উন্নয়নের ছোঁয়ার বাইরে ফারুয়ার যমুনাছড়ির বম জনগোষ্ঠী, জুম চাষেই ভরসা

॥ সুজন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, বিলাইছড়ি ॥ রাঙ্গামাটি বিলাইছড়ির ফারুয়া ইউনিয়নে যমুনাছড়ি পাড়ার শতাধিক খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী বম জনগোষ্ঠীর এখনো উন্নয়নের ছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন বলে দাবী করছেন। জুম চাষেই তাদের একমাত্র ভরসা। যোগাযোগ সুবিধার জন্য প্রয়োজন কমপক্ষে ২ কিলোমিটার সড়ক পথ। প্রয়োজন প্রশাসনের সুদৃষ্টি। সরেজমিনে দেখতে এবং তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বম পাড়াটি চারদিকে পাহাড়। পাড়ার পাশদিয়ে রাইংখ্যং নদী বয়ে গেছে। এবং পাহাড়ের নীচে একটি সমতল জায়গায় প্রায় ১০২ পরিবার ১৯৮০ সনে সাইচল এলাকা হতে এই যমুনা ছড়িতে বসতি স্থাপন করে। এছাড়াও রয়েছে ৪টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, একটি জিপিএস এবং একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র ১টি।
সেখানে রেভাঃ রবার্ট বম জানান, এখনো আমরা উন্নয়নে ছোঁয়ার বাইরে রয়েছি। জুম চাষে একমাত্র ভরসা। জুমে ধান আর সেই ধানের সঙ্গে আদা, হলুদ, কলা, মারফা ও অন্যান্য সবজি ফলন যা হয় তা বিক্রয় করে কোনো উপায়ে চলি। এখন জুমেও আগের মতো ফলন হয় না। তাছাড়া ফরেস্ট এলাকা জুম চাষ করতে গেলেও অনুমোদন লাগে। অনেক দুরে গিয়ে জুম চাষ করতে হচ্ছে। প্রায় ১ দিনের পথ। প্রতি জায়গায় একটা জায়গায় জুম করলে ফলন ভালো আসে না।
তিনি আরো জানান, যোগাযোগের জন্য একমাত্র পথ হলো কাঁচা রাস্তায় পায়ে হেঁটে যাওয়া এবং আঁকাবাঁকা পথে চলা। বর্ষা মৌসুমে ইউনিয়ন সদর ফারুয়া বাজার হতে ৩ মাস পর্যন্ত বোটে যেতে পারে। শুকনো মৌসুমে হেঁটে আসা- যাওয় করতে হয়।এজন্য বাজারে মারফা, চিনাল, তিল, কুমড়া, কলা, আদা হলুদ, মরিচসহ ইত্যাদি ফলমূল ও অন্যান্য সবজি বিক্রয় করতে হলে প্রায় তেরো-চৌদ্দ কিলোমিটার কাঁধে করে নিয়ে বিক্রয়ের জন্য বাজারে আসতে হয়। যা আসা-যাওয়ার জন্য প্রায় ১ দিন সময় লাগে।
নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক যমুনা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক জানান, ১৯৯৮ সালে বিদ্যালয়টি স্থাপিত করা হলে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিলাইছড়ি সেনা জোনের সহায়তায় চলে বিদ্যালয়টি। ২০০৮ হতে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা “টংগ্যা” পরিচালনা করে। এরপর থেকে অভিভাবক ও পাড়াবাসী পরিচালনা করে আসছে। বেতন দিতে পারেনা যা আমরা মানবেত জীবন-যাপন করছি। ৬০ হাজার টাকা বকেয়া, বেতন এখনো পায়নি। শিক্ষার্থীদের যদি না পড়ায় তাহলে ঝড়ে যাবে আর পড়ালেও নিজের কাজ বাদ দিয়ে পড়াতে হয়। ৪ জন তালিকায় থাকলেও ২ জনেই পড়াচ্ছি। সেই বেতনও পাচ্ছি না। জাতীয়করণের জন্য কাগজ পত্র জমা দেওয়া হয়েছে। এ আশায় রয়েছি।
হেডম্যান পালম বম দুঃখ করে জানান, এই এলাকায় সরকারিভাবে তেমন উন্নয়ন বলতে নেই। বিভিন্ন পাড়া সীমান্ত সড়কের সঙ্গে সংযোগ করা হয়েছে। করা হয়নি আমাদের বম পাড়া। উন্নয়নে সবার সহযোগিতা দরকার। গ্রামটি তারাছড়ি টু তাংকইতাং যাওয়ার পথে যে রাস্তা উন্নয়ন করা হয়েছে। সেই মাঝখান রাস্তা হতে মাত্র এক-দেড় কিলোমিটার রাস্তা বা সড়ক পথ নির্মাণ করলে যমুনা ছড়ির সঙ্গে সংযোগ করা যেতো। নতুবা শুক্কর ছড়ি হতে এক-দেড় কিলোমিটার রাস্তা/সড়ক নির্মাণ করলে যোগাযোগে সুবিধা পেতো আমাদের পাড়ার জনগণ।
তিনি আরো জানান, বিগত ১৭ বছর পর্যন্ত এই এলাকায় কোনো উন্নয়নে ছোঁয়া লাগেনি। তাই উন্নয়নে সবার সদিচ্ছার প্রয়োজন। কোনো এলাকাকে বাদ দেওয়া সেটা মানে হয় না। গত বছর ও এর আগে বছরে প্রবল বন্যায় ধসে গেছে ঘাটের সিঁড়িটি যা পুনঃ নির্মাণ ও সংস্কারের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এমনিতে ধ্বসে পড়ে রয়েছে। কম্পেশন/আগাপে শিক্ষার্থীদের মাঝে আগের মতো অনুদান দেয় না। তিনি আরো জানান, সদর ও শহরে গেলে যেভাবে রঙিন জগতে ঘুরছি মনে হয়, কিন্তু নিজের জায়গায় আসলে মনে হয় আমরা পৃথিবীর বাইরে অন্য ভিন্ন জগতে আছি। নেই যোগাযোগ, নেই নেটওয়ার্ক, নেই বিদ্যুৎ, নেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নেই ঠিকমতো স্বাস্থ্য সেবা।
এছাড়াও তিনি জানান, সুপেয় পানি ব্যবস্থার জন্য কোনো ডিপটিউয়েল নেই, নেই কোনো রিংওয়েলও। এডিবি থেকে অনেক আগে প্রায় কয়েক লক্ষ টাকার ব্যয়ে একটি জিপিএস দেওয়া হলেও বর্তমানে তা নষ্টের পথে। পানির উৎস বা ঝর্ণা রক্ষা করার জন্য ৬০০ একর মতো পাহাড় এলাকা জুম চাষ করে না। ছড়ার উৎস হতে যে পানি আনা হয় তা ফিন্টার নষ্ট হয়ে এখন দুর্গন্ধযুক্ত পানি পান ও ব্যবহার করতে হয়। প্রায় অকেজো হচ্ছে। রাইংখ্যং খালের পানিও সবসময়ই গোলা থাকে। বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি ব্যবহার করলেও শীতকালে সম্ভব হয় না। এটা ঠিক করতে হলে সরকার ছাড়া আমাদের কোনো সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে ওয়ার্ড মেম্বার মালসম জানান, তাদের দ্রুত স্কুল নির্মাণ ও স্কুলে জন্য শিক্ষার্থীদের বসার সিট চেয়ার, টেবিল, সুপের পানির জন্য ডিপ টিউওয়েল ও মূল সড়কের সঙ্গে ১টি সংযোগ সড়ক নির্মাণ করার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসন, জেলা পরিষদ, উন্নয়ন বোর্ড এবং পার্বত্য উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমার সুদৃষ্টি কামনা করেন।
ফারুয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিদ্যালাল তঞ্চঙ্গ্যা জানান, তারাছড়ি হতে তাংকইতাং যাওয়ার রাস্তা মাঝখানে যমুনা ছড়ি বম পাড়ার সংযোগে কাঁচা পাহাড়ী ঢালু রয়েছে যার দৈর্ঘ্য ২-২.৫ কিলোমিটার হবে। এই রাস্তাটি খাড়া পাহাড়ী ঢালু রাস্তা হওয়াতে রাস্তাটি এইচবিবি, আরসিসি/পাকা পিছ ঢালাই (স্থায়ী কাজ) করা গেলে এবং যমুনা ছড়ি ছড়ার উপরে ৪০/৫০ মিটারের দৈর্ঘ্য পাকা সেতু নির্মাণ করা গেলে যমুনা ছড়ি বম পাড়ায় সরাসরি গাড়ি যেতে পারবে এবং এতে গ্রামবাসীরা যাতায়াত এবং পণ্য পরিবহনে সুবিধা হবে। তবে এর সাথে তারাছড়ি হতে তাংকইতাং পাড়ায় যাওয়ার রাস্তাটিও পাকা/আরসিসি অথবা এইচবিবি করা গেলে সেক্ষেত্রে সারা বছর গাড়ি চলাচল করতে পারবে।
এইসব বিষয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (অ:দা:)মিলন চাকমার সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি জানান, কি উন্নয়ন প্রয়োজন অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি দরখাস্ত জমা দেওয়ার কথা বলেন।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ মামুনুল হক জানান, উন্নয়নের জন্য আমি এখানে রয়েছি, উন্নয়ন অব্যাহত থাকবে। এলাকার জনপ্রতিনিধি’র সঙ্গে কথা বলবো। প্রয়োজনে যাবো, দেখবো। তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা জেনে তারপরে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নসহ শিক্ষা ও সুপেয় পানি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।

থানচি সীমান্ত সড়কের ব্রীজ উদ্বোধন ও ২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন পাহাড়ে উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ শান্তির পরিবেশ বাস্তবায়নে সেনাবাহিনী নিরলস কাজ করে যাচ্ছে —–ব্রিঃ জেঃ মোঃ শামসুল আলম

Archive Calendar
MonTueWedThuFriSatSun
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930