মুল বিজুর দিনে পাহাড়ী বাঙ্গালী সকল সম্প্রদায়ের মিলন মেলা, আজ পহেলা বৈশাখ

॥ নন্দন দেবনাথ ॥ পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর সম্প্রদায়ের প্রধান সামাজিক উৎসব বিজু-সাংগ্রাই-বৈসুক-বিষু-বিহু-সাংক্রানের অথ্যাৎ বৈসাবির আজ দ্বিতীয় দিন। আজ মুল বিজু। ২য় দিন পাহাড়ীদের ঘরে ঘরে চলছে আদিবাসীদের বিশেষ খাবার পাঁজন রান্নার আয়োজন। পাঁজনের সুবাসে মৌ মৌ করছে চাকমা অধ্যূষিত জনপদ গুলোতে। বৈসাবীর ২য় দিনে আদিবাসীরা অতিথিদের পাঁজন ও মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করছে। এদিকে আজ রাঙ্গামাটিতে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে মঙ্গল শোভাযাত্রা সহ পান্তা উৎসবের আয়োজন রয়েছে।
ঐতিহ্যবাহী এই পাজন রান্না করা হয় সর্বোচ্চ প্রায় ৫০টির ও বেশী বিভিন্ন ফল ও সব্জী দিয়ে। উপজাতীয়দের ধারনা বছরের শেষ বা প্রথম দিনে এ পাজন খাবার খেলে বিভিন্ন প্রকারের রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ইতিমধ্যে তিন জেলার আদিবাসীদের প্রতিটি ঘরে তাদের ঐতিহ্যবাহী এ খাবার খেতে পাহাড়ী-বাঙ্গালী সকলেই মিলেমিশে বেড়াতে শুরু করেছে।
বৈসাবি উৎসবের মুল বিজুর দিনে পাহাড়ী প্রতিটি ঘরে ঘরে চলছে অতিথি আপ্পায়ান। রাঙ্গামাটি আসনের সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার, রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমা, সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা সহ রাঙ্গামাটির গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গের বাড়ীতে চলছে বৈসাবি উৎসবের মুল আয়োজন। বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ, পাহাড়ী-বাঙ্গালী সকল সম্প্রদায়ের মানুষেরা মুল বিজুর শুভেচ্ছা বিনিময় করতে এবং আপ্পায়ন গ্রহণ করতে ছুটে গেছেন এ বাড়ী থেকে এই বাড়ীতে।
রাঙ্গামাটি ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল রিয়াজ হায়দার, পুলিশ সুপার মোঃ আলমগীর কবির, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এস,এম শফি কামাল, সহ সরকারী বেসরকারী কর্মকর্তারা দীপংকর তালুকদারের বাসায় বিজুর শুভেচ্ছা জানাতে ছুটে যান।
বান্দরবানে শুরু হয়েছে মারমা সম্প্রদায়ের প্রানের উৎসব মাহা সাংগ্রাইং পোয়েঃ উৎসব। উৎসবকে ঘিরে বান্দরবান পার্বত্য জেলার ১১ টি ক্ষুদ্র নৃ গোষ্টি সম্প্রদায় ও বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের মধ্যে বইছে আনন্দের বন্যা। বিভিন্ন পাড়া ও গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে পুরাতন বছরকে বিদায় আর নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আহবান।
নতুন বছরকে বরণ করে নিতে প্রতিবছরই পার্বত্য এলাকায় বসবাসরত মারমা সম্প্রদায়ের জনসাধারণ উদযাপন করে সাংগ্রাইং উৎসব। প্রতিবছরের ১৩ই এপ্রিল থেকে বিভিন্ন অনুষ্টানমালার আয়োজন করে কয়েকদিন ব্যাপী পার্বত্য এলাকায় চলে এই উৎসবে আমেজ।
প্রতিবছরের মত মারমাদের সাংগ্রাইং উৎসবকে ঘিরে শনিবার সকালে সাংগ্রাইং উৎসব উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে বান্দরবান রাজার মাঠ থেকে বের করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রাটি বান্দরবানের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে আবার একই স্থানে গিয়ে শেষ হয়। এসময় ১১ টি ক্ষুদ্র নৃ গোষ্টি সম্প্রদায় ও বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের তরুণ তরুণীরা বিভিন্ন ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে পুরাতন বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। র‌্যালীতে অংশ নেয় মারমা, চাকমা, ¤্রাে, ত্রিপুরা, চাক সহ ১১ টি ক্ষুদ্র নৃ গোষ্টি সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষসহ বাঙ্গালী জনসাধারণ।
ত্রিপুরাদের প্রথমদিন হারিবৈসু উপলক্ষে গ্রামের পর গ্রামে চষে বেড়াচ্ছেন, বিশেষ নাচের দল “গরয়া”। একেকটি দলে ৫০ থেকে ৬০ জনের নৃত্যশিল্পীরা পাহাড়ী জনপদে ঢোল আর বাঁশির সুরে ছড়িয়ে দিচ্ছেন ঐতিহ্যদীপ্ত ঝংকার। আবার কেউ কেউ পূণ্যার্জনের লক্ষ্যে পাড়ি জমান তীর্থস্থান “দেবতাপুকুর”-এ। ত্রিপুরাদের বিশ্বাস এইদিনে পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত পুকুরে ¯œান করে দেবতাকে পূজা করলে অশেষ মনোবাসনা পূরণ হয়। এসময় ঘরে থাকা পরিবারের অন্যরা বুনোফুলের মালা দিয়ে ঘর সাজান পরিপাটি করে।
আর মারমা গ্রামে চলছে লুপ্তপ্রায় খেলাধূলা। কাল থেকে শুরু হবে মারমাদের “সাংগ্রাই” উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা।
চাকমাদের বিজু, মারমাদের সাংগ্রাই আর ত্রিপুরাদের বৈসু মিলে এককথায় বৈসাবি উৎসব নামে তিন পার্বত্য জেলায় সমধিক পরিচিত। একই সময়ে সমমনা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠির আনুষ্ঠানিকতাও চলছে সমানতালে। তবে ত্রিপুরাদের শৌর্য-বীর্য্য আর সমৃদ্ধির প্রতীকি নৃত্যই যেনো উৎসবে জাগিয়ে দিচ্ছে দুরগ্রাম থেকে শহরতলী।
সংস্কৃতিপ্রিয় মানুষের কাছে “গরয়া”-র বিশেষ আকর্ষণ যেনো ফুরাবার নয়। তাই ত্রিপুরাদের পোশাকের উজ্জলতা, নাচে-গানে মুখর গরয়া’র সংঘবদ্ধ নৃত্যশৈলীকে স্বাগত জানাচ্ছেন, ত্রিপুরা’রা। ঘরে ঘরে-বাড়ীর উঠোনে গরয়া দলের প্রধান “অচাই (পুরোহিত)”র মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে নতচিত্তে পূজা-অর্চণা চলছে। নাচ শেষে সামর্থ্য অনুযায়ী যে যাই দেন তাই নিয়েই সন্তুষ্ট পাড়ি জমান গরয়া শিল্পীরা।
আজকের এ দিনে পাহাড়ের প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে শুধূ চলে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব ও আন›ন্দ-পূর্তি। কয়েক প্রকার তরকারী দিয়ে তৈরী পাচনসহ বিভিন্ন রকমের সুস্বাদু খাবার দাবার আগত অতিথিদের পরিবেশন করা হয়। এদিন ধনী-গরিব সবাইয়ের জন্য সবার দ্বার উন্মুক্ত থাকে। মূল বিজুটি পাহাড়িরা হৈ-চৈ করে ঘুরে বেড়ানো আর খাওয়া-দাওয়া আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে পুরাতন বছরকে বিদায় করে দিয়ে থাকে।
এদিকে আজ রাঙ্গামাটিতে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে মঙ্গল শোভাযাত্রা সহ পান্তা উৎসবের আয়োজন রয়েছে। আজ সকাল ৮ টায় মঙ্গল শোভাযাত্রা। রাঙ্গামাটি পৌরসভা প্রাঙ্গন থেকে জেলা প্রশাসক কার্যালয় প্রাঙ্গন। সকাল সাড়ে ৮ টায় জেলা প্রশাসক কার্যালয় প্রাঙ্গনে বৈশাখী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও পান্তা উৎসব। বিকাল ৩টায় মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুস শুক্কুর স্টেডিয়ামে ঐতিহ্যবাহী বলি খেলা। এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠান মালার আয়োজন রয়েছে। এছাড়া সেনাবাহিনীর উদ্যোগে রয়েছে পহেলা বৈশাখের বর্ণিল আয়োজন।
উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসরত এগার ভাষাভাষি ১৪টি পাহাড়ী সম্প্রদায় তিন দিন ব্যাপী বিজু-সাংগ্রাই-বৈসুক-বিষু-বিহু-সাংক্রান উৎসব পারণ করে থাকে। এ উৎসবটি নানান নামে অভিহিত করলেও এর নিবেদন ও ধরন কিন্তু একই। এ উৎসবটি পাহাড়ী সম্প্রদায়ের শুধু আনন্দের নয়, সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক, ঐক্য ও মৈত্রী বন্ধনের প্রতীকও বটে। বাংলা বর্ষের শেষ দুদিন ও নতুন বছরের প্রথম দিন এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে।

Archive Calendar
MonTueWedThuFriSatSun
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930