বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সোমবার এ মামলার রায় ঘোষণা করে।
আদালত রায় ঘোষণার সময় এ মামলার পাঁচ আসামি ইসহাক সিকদার, আব্দুল গণি হাওলাদার, আব্দুল আওয়াল ওরফে মৌলভী আওয়াল, আব্দুস সাত্তার প্যাদা ও সোলায়মান মৃধা কাঠগড়ায় উপস্থিতে ছিলেন।
রায়ে বলা হয়, আসামিদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা দুটি অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে।
এর মধ্যে পটুয়াখালীর ইটাবাড়িয়া গ্রামে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন, ১৭ জনকে হত্যার ঘটনায় আসামিদের সবাইকে মৃত্যদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
আর ওই গ্রামের অন্তত ১৫ নারীকে ধর্ষণের ঘটনাতেও একই সাজার রায় দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
মৃত্যু পর্যন্ত ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে পাঁচ যুদ্ধাপরাধীর সাজা কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রায়ে।
অবশ্য নিয়ম অনুযায়ী, এই রায়ের এক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ পাবেন আসামিরা।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, “আসামিরা ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে, যা তাজা একটি বুলেটের চেয়েও ভয়ঙ্কর এবং শক্তিশালী। যিনি বা যারা এর শিকার হয়েছেন, সারা জীবন তাদের এই ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা বহন করতে হবে।
“মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব মা-বোনরা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, প্রকৃতপক্ষে তারা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়ক (ওয়ার হিরো)। সময় এসেছে তাদের ওয়ার হিরো হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার।”
মামলার নথিতে বলা হয়, পাঁচ আসামির সবাই একাত্তরে ছিলেন মুসলিম লীগ সমর্থক। আর ২০১৫ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার সময় তারা স্থানীয় বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতায় দাঁড়িয়ে একাত্তরে রাজাকার বাহিনীর সদস্য হিসেবে তারা বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত রায় আসা ৩৪টি মামলার ৮৩ আসামির মধ্যে পাঁচজন বিচারাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। মোট ৭৮ জনের সাজা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৫১ যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ সাজার রায় এসেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পটুয়াখালীতে হত্যা, ধর্ষণের মত মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত থাকার দায়ে তখনকার রাজাকার বাহিনীর পাঁচ সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
প্রতিক্রিয়া
রায়ের পর এ মামলার প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম সাংবাদিকদের বলেন, ১৯৭১ সালের মে মাসে আসামিরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে অপহরণ, আটক, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ১১ জনকে হত্যা এবং ১১ জনকে মারাত্মক জখম করে।
“প্রসিকিউশন যে সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করেছে তাতে আসামিদের বিরুদ্ধে এসব অপরাধ সন্দোহাতীতভাবে প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে। এসব সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই আদালত পাঁচ আসামিকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। প্রসিকিউশন এই রায়ে সন্তুষ্ট।”
অন্যদিকে আসামি আব্দুল গণি হাওলাদার, আব্দুল আওয়াল ওরফে মৌলভী আওয়াল ও সোলায়মান মৃধার আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান সাংবাদিকদের বলেন, “আমি মনে করি রায়ে আমার মক্কেলরা ন্যায়বিচার পাননি। কারণ এ মামলায় রেইপ ভিকটিমসহ যে ১১ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন, জবানবন্দিতে কোনো সাক্ষী এই আসামিদের নাম-ঠিকানা বলেননি।”
এ আইনজীবী বলেন, হত্যা ও ধর্ষণের দুটি অভিযোগে প্রসিকিউশন আসামিদের বিরুদ্ধে যে প্রদর্শনী (এক্সিবিট) ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেছে, সেখানে এই পাঁচ আসামির নামই নেই।
“তাই আমি মনে করি, আসমিরা আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সর্বোচ্চ আদালতে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে খালাস পাবেন।”
আসামি ইসহাক সিকদার ও আব্দুস সাত্তার প্যাদার আইনজীবী মো. আব্দুস সালাম খানও বলেছেন, তার মক্কেলরা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন।
এ মামলার প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম ছাড়াও চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, সুলতান মাহমুদ সিমন, সৈয়দ হায়দার আলী, ঋষিকেশ সাহা, মোখলেছুর রহমন বাদল, সাবিনা ইয়াসমিন মুন্নী, তাপস কান্তি বল, রেজিয়া সুলতানা চমন রায় ঘোষণার সময় ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান ও জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক সানাউল হক ছিলেন ট্রাইব্যুনালে।
১৫৯ পৃষ্ঠার রায়
সোমবার সকালে আদালত বসার আগেই পাঁচ আসামিকে আগেই কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়।
বেলা পৌনে ১১টায় আদালত বসার পর ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান কাঠগড়ায় উপস্থিত আসামিদের নাম জানতে চান।
পরে ১৫৯ পৃষ্ঠার রায়ের সার সংক্ষেপের প্রথম অংশ পড়া শুরু করেন ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবু আহমেদ জমাদার।
বিচারপতি আমির হোসেন পড়েন রায়ের দ্বিতীয় অংশ। সবশেষে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম সাজা ঘোষণা করেন।
প্রসিকিউশনের তদন্ত দল পটুয়াখালীতে কাজ শুরু করার পর ২০১৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনাল এই ৫ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। ওই বছর ১ অক্টোবর তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
২০১৬ সালের ১৩ অক্টোবর এ মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। এরপর ১৭ নভেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়।
২০১৭ সালের ৮ মার্চ অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আসামিদের বিচার শুরু করে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে গত ৩০ মে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়। এরপর রোববার আদালত জানায়, রায় হবে সোমবার।
এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ মোট ১১ জন আসামিদের বিপক্ষে সাক্ষ্য দেন। তাদের মধ্যে ছয়জন মুক্তিযুদ্ধের সময় আসামিদের মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আর তদন্ত কর্মকর্তা ছাড়া বাকি সাক্ষীরা ভুক্তোভোগী পরিবারের সদস্য।