তানভীর রাসিব হাশেমী : আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয়। যুদ্ধের পর দেশের সব ধরনের জরুরি অবস্থা থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এই সেনাবাহিনীর অবদান অবিস্মরণীয়। তাই সেনাবাহিনীর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যেমন অনেকে `বাহ বাহ` দেয় ঠিক তেমনি বিভিন্ন অপরাধে সেনাবাহিনী জড়িত রয়েছে বলে আঙুলও তোলে। কিন্তু একটি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক বাহিনীর ওপর এ ধরনের ইঙ্গিত বরাবরই ভুল প্রমাণিত হয়। তাহলে কেন এমন ইঙ্গিত? কেন এমন দোষারোপ? তাহলে কি গণমাধ্যমগুলোর সেনাবিদ্বেষী মনোভাবের জন্য এমন ইঙ্গিত?
সেনাবাহিনী সম্পর্কে আসলে এমন মনোভাব সুস্পষ্ট নয়। যেন এক অজানা কারণে জনগণের রোষের স্বীকার হয় এই সেনাবাহিনী। ইতি চাকমার হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি নিশ্চয় ভুলে যাননি। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখ রাতে খাগড়াছড়ি শহরের আরামবাগ এলাকার বাসায় সরকারি কলেজের ছাত্রী ইতি চাকমার গলা কাটা মরদেহ পড়ে থাকতে দেখে পুলিশে খবর দেয় দুলাভাই অটল চাকমা। হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পরেই শুরু হয় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস বর্জন, কালো ব্যাজ ধারণ, মানববন্ধন, আলোচনা সভা, প্রতিবাদ মিছিল ইত্যাদি; যা শুধু খাগড়াছড়িতে সীমাবদ্ধ থাকেনি ছড়িয়ে পড়েছিলো সারাদেশে।
বিশেষ করে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে বাঙালিদের দায়ী করে প্রচুর পোস্ট ছড়িয়ে পরে। অনলাইনে এমন দাবিও করা হয় যে, ইতি চাকমাকে গনধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং এই হত্যাকাণ্ডের জন্যে বাঙালিরা দায়ী। তবে কপাল ভালো যে, খুনি তুষার চাকমাকে পুলিশ গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় এবং সে স্বীকারও করে। কোনো বাঙালি নয় বরং পাঁচ জন চাকমা যুবক এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটায়।
একবার ভেবে দেখুন পুলিশ যদি ইতি চাকমার হত্যাকারীদের ধরতে না পারতো তাহলে আজীবন বাঙালিদের এই হত্যার দায়ভার বয়ে বেড়াতে হতো। যেমনটি হচ্ছে কল্পনা চাকমার নিখোঁজ হওয়া নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে। ঘটনার পারিপার্শ্বিকতায় এটা পরিষ্কার অনুমেয় যে, তৎকালীন ভোটের রাজনীতি আর চির প্রচলিত পাহাড়িদের অন্তঃদ্বন্দ্বের বলি কল্পনা চাকমা। যেমনটি ঘটেছে আরো অনেক পাহাড়ি যুবকের ভাগ্যে, এমন কি জুম্ম জাতির মহান নেতা এম এন লারমাও রেহাই পায়নি। এখনো হচ্ছে– মিথুন চাকমা যার সর্বশেষ উদাহরণ। অথচ এ ধরনের যে কোন ঘটনাতেই বাঙালিদের অথবা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দায়ী করা হয় চিরাচরিত নিয়মের মতো। যতক্ষণ প্রকৃত সত্য না বের হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তারাই দায়ি। ‘Guilty Until Proven Innocent’ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ আর কি হতে পারে?
পার্বত্য চট্টগ্রামে আসল ঘটনা আড়াল করে, সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু উপস্থাপন করা নতুন কিছু নয়। লংগদুর ঘটনাতেও বরিশালের ও টঙ্গীর অগ্নিকাণ্ডের ছবি এবং গাইবান্দার সাওতাল পল্লীর ছবি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহার করা হয়েছে– দেশে এমনকি বিদেশে পর্যন্ত। এই ধরনের ভিন্ন উপস্থাপনায় অনেকেই বিভ্রান্ত হয়েছেন, এখনো হচ্ছেন। তারই ধারাবাহিকতায় গত কয়েকদিন দিন আগে রাঙ্গামাটির বিলাইছড়িতে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা নিয়ে প্রায় অনুরূপ নীলনকশা বাস্তবায়ন শুরু হয়ে যায়। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সেনাবাহিনীর দুই জওয়ানকে দোষী সাব্যস্ত করে বিচারের দাবিতে মিছিল শুরু করে। পরে দুই বোন ধর্ষণের যে অভিযোগ উঠে তা মিথ্যা বলে দাবি করেন তাদের বাবা উসুইচিং মারমা। পরে পাহাড়ের একটি আঞ্চলিক দল ধর্ষণের এ মিথ্যা অপবাদ ছড়িয়েছে বলে দাবি করে ওই পরিবার।
এদিকে সোহাগীকে হত্যার ধরণ, হত্যাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সংঘবদ্ধ প্রতিক্রিয়ার ধাঁচে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু বিবেচ্য বিষয় আছে। প্রথমত, সোহাগীর লাশ কুলিল্লা সেনানিবাসের এলাকাতে পাওয়া গেলেও তাকে সেনানিবাসেই খুন করা হয়েছে কিনা, সে ব্যাপারে কিছু জানা যায়নি। সোহাগীর লাশ সেনানিবাসের অভ্যন্তরের কোনো সংরক্ষিত এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়নি। তার লাশ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাস্তার কালভার্টের নিচে পাওয়া গেছে। যদি এর সাথে সেনাবাহিনীর কেউ জড়িত থাকতো, তাহলে প্রথমত লাশ খুঁজেই পাওয়া যেতো না এবং দ্বিতীয়ত, যদি খুঁজেও পাওয়া যেতো, তবে এমন কোন স্থানেই তা পাওয়া যেতো যেখান থেকে সেনাবাহিনী বা সেনানিবাসের গায়ে আঁচড় লাগার সুযোগ সৃষ্টি না হয়।
পরিশেষে যাদের জন্য বিদেশে বাংলাদেশ বিরল সম্মান, শ্রদ্ধা ও মর্যাদায় ভূষিত হচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে বাংলাকে একটি সম্মানসূচক রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদান, তারা আমাদের কাছে নূন্যতম দায়িত্ববোধ প্রত্যাশা করতেই পারে।
লেখক– সাংবাদিক