেক্টর-প্রতি ফলন ২৫ থেকে ৩০ টন।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কৃষি মন্ত্রনালয়ের এ প্রকল্পের কনসাল্টট্যান্ট(পরামর্শক) এস এম কামরুজ্জামানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন,  বিদেশী এই ড্রাগন ফলে অনেক পুষ্টিগুণ রয়েছে। সঠিক পদ্ধতিতে এই ফল চাষ করলে বাংলাদেশে এর উৎপাদন বেড়ে যাবে। সেইসাথে এই পুষ্টিকর ফল সর্বত্র পাওয়া সহজ হবে।

বিদেশি ফল হলেও ড্রাগন ফলের সতেজ করা স্বাদ ও পুষ্টিগুণের জন্য বাংলাদেশেও এখন এই ফল চাষ হচ্ছে। আর পুষ্টিগুণ কমলা বা গাজরের চাইতে বেশি। এ ফলে ক্যালোরির পরিমাণ কম থাকে বলে ‘ডায়েট’ করার সময় এটি খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়। ড্রাগন ফলের স্বাদ ও পুষ্টিগুণ ঠিক রাখার জন্য সাধারণত এটি কাঁচা অবস্থাতেই খাওয়া হয়। প্রতি ১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলের সাদা বা লাল অংশে ২১ মি.গ্রা. ভিটামিন সি পাওয়া যায় যা দৈনিক ভিটামিন সি’র চাহিদার ৩৪ শতাংশ পূরণ করতে সাহায্য করে। ১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলে যে পরিমাণ ভিটামিন সি পাওয়া যায় তা একটি কমলার সমান বা তিনটি গাজরের চেয়ে বেশি ভিটামিন সি সরবারহ করতে সক্ষম।

ভিটামিন সি’র মাত্রা বেশি থাকায় এই ফল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, মানসিক অবসাদ দূর করে এবং ত্বক সুন্দর রাখতে সাহায্য করে।

প্রতি ১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলে ৩ গ্রাম আঁশ থাকে যা দৈনিক চাহিদার ১২ শতাংশ। ড্রাগন ফলের আঁশ কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিকারক হিসেবে কাজ করে।

এই ফলের কালো বীজে থাকে ল্যাক্সেটিভ ও পলিআনস্যাচুরেইটেড ফ্যাটি অ্যাসিড যা হজমে সাহায্য করে ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধের সহায়ক। প্রতি ১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলে জলীয় শতাংশ থাকে ৮৭ গ্রাম, প্রোটিন ১.১ গ্রাম, ফ্যাট ০.৪ গ্রাম (বলতে গেলে ফ্যাট নাই) এবং কার্বোহাইড্রেট ১১.০ গ্রাম।

এছাড়াও এতে বেশ কিছু ভিটামিন ও খনিজ উপদান থাকে যা মানবদেহের সুস্থতার জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। প্রতি ১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলে ০.০৪ মি.গ্রা. ভিটামিন বি ১, ০.০৫ মি.গ্রা. ভিটামিন বি ২, ০.০১৬ মি.গ্রা ভিটামিন বি ৩ এবং ২০.০৫ মি.গ্রা. ভিটামিন সি পাওয়া যায়। ড্রাগন ফল আয়রনের ভালো উৎস। ১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলে ১.৯ মি.গ্রা. আয়রন থাকে। এছাড়াও এতে ক্যালসিয়াম থাকে ৮.৫ মি.গ্রা. এবং ফসফরাস থাকে ২২.৫ মি.গ্রা.।

আবহাওয়া ও জমি নির্বাচন:

ড্রাগন ফল প্রচুর আলো পছন্দ করে। এ ফলটির জন্য শুষ্ক ট্রপিক্যাল আবহাওয়া প্রয়োজন। মধ্যম বৃষ্টিপাত এ ফলের জন্য ভালো। উপযুক্ত বৃষ্টিপাতে ফুল ঝরে পড়ে এবং ফলের পচন দেখা দেয়। প্রায় সব ধরনের মাটিতেই ড্রাগন ফল চাষ করা যায়। তবে পানি জমে না এমন উঁচু জমিতে এ ফলের চাষ করা ভালো। উচ্চ জৈব পদার্থ-সমৃদ্ধ বেলে-দোঁআশ মাটিই এ ফল চাষের জন্য উত্তম।

উপযোগী জাত:

বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সফলভাবে চাষ করার জন্য বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার থেকে অবমুক্তায়িত বাউ ড্রাগন ফল-১ (সাদা) বাউ ড্রাগন ফল-২ (লাল) চাষ করা যেতে পারে। এ ছাড়া হলুদ ড্রাগন ফল ও কালচে লাল ড্রাগন ফলও চাষ করা যেতে পারে।

চারা তৈরি:

ড্রাগন ফলের চারা তৈরি খুব সহজ। বীজ দিয়ে চারা তৈরি করা যায়। তবে সেসব চারায় ফল ধরতে অনেক সময় লেগে যায়। তাই কাটিং করে শাখা কলম করে চারা তৈরি করা উত্তম। বয়স্ক ও শক্ত শাখা এক থেকে দেড় ফুট লম্বা ও তেরছা করে কেটে বালি বা বেলে দো-আঁশ মাটিতে বসিয়ে দিলে ২০ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে তা থেকে শিকড় গজায়। তবে কাটিং রাখার জায়গায় শেড বা ছায়ার ব্যবস্থা করতে হবে। মাটিতেও রস থাকতে হবে। কাটিং সাধারণত মরে না। কাটিংয়ের গাছে তাড়াতাড়ি ফল ধরে। কাটিং থেকে উৎপাদিত গাছে এক থেকে দেড় বছরের মধ্যেই ফল ধরতে শুরু করে।

জমি তৈরি ও রোপণ:

জমি ভালোভাবে চাষ দিয়ে সমান করে ৩ মিটার পরপর সব দিকে সারি করে চারা লাগানো যেতে পারে। চারা রোপণের মাস-খানেক আগে গর্ত তৈরি করে তা সারমাটি দিয়ে ভরে রেখে দিতে হবে। প্রতি গর্তে ৪০ কেজি পচা গোবর, ৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম করে টিএসপি ও এমওপি সার, ১০ গ্রাম করে জিপসাম, জিঙ্ক সালফেট ও বোরাক্স সার দেয়া যেতে পারে। বছরের যেকোনো সময় চারা লাগানো যেতে পারে। তবে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে লাগালে ভালো হয়। প্রতি গর্তে চার থেকে পাঁচটি চারা লাগাতে হবে। সিমেন্ট বা বাঁশের খুঁটির সাথে গাছ লতিয়ে দিতে হবে।

পরিচর্যা:

চারা লাগানোর পর খুঁটি বা পিলার পুঁতে দিয়ে ড্রাগন ফল গাছ বেঁধে দিতে হবে। কেননা ড্রাগনের গাছের কাণ্ড লতানো প্রকৃতির। তিনটি পদ্ধতিতে খুঁটি দিয়ে গাছটি সাপোর্ট দিতে হয়।

(১) ভিয়েতনাম পদ্ধতি, (২) ফ্লোরিডা পদ্ধতি,

ও (৩) শ্রীলঙ্কা পদ্ধতি।

ভিয়েতনাম পদ্ধতি:

এ ক্ষেত্রে পিলারের চারদিকে কাটিং-কৃত কলম চারা লাগিয়ে পিলারের সঙ্গে বেঁধে দিতে হয়।

ফ্লোরিডা পদ্ধতি:

এ পদ্ধতিতে দুই পাশে দুটি খুঁটি পুঁতে মোটা তারের উপর জাংলার মতো তৈরি করে গাছ জাংলায় তুলে দিতে হয়।

শ্রীলঙ্কা পদ্ধতি:

এ পদ্ধতিতে পিলার পুঁতে দিয়ে চারা লাগিয়ে দিয়ে পিলারের সঙ্গে বেঁধে দিতে হয়। পিলারের চার দিকে বাঁশের চ্যাগারের উপরে মোটর গাডি র পুরাতন টায়ার দিয়ে তার উপর গাছের শাখাগুলোকে বাড তে দেয়া হয়।

গাছের আকার ও শাখা-প্রশাখা কর্তন:

ড্রাগন ফল গাছ খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং মোট শাখা তৈরি করে। একটি এক বছরের গাছ ৩০টি পর্যন্ত শাখা তৈরি করতে পারে। তবে শাখা-প্রশাখা উৎপাদন গাছের আকার ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ১২-১৮ মাস পর একটি গাছ ফল ধারণ করে। ফল সংগ্রহের পর ৪০-৫০টি প্রধান শাখায় প্রত্যেকটিতে এক-দুটি সেকেন্ডারি শাখা অনুমোদন করা হয়। গাছের আকার ও শাখা-প্রশাখা কর্তনের কার্যক্রম দিনের মধ্যভাগে করাই ভালো। কর্তন করার পর অবশ্যই যেকোনো ছত্রাক-নাশক প্রয়োগ করতে হবে। অন্যথায় বিভিন্ন ধরণের রোগবালাই আক্রমণ করতে পারে।

সেচ ব্যবস্থাপনা:

ড্রাগন ফল গাছ অতিরিক্ত পানি সহ্য করতে পারে না এবং এ ফল চাষে পানি খুব কম লাগে। শুষ্ক মৌসুমে অবশ্যই সেচ ও বর্ষা মৌসুমে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দুই সারির মাঝখানে ৫০-১০০ সেন্টিমিটার আকারে নালা তৈরি করা যেতে পারে। এতে করে নালায় এক-দুই দিন পানি জমা রেখে গাছের মাটিতে রস সরবরাহ করা যেতে পারে

Archive Calendar
Mon Tue Wed Thu Fri Sat Sun
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031