দেশগঠন এবং শান্তি রক্ষার কাজে নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। দেশের যেকোনো জরুরি পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে সন্মুখ সমরের জন্য গঠিত এই বাহিনী। দেশের সীমানা পেরিয়ে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে গিয়েও সুনাম কুড়িয়েছেন বাহিনীর সদস্যরা। অন্যদিকে, দেশের শান্তি রক্ষায় বা দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনার শিকার হয়ে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন অনেকেই।
সম্প্রতি ভারিবর্ষণে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার পরিস্থিতি অবর্ণনীয় হয়ে পড়ে। স্মরণকালের ভয়াবহতম ভূমিধসে প্রায় দেড় শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ২ সেনা কর্মকর্তাসহ ৫ জন সেনাসদস্য। দুর্গতদের উদ্ধারকাজে গিয়ে তারা নিহত হন। পাহাড়ে সহায় সম্পদের ক্ষতি হয় সর্বকালের রেকর্ড পরিমাণ। টানা কয়েকদিনে রাঙামাটি জেলায় প্রবল বর্ষণে এবং একের পর এক পাহাড় ধসের ঘটনায় যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত ও অচল হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। পাহাড়ি ঢলে ঘর-বাড়ি, গাছ-পালা ও মানুষের সহায় সম্পদের হয় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি।
এ ভয়াবহ দুর্যোগ পরবর্তী পরিস্থিতি উত্তরণে হিমশিমের মুখে পড়ে সিভিল প্রশাসন। ঠিক এমন অবস্থায় যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারে এগিয়ে আসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কন্সট্রাকশন ব্যাটালিয়ন সহ অন্য সদস্যরা। পাশাপাশি দুর্যোগ মোকাবেলায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে নৌ ও বিজিবি সদস্যদেরও। এছাড়া পুলিশী কার্যক্রম তো রয়েছেই। বিভিন্ন সেবা সংস্থার কার্যক্রম বাড়ছে। সেনাবাহিনীর এ সহায়তা কার্যক্রমকে নাম দেয়া হয়েছে ‘সম্পৃক্ত ও নিবেদিত’। রাঙামাটি ও বান্দরবানে ভূমিধসে ক্ষতিগ্রস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করতে অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছে সেনাবাহিনী। এ ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত দুর্গত পরিবারের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র খোলাসহ জরুরি ত্রাণ ও চিকিৎসা সেবা প্রদান করছে এবং বিদুৎ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করতে কাজ করছে তারা।
জানা যায়, সেনাবাহিনী এ পর্যন্ত রাঙামাটির বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১ হাজার ৫০০ জনকে খাদ্য ও ত্রাণ সহায়তা এবং প্রায় ৭ হাজার লিটার পানি বিতরণ করেছে। পাশাপাশি রাঙামাটি রিজিয়নের পক্ষ থেকে একটি পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট স্থাপনের কার্যক্রম চলছে। গত সোমবার থেকে এ প্ল্যান্টের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাধানে সকল আশ্রয় কেন্দ্রে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর মেডিকেল টিম প্রায় ১ হাজার জনকে চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করছে। দুর্গত এলাকায় জ্বালানি সংকট দেখা দেওয়ায় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রায় ৮ হাজার লিটার তেল বিতরণ করা হয়েছে।
রাঙামাটিতে মোট ১৯টি আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করেছে সেনাবাহিনী। প্রায় ৫০০টি পরিবারের ২ হাজার ১২৪ জন পাহাড়ি-বাঙালি আশ্রয় নিয়েছে সেখানে। সেনাবাহিনী ৭টি আশ্রয়কেন্দ্রের সার্বিক দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ১ হাজার ২২৬ জন দুর্গত পাহাড়ি-বাঙালি আশ্রয় নিয়েছে।
ভূমিধসে রাঙামাটির ঘাগড়া ও মানিকছড়ির মধ্যবর্তী স্থানের রাস্তা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাতছড়িতে ১০০ মিটার রাস্তা সম্পূর্ণ দেবে যাওয়ায় সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সট্রাকশন ব্যাটালিয়ন পাহাড় কেটে বিকল্প রাস্তা তৈরি করছে। আগামী দু’দিনের মধ্যে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কে মাঝারি ধরনের যান চলাচলের জন্য উপযোগী হবে। এ ছাড়া বান্দরবানের চিম্বুক-রুমা সড়কের ৫ কিমি. রাস্তা যোগাযোগের উপযোগী করা হয়েছে।
এ ধরনের পরিস্থিতি উত্তরণে একক কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে নয় বিধায় তাৎক্ষণিকভাবে সেনা সদস্যদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীর প্রধান আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক, চট্টগ্রামের জিওসি মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর কবির তালুকদারসহ উর্ধতন সেনা কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত দুর্যোগ এলাকা পরিদর্শন করছেন।
পরিস্থিতি উত্তরণে নিয়োগ করা হয়েছে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন কোরের সদস্যদের। এর মধ্যে রয়েছে কন্সট্রাকশন ব্যাটালিয়ন, রিভারাইন ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়ন, আর্মি মেডিকেল কোর, সাপ্লাই কোর, অর্ডন্যান্স কোর, ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোর ও পদাতিক (ইনফেন্ট্রি) কোরের বিভিন্ন শাখার সদস্য।
চট্টগ্রাম ২৪ পদাতিক ডিভিশন কার্যালয় ও আইএসপিআর সূত্রে মহাদুর্যোগ পরবর্তী ঘটনার তথ্য দিয়ে সোমবার জানানো হয়েছে, ভারিবর্ষণ ও আকস্মিক ভূমিধসের ঘটনা ও ঢলে রাঙামাটি ছাড়াও গুঁইমারা, রামগড়, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে পাহাড় ধস ও ঢলের পানিতে প্লাবন সৃষ্টি হয়েছে। সোমবার পর্যন্ত রাঙামাটিতে ১১৫, বান্দরবানে ৬ এবং খাগড়াছড়িতে ৫সহ ১২৬ জনের অপমৃত্যু ঘটেছে।
পাহাড় ধসের ঘটনার পর রাঙামাটি জেলার মানিকছড়িতে উদ্ধার অভিযানে যাওয়ার পর সেনাবাহিনীর দুই কর্মকর্তাসহ ৫ সদস্যের দুঃখজনক মৃত্যু ঘটেছে। এরপরও সেনা সদস্যদের কাজ থামেনি। রাঙামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলায় ব্যাপক উদ্ধার অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি দুর্গম এলাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও সেখানে চিকিৎসা সেবা খাবার বিশুদ্ধ পানীয় ও ওষুধ সরবরাহও শুরু করা হয়েছে।
বিগত কয়েক দিনে রাঙামাটি জেলায় প্রবল বর্ষণে একের পর এক পাহাড় ধসের ঘটনায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত ও জনসাধারণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় অচলাবস্থা নেমে আসে। সে সঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। জনজীবন চলে যায় দুর্বিসহ অবস্থায়। এ অবস্থায় সরকারি নির্দেশে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন কোরের সদস্যদের নিয়োজিত করা হয়েছে।
বিপর্যস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা, সচল রাস্তাঘাট, বিধ্বস্ত রাস্তাঘাট পুনঃসংস্কার কাজে তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে সেনা সদস্যরা ভারি যন্ত্রপাতি নিয়ে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। বান্দরবান জেলার রুমা এবং রাঙামাটির ঘাগড়া এলাকায় ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সট্রাকশন ব্যাটালিয়নের ২৩৩ সদস্য ১০ ডাম্পার এক হুইল লোডার, ৫ এক্সেভেটর, ১ হুইল ডোজার এবং একটি লোডার দিয়ে সংস্কার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক বুধবারের মধ্যে হালকা যানবাহন এবং এক মাসের মধ্যে ভারি যানবাহন চলাচলের উপযোগী করা সম্ভব হবে বলে তারা আশা করছেন। এছাড়া রুমা বান্দরবান রাস্তায় যানবাহন চলাচল সচল করতে আরও এক সপ্তাহ সময় লাগবে।
বিদ্যুত ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে পানি বিশুদ্ধকরণ প্লান্ট স্থাপনের জন্য সেনা সদস্যরা প্রতিকূল ও বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে খাগড়াছড়ি থেকে লংগদু পর্যন্ত এবং সেখান থেকে রাঙামাটি নদী পথে একটি জেনারেটর নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম থেকে ২টি উচ্চ শক্তিসম্পন্ন জেনারেটর, ২টি পানি বিশুদ্ধকরণ প্লান্ট, ৪টি ওয়াটার ট্যাঙ্ক, ২০০ জেরিক্যান বিশুদ্ধ পানি, বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল ইত্যাদি সড়ক পথে কাপ্তাই হয়ে নদী পথে রাঙামাটিতে প্রেরণ করা হয়েছে।
গত ১৬ জুন রাঙামাটিতে পানি বিশুদ্ধকরণ ২টি প্লান্ট এবং ৪টি ওয়াটার ট্যাঙ্ক স্থাপন করা হয়েছে। ফলে পানিবাহিত ও সংক্রামক বিভিন্ন ব্যাধি সৃষ্টি হয়নি। গত ১৬ জুন থেকে সেনাবাহিনীর ১ হাজার ৬৮৬ সদস্য অসহায় ও দুর্গতদের মাঝে চিকিৎসা সেবা প্রদান এবং ৫ হাজার লোকজনকে প্রতিদিন দুই বেলা খাবার, বিশুদ্ধকরণ ও ওষুধ বিতরণ এবং ৯০০ জনক নগদ অর্থ সহায়তা ও বস্ত্র বিতরণ করেছে। বর্তমানে ৮ মেডিক্যাল টিম ১৬টি স্থানে দুর্গতদের সহায়তা দিচ্ছে।
এছাড়া আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে প্রতিদিন রান্না করা খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। পাহাড় ধসের ঘটনার পর সেনাবাহিনীর প্রধান চট্টগ্রামের জিওসি কমান্ডার এস ডব্লিউসহ উর্ধতন সেনা কর্মকর্তারা দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। অতীতে সেনাবাহিনী ঘূর্ণিঝড় আইলা, ঢাকায় রানা প্লাজায় ভবন ধস, দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যাসহ দুর্যোগ মোকাবেলায় যে সহায়তা দিয়েছে অনুরূপভাবে পাহাড়ের তিন জেলায়ও দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় ধস পরিস্থিতি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলে আইএসপিআর ও চট্টগ্রাম সেনানিবাস সূত্রে জানানো হয়েছে।
সেনাবাহিনী প্রধান ও জিওসি ২৪ পদাতিক ডিভিশন পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত দুর্গতদের সহায়তার আশ্বাস দেন।
আইএসপিআর আরো জানিয়েছে, রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কে আগামীকাল বুধবারের মধ্যে হালকা যান এবং এক মাসের মধ্যে ভারী যান চলতে পারবে। রুমা-বান্দরবান সড়কে যান চলাচলের জন্য সাত দিন লাগতে পারে।