মৌলভী সৈয়দ: মুজিবভক্ত একবীরের গল্প

হাসান মনসুর  :: ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে যে ক’জন সাহসী সন্তান প্রাণ দিয়েছেন, তাদের মধ্যে একাত্তরের গেরিলা কমান্ডার মাওলানা সৈয়দ আহমদ অন্যতম। বস্তুত বঙ্গবন্ধুপ্রেমী এই অসীম সাহসী বীরই হলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদকারী এবং প্রথম শহীদ।বিপ্লবী সূর্য সেনের সুযোগ্য উত্তরাধিকার- চট্টগ্রামের অহংকার শহীদ মৌলভী সৈয়দ। ১৯৪৪ সালের ১১ মার্চ বাঁশখালী শেখেরখীল লালজীবন গ্রামে তাঁর জন্ম।-
পিতা একরাম আলী সিকদার, মাতা ওমেদা খাতুন। চট্টগ্রামের সমুদ্রবর্তী উপকূলীয় অঞ্চল বাঁশখালী উপজেলা। এই এলাকার মানুষের কাছে সাহস আর গর্বের নাম শহীদ মৌলভী সৈয়দ। নিজেদের এলাকার বর্ণনা আর সাহসের পরিচয় দিতে গিয়ে বাঁশখালীবাসী বলে, আমরা মাওলানা সৈয়দ আহমদের এলাকার লোক ।
১৯৬০ সালে পুঁইছড়ি ইসলামিয়া ফাযিল-ডিগ্রি মাদ্রাসা হতে উলা(ফাজিল) পাস করে পরবর্তী ইজ্জতিয়া জুনিয়র হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। তার দুই বছর পর চট্টগ্রাম শহরের ঐতিহ্যবাহী সরকারি মুসলিম হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পাস করেন। মাদ্রাসার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও তিনি ছিলেন সংস্কৃতিমনা একজন মানুষ।
এরপর সিটি কলেজে ভর্তি হন। সেই সময় ছাত্রলীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল কলেজটি। সিটি কলেজ থেকেই শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন।
১৯৬৮ ও ৬৯ এর গণআন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও যোগ্যতার বলে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বাঁশখালী সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন প্রদান করেন।
পোস্টার, লিফলেট, ফেস্টুন ও ব্যানার ছাপানোর কাজ শেষ করে তিনি যখন ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন, ঠিক ওই সময়ে ঢাকা থেকে খবর এলো তার মনোনয়ন প্রত্যাহার করে বাঁশখালীতে শাহ-ই-জাহান চৌধুরীকে মনোনয়ন প্রদান করা হয়েছে। এই কথা শুনে তিনি এতটুকু বিচলিত হননি বা তার মাঝে কোনো ধরনের ক্ষোভ দেখা যায়নি। এখন যেমন দেখা যায়, সারাবছর দলের পক্ষে কাজ করে অনেক নেতাকর্মী নির্বাচনের সময় নিজের পছন্দের মানুষ মনোনয়ন না পেলে প্রকাশ্যে দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করে। ওই প্রার্থীকে হারিয়ে নিজের কৃতিত্ব নেন। অনেক বড় বড় নেতাও মাঝে মাঝে দলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। বঙ্গবন্ধু প্রেমিক মৌলভী সৈয়দ সেদিন দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে দলীয় প্রার্থীকে বিপুল ভোটে জয়ী করে এমপি বানিয়েছিলেন।
মৌলভী সৈয়দ প্রচুর লেখাপড়া করতেন। তিনি ভালো গান গাইতেন, তার একটি ব্যক্তিগত লাইব্রেরিও ছিল। আগ্রাবাদ মিস্ত্রিপাড়ায় বর্তমান কেন্দ্রীয় আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ মাহমুদুল হকের পৈতৃক বাড়িতে তার চট্টগ্রাম শহরকেন্দ্রিক ঘাঁটিটি ছিল। এই বাড়ি থেকেই তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। পরে এখান থেকেই প্রাথমিক অবস্থায় পরিচালিত হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদী আন্দোলন। শহীদ মৌলভী সৈয়দ মেনে নিতে পারেননি বঙ্গবন্ধুকে কেউ হত্যা করতে পারে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বেঈমান খন্দকার মুশতাকের প্রাণনাশের পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন। যদিও তা বাস্তবায়ন হয়নি। গড়ে তুলেছিলেন সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ, তাও নিয়মিত একটি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে। দুর্ভাগ্য চাকচিক্যময় ডিজিটাল রাজনীতির যুগে এই নামটি বিস্মৃতির অতলে চলে যেতে বসেছে। তার আত্মত্যাগের, নায়কোচিত বীরত্বগাথা যেন এক গোপন অধ্যায়। মৃত মানুষকে বড় করে দেখাতেও এ যেন এক দীনতা-হীনমন্যতা ।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি সম্মুখ সমরের জন্য গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব গেরিলা বাহিনী। চট্টলার আঞ্চলিক ভাষায় মানুষের কাছে এই বীর-মুলই সৈয়দ নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত। চট্টগ্রামের রাজনীতির ইতিহাসে তিনি এক জীবন্ত কিংবদন্তী। বেঈমানির রাজনীতির বিরুদ্ধে আদর্শের, ইমানদারির মূর্ত প্রতীক এই বিপ্লবী মৌলভী সৈয়দ ।
চট্টগ্রামসহ এই জনপদের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের হিরো। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারী হিসেবে ঘুরেফিরে যাদের নাম উঠে আসে তাদের মধ্যে তিনি সহ এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, মরহুম সুলতানুল কবির চৌধুরী এমপি, মুক্তিযোদ্ধা এম. ইউনুস, মরহুম কাজি ইনামুল হক দানু সহ অনেকের নাম উঠে আসে। তবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল-মুজিবপ্রেমে অন্ধ মৌলভী সৈয়দ ছিলেন অতিমাত্রায় সাহসী। তিনি সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন দেশের সীমানার ভিতরেই। ভারত বর্ডার ক্রস করে দেশের ভিতরে ঢুকে অপারেশনে অংশ নিতেন তিনি ।
যখন কালো মুজিব কোট বদলে আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা খুনি মুশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগদানের জন্য উদগ্রীব ছিলেন, অনেক আওয়ামী লীগ মন্ত্রী, এমপির বাসার ড্রয়িং রুম থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামিয়ে ফেলা হয়, তখন চট্টগ্রামের মৌলভী সৈয়দ অস্ত্র আর গ্রেনেড নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশের বিভিন্ন স্থানের সামরিক চৌকিতে।
১৯৭০ সালে মুক্তিযুদ্ধের ডামাডোলের সময় লালদীঘির মাঠে জয়বাংলা বাহিনীর মার্চপাস্ট অনুষ্ঠিত হলো। সিদ্ধান্ত হলো পাকিস্তানি পতাকা পোড়ানো হবে। মৌলভী সৈয়দ বীরদর্পে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন আর পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে ফেলেন।
তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে চট্টগ্রাম গেরিলা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন। ছিলেন অনলবর্ষী বক্তা। তার বক্তৃতা শুনে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হত সাধারণ মানুষ। তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গড়ে তুলেছিলেন দুর্ধর্ষ এক গোপন গেরিলা স্কোয়াড। তার দল মৌলভী সৈয়দ বাহিনী নামে পরিচিত ছিল। এই মহান বীরের নেতৃত্বে অন্তত অর্ধশত বড় বড় সফল অপারেশন সংঘটিত হয়েছে।
চট্টগ্রামের প্রয়াত জননেতা জহুর আহম্মেদ চৌধুরীর কাছে রাজনৈতিক দীক্ষায় অনুপ্রাণিত মৌলভী সৈয়দ ছাত্রাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য লাভ করেন। তার সামনে চট্টগ্রামের কেউ পড়লে তিনি ডাক ছাড়তেন, কোথায় আমার মৌলভী সৈয়দ, মহিউদ্দিন। বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন ও আস্থাভাজন কয়েকজনের মধ্যে মৌলভী সৈয়দ অন্যতম। তিনি মৌলভী সৈয়দকে পুত্রসম স্নেহ করতেন। বঙ্গবন্ধু তাকে আমার মৌলভী সাব বলে ডাকতেন। চট্টগ্রাম এলে তিনি প্রিয় সৈয়দকে সাথে রাখতেন সবসময়। মাঝেমধ্যে ঢাকাতে খবর দিয়ে আনাতেন। তার বীরত্ব ও সাহসের ভূয়সী প্রশংসা করে উপস্থিত সকলকে শোনাতেন বঙ্গবন্ধু।
’৭৫ পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারের নিহত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের অনেক বাঘা বাঘা নেতা ভয়ে চুপসে গিয়েছিলেন বা খোলস পাল্টাতে তৎপর ছিলেন। আর সে সময়ই মৌলভী সৈয়দ সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন সামরিক জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে। ১৯৭৫ এর নভেম্বরের দিকে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কয়েকটি সফল অপারেশন পরিচালনা করেছিলেন। ঘাতকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। ১৯৭৫ এর ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান হলে, খালেদ মোশারফের পক্ষে ঢাকায় সমাবেশের উদ্যোক্তাদের অন্যতম ছিলেন এই বীর আলেম। ৭ নভেম্বর পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে যখন খালেদ মোশারফ নিহত হন, তখন মৌলভী সৈয়দ, এ.বি.এম. মহিউদ্দীন চৌধুরী সহ পুরো দলটি ভারতে আশ্রয় নেয়।
১৯৭৬ সালের ৭ নভেম্বর দেশদ্রোহিতার অভিযোগে মৌলভী সৈয়দকে ১ নং ও এ.বি.এম. মহিউদ্দীন চৌধুরীকে ২ নং আসামি করে মোট ১৬ জন বিপ্লবী নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা-১, মামলা-২, মামলা-৩ নামে পরিচিত ৩টি মামলা দায়ের করা হয়। পরবর্তীতে ভারতের জাতীয় নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধির দল পরাজিত হলে মৌলভী সৈয়দ ও সহকর্মীদের ভারতীয় সামরিক বাহিনী আটক করে ময়মনসিংহ বর্ডার দিয়ে পুশব্যাক করে। বাংলাদেশের সীমানার প্রবেশের সাথে সাথে সেদিন মৌলভী সৈয়দ সহ তার অনেক সহকর্মী গ্রেফতার হন।
পরবর্তীতে তাদের ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা হয়। ওই বছরের ১১ আগস্ট বিনা বিচারে মৌলভী সৈয়দকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান বিচারের নামে প্রহসন করে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছিলেন। সংগ্রামের মাধ্যমে যার জীবন শুরু, সংগ্রাম করেই জীবন দিয়ে গেলেন বীর শহীদ মৌলভী সৈয়দ। নির্মমভাবে হত্যার পর তার লাশ সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে বাঁশখালীতে তাঁর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করা হয়। দীর্ঘ এক মাস পুলিশ দিয়ে কবর পাহারা দেয় সামরিক সরকার, যাতে করে জনগণ এই হত্যার প্রতিক্রিয়ায় বিশৃংখলা সৃষ্টি করতে না পারে। কি রকম ভয় পেত তাকে তৎকালীন সরকার- এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায় ।
চিরকুমার শহীদ মৌলভী সৈয়দ আহমদ বীর প্রসবিনী চট্টলার বীরপুরুষ, প্রতিবাদের আইকন। অসামান্য দেশপ্রেমের অধিকারী এই বীর পুরুষটি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন দেশসেবায়। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ভালবাসা ছিল নজিরবিহীন। বাঁশখালিতে চিরনিদ্রায় কবরে শুয়ে আছেন বঙ্গবন্ধু পাগল এই মানুষটি। তার স্মরণে কিছুই করেনি কোনো সরকার। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাকে যেন মনে রাখতে পারে সে জন্য তার নামে কিছু করা উচিত।
লাল সালাম বিপ্লবী বীর মৌলভী সৈয়দ

হাসান মনসুর
সাঃ সম্পাদক(সাবেক)
কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগ।

 

Archive Calendar
Mon Tue Wed Thu Fri Sat Sun
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031