আলমগীর হোসেন ::: অস্ত্রের গর্জনে ফের অশান্ত হয়ে উঠেছে দেশের পার্বত্য অঞ্চল। সবুজ আর প্রাকৃতিক সম্পদে ভরা এই পার্বত্য অঞ্চল এখন রক্তাক্ত জনপদে পরিণত হয়েছে।
পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনাময় এই পাহাড়ি অঞ্চল ভয়ংকর হয়ে উঠছে। পার্বত্যাঞ্চলের ৪টি সংগঠনের ক্ষমতার বিস্তার, চাঁদাবাজি ও আধিপত্যের দ্বন্দ্বে রক্তাক্ত হয়ে উঠছে পাহাড়। সর্বশেষ সোমবার সন্ধ্যায় পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে উপজেলা নির্বাচনের ভোটগ্রহণের দায়িত্ব পালন শেষে ফেরার পথে বাঘাইছড়িতে ব্রাশফায়ারে নিহত হন প্রিসাইডিং অফিসারসহ সাতজন। এর মাত্র সাড়ে ১৪ ঘণ্টার মাথায় মঙ্গলবার সকালেও একই জেলার বিলাইছড়িতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুরেশ কান্তি তঞ্চঙ্গাকে গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এর আগে কয়েক মাসে বেশ কয়েকজন স্থানীয় ও জাতীয় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী নৃশংস হত্যাকান্ডের শিকার হন।
স্থানীয় বাসিন্দা ও পার্বত্য অঞ্চলে নিয়োজিত একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পার্বত্য ভুমির নিয়ন্ত্রণ ও শাসনব্যবস্থা নিজেদের হাতে রাখতে আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠনগুলো প্রতিনিয়তই রক্তক্ষয়ী হানাহানি চালিয়ে যাচ্ছে। কখনও প্রকাশ্যে আবার কখনও গোপনে তারা নানা তৎপরতা চালায়। এলাকার আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের মধ্যে কোন্দল বিরাজ করলেও প্রয়োজন মতো আবার যৌথভাবেই কাজ করছে পাহাড়ি এ সংগঠনগুলো। বিশেষ করে জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব ঠেকাতেই যৌথভাবেও কাজ করে তারা। সোমবার ও মঙ্গলবার আটজনকে হত্যার ঘটনাকে এরই উদাহরণ হিসেবে দেখছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, উপজেলা পরিষদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই বর্বরোচিত এই হত্যাকাÐগুলো ঘটেছে। এসব ঘটনার জন্য পার্বত্য অঞ্চলের আঞ্চলিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-মূল) ও জনসংহতি সমিতিকে (জেএসএস-মূল) দায়ী করছেন স্থানীয়রা।
সন্ত্রাসী হামলায় প্রিসাইডিং কর্মকর্তাসহ সাতজন নিহতের ঘটনার পর দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় চিরুনি অভিযান শুরু করেছে সেনাবাহিনী।
সন্ত্রাসীদের হামলা বিচ্ছিন্ন ঘটনা উল্লেখ করে সেনাবাহিনীর খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হামিদুল হক জানান, সন্ত্রাসী নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত থাকবে।
তিনি বলেন, সম্ভাব্য যেসব জায়গায় তারা অবস্থান করতে পারে, সেসব জায়গা আমরা খুঁজে দেখেছি। আমরা চিরুনি অভিযান করছি। কাউকে সামান্যতম ছাড় দেওয়া হবে না।
এ প্রসঙ্গে রাঙামাটি জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) আলমগীর কবির সময়ের আলোকে বলেন, সোমবার ও মঙ্গলবারের দুটি ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতা সুরেশ কান্তি ও প্রিসাইডিং অফিসারসহ মোট আটজনকে হত্যার ঘটনায় পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থা তদন্তে নেমেছে। হত্যার কারণ এবং খুনিদের সম্পর্কে নিশ্চিত করে এখনই সব বলা যাচ্ছে না বা তদন্তের স্বার্থে প্রকাশ করা যাচ্ছে না। তবে এখানে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর কোন্দল ও নানা অপতৎপরতা দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে।
এসপি আলমগীর কবির বলেন, এই দুটি ঘটনার পর জড়িতদের গ্রেফতারে বিশেষ অভিযান শুরু করা হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলে শিগগিরই শুরু হবে যৌথবাহিনীর ‘অল আউট’ অভিযান।
গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের তথ্য মতে, পার্বত্য অঞ্চলের ইউপিডিএফ (মূল বা প্রসীত গ্রুপ), ইউপিডিএফ (সংস্কার), জেএসএস (মূল বা সন্তু লারমা গ্রুপ) ও জেএসএস (সংস্কার) নামে ৪টি সংগঠনের ছত্রছায়ায় রয়েছে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ। আঞ্চলিক এসব সংগঠনের সন্ত্রাসীরা পার্বত্য অঞ্চলের বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি, সাজেক, নানিয়ারচর, বালাঘাটা, নাইক্ষ্যংছড়ি, গুইমারা, সিন্দুকছড়ি, মাটিরাঙ্গা, রামগড়, লক্ষ্মীছড়ি, মানিকছড়ি, করল্ল্যাছড়ি, পানছড়ি ও থানচিসহ আরও কিছু এলাকায় তাদের নানা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
গোয়েন্দারা আরও জানান, পাহাড়ের নিরীহ বাঙালি ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি করে সেই টাকায় আগ্নেয়াস্ত্র কিনে মজুদ বাড়াচ্ছে আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠনগুলো। পার্বত্য অঞ্চলভিত্তিক উপজাতীয় এসব সংগঠনের হাতে বর্তমানে প্রায় ৪ হাজারের মতো অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র মজুদ রয়েছে বলে ধারণা গোয়েন্দাদের। এসএমজি (সাব মেশিন গান), একে-৪৭ কিংবা একে-২২ রাইফেল থেকে শুরু করে নানা ধরনের ভারি আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে আঞ্চলিক একাধিক সংগঠনের সদস্যদের হাতে। এসব অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র পার্বত্য শান্তি চুক্তির প্রধান অন্তরায় হিসেবেও কাজ করছে বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
সোমবার ও মঙ্গলবার পৃথক দুটি ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতাসহ আটজন নিহত হওয়ার ৩ দিন আগে ১৫ মার্চ খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার নাপিতাপাড়ায় প্রতিপক্ষের গুলিতে বিনাষন চাকমা নামে এক ইউপিডিএফ নেতা নিহত হন। তার আগে ৭ মার্চ রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে দুর্বৃত্তদের গুলিতে ইউপিডিএফ নেতা উদয় বিকাশ চাকমা নিহত হন। এর আগে ৪ ফেব্রæয়ারি আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাঙামাটির কাপ্তাইয়ের রাইখালীর কারিগরপাড়ায় দুর্বৃত্তের গুলিতে জনসংহতি সমিতির সংস্কার গ্রæপের কর্মী মংসিনু মারমা ও তার বন্ধু ছাত্রলীগ কর্মী জাহিদ নিহত হন। মংসিনু মারমা ও জাহিদ দোকানে বসে চা খাওয়ার সময় দুর্বৃত্তরা তাদের ওপর গুলি করে পালিয়ে যায়। তার আগে ২৪ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্রিক ইউপিডিএফ সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীর কার্যালয়ে হামলার মধ্যে গোলাগুলিতে নিহত হন চিক্য চাকমা ও সোহেল রানা নামে দুজন। এ ছাড়াও গত বছরের ৩ মে জেএসএস (সংস্কার) সমর্থিত নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে ইউপিডিএফের (মূল) সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে। পরদিন তার শেষকৃত্যে যোগ দেওয়ার সময় ব্রাশফায়ারে নিহত হন ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) শীর্ষ নেতা তপন জ্যোতি চাকমা বর্মা, জেএসএসের (সংস্কার) সদস্য প্রিয় চাকমা, সুজন চাকমা, সেতু লাল চাকমা ও বাঙালি মাইক্রোচালক সজীব হাওলাদার। ওই ঘটনায় আহত হন অন্তত আটজন। তার আগেই গত ২ মে ইউপিডিফের সাবেক সদস্য উজ্জ্বল কান্তি চাকমাকে জেএসএসের (সংস্কার) সশস্ত্র ক্যাডাররা গুলি করে হত্যা করে। একই বছরের ১৬ জুন পানছড়ি উপজেলার পাইংপাড়া মরাটিলায় ইউপিডিএফের সন্ত্রাসীদের গুলিতে জেএসএসের (সংস্কার) চাঁদা কালেক্টর বিজয় ত্রিপুরা নিহত হন। এ ছাড়াও গত বছরের ২৮ মে সাজেক থানার করল্ল্যাছড়ি এলাকায় ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) ক্যাডারদের গুলিতে ইউপিডিএফের (মূল) সদস্য স্মৃতি চাকমা, সুশীল চাকমা ও অটল চাকমা নিহত হন।
সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, ১৯৯৭ সালে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির সঙ্গে (জেএসএস) সরকারের শান্তি চুক্তির পর তখনই এর বিরোধিতা করে ইউপিডিএফ। শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করে পার্বত্য অঞ্চলে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে ইউপিডিএফ। মূলত তারপরেই পাহাড়ে আবারও রক্তের খেলা শুরু হয়। এরপর ২০০৭ সালে জেএসএস থেকে বেরিয়ে রূপায়ণ দেওয়ান-সুধাসিন্ধু খীসাদের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) যা সংস্কার নামেও পরিচিত। এত দিন ইউপিডিএফ ও জেএসএস (সংস্কার) দুই সংগঠন অনেকটা এক হয়ে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএসের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিল। কিন্তু বছর দুয়েক আগে ইউপিডিএফ ভেঙে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে পাহাড়ের চতুর্থ আঞ্চলিক দল বা সংগঠন গঠিত হলে এই চার সংগঠনের ক্ষমতার বিস্তার, চাঁদাবাজি ও আধিপত্যের দ্ব›েদ্ব আবারও অশান্ত হয়ে উঠেছে পাহাড়।