‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ জাতীয়ভাবে পালনের যৌক্তিকতা নেই

বৃহস্পতিবার, ১০ আগস্ট ২০১৭
প্রতি বছর ‘আদিবাসী ফোরাম’ নামক সংগঠনের ব্যানারে সন্তু লারমা এবং ঢাকার কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি বাংলাদেশে ৯ আগস্ট ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ জাতীয়ভাবে পালনের আহ্বান জানিয়ে থাকেন। প্রতিনিয়ত সংবাদ সম্মেলন করে পার্বত্য ইস্যুতে অনেক কথা বলা হচ্ছে। নিজেদের অধিকার আদায়ে দেশে একটি গণমুখী সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য আদিবাসীদের ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) চেয়ারম্যান সন্তু লারমা। তিনি সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির পাশাপাশি সংসদের উত্থাপিত তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ বিল-২০১৪ প্রত্যাহার এবং পাস হওয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড আইন ২০১৪ বিলুপ্তির দাবি জানিয়েছিলেন। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে পার্বত্য এলাকায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপনের বিরোধিতা করেন তিনি। পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নসহ বেশ কয়েকটি দাবিতে রাজধানীর এক হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেন, ‘পার্বত্যবাসী এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের জন্য এখনো প্রস্তুত নয়। এগুলো বহিরাগত অনুপ্রবেশের দ্বারে পরিণত হবে। তাই চুক্তি বাস্তবায়ন পর্যন্ত এসব প্রকল্প স্থগিত রাখার আহ্বান জানাচ্ছি।’ উপরন্তু দেশের অন্যান্য স্থানে অবস্থিত প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজসহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাহাড়ি ছাত্রছাত্রীদের অধিক সংখ্যক কোটা সংরক্ষণের আহ্বান জানিয়েছিলেন সন্তু লারমা। তার কথার সূত্র ধরে বলা দরকার, পার্বত্য এলাকার অধিকাংশ উপজাতি জনগোষ্ঠী কোটা সুবিধা গ্রহণ করে কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয় অনেক সরকারি অফিসে উচ্চ পদে আসীন। এ কারণে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সমতলের বাঙালিদের দ্বারা এই কোটা সুবিধা বাতিলের কিংবা কমানোর দাবি আসাটাও যৌক্তিক। আশ্চর্য হলো- পাহাড়ি জনজীবনে প্রভূত উন্নতি সত্ত্বেও বর্তমান সরকার উপজাতীয় কোটা সংরক্ষণ করছেন।

২০১৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাঙ্গামাটি সফরের সময় জনসমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে একটি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনের ঘোষণা দেন। তারপর থেকেই এর পক্ষে-বিপক্ষে স্থানীয়দের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক চলে। অথচ পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। ৫ জানুয়ারি (২০১৪) নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের ‘সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, অনুন্নত সম্প্রদায় ও পার্বত্য চট্টগ্রাম’ শীর্ষক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সংসদে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনী পাস করে আওয়ামী লীগ ১৯৭২-এর সংবিধানের চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছে। সকল ধর্মের সমান অধিকার এবং দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-জাতিগোষ্ঠী ও উপজাতিদের অধিকার ও মর্যাদার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়ার ফলে ধর্মীয় ও নৃ-জাতিসত্তাগত সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অবসান এবং তাদের জীবন, সম্পদ, উপাসনালয়, জীবনধারা ও সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য রক্ষার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা দৃঢ়ভাবে সমুন্নত থাকবে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জমি, বসতভিটা, বনাঞ্চল, জলাভূমি ও অন্যান্য সম্পদের সুরক্ষা করা হবে। সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জমি, জলাধার ও বন এলাকায় অধিকার সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণসহ ভূমি কমিশনের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। অনগ্রসর ও অনুন্নত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, দলিত ও চা-বাগান শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে বিশেষ কোটা এবং সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত থাকবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির অবশিষ্ট অঙ্গীকার ও ধারাগুলো বাস্তবায়িত করা হবে। পার্বত্য জেলাগুলোর উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা হবে এবং তিন পার্বত্য জেলার ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুণœ রাখা, বনাঞ্চল, নদী-জলাশয়, প্রাণিসম্পদ এবং গিরিশৃঙ্গগুলোর সৌন্দর্য সংরক্ষণ করে তোলা হবে। এই তিন জেলায় পর্যটন শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী কুটিরশিল্পের বিকাশে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।’ অর্থাৎ বর্তমান সরকারের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাই রয়েছে সন্তু লারমাসহ সব উপজাতি জনগোষ্ঠীর জানমাল ও সম্পদ সুরক্ষার বিষয়ে। ওয়াদা করা হয়েছে অনগ্রসর ও অনুন্নত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, দলিত ও চা-বাগানের শ্রমিকদের জন্য কোটা ও সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত রাখার। আর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন ও সে অঞ্চলের উন্নয়নে প্রতিশ্রæতিও দেয়া হয়েছে। গত মহাজোট সরকারের শাসনামলে তিন পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে শেখ হাসিনার সরকার ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। যে দুর্গম এলাকা মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরে ছিল সে স্থানগুলো তথ্য-প্রযুক্তির আওতায় আনা হয়েছে। যেখানে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও বাজারের সংকট ছিল সেসব জায়গা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার উপায় হিসেবে গণ্য হচ্ছে। এতদ সত্ত্বেও যদি হুমকি দেয়া হয় তাহলে সন্তু লারমাদের উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের মতো সাধারণ জনতার মনে আশঙ্কা এবং প্রশ্ন জাগ্রত হওয়াটাই কি স্বাভাবিক নয়?

উপজাতীয় কোটা সম্পর্কে আগেই বলা হয়েছে। সংবিধানে স্বীকৃত রয়েছে সেই কোটা ব্যবস্থা। বাংলাদেশ সংবিধানের ২৩(ক) অনুচ্ছেদে বর্ণিত দেশের ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়’-এর জন্য সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরির ক্ষেত্রে এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য কোটা সুবিধার কথা রয়েছে। অথচ এসব সুবিধাভোগীরা প্রতি বছর ‘আদিবাসী ফোরাম’ নামের সংগঠন থেকে ৯ আগস্ট ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ পালনের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে। পক্ষান্তরে কয়েক বছর যাবৎ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আদিবাসী শব্দটি না থাকায় বিভিন্ন জেলা প্রশাসকের কাছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে বিশ্ব আদিবাসী দিবস উদযাপনে সরকারের কোনো পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত না হওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়’ শব্দগুলোর পরিবর্তে আদিবাসী ফোরামের দাবি এখানে ‘আদিবাসী জাতিসমূহ’ সংযুক্ত করা হোক। বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন এবং তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট আছেন। অথচ জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা আগের বছরগুলোর মতো এবারো নানা বক্তব্য ও মন্তব্যে অসহযোগিতার মনোভাব প্রকাশ করেছেন। সন্তু লারমা সম্ভবত আইএলও কনভেনশন-১০৭ এর অনুচ্ছেদ ১ এর উপঅনুচ্ছেদ ১(খ) বর্ণিত ‘আদিবাসী’ সংজ্ঞাটি মনোযোগ সহকারে পাঠ করেননি। সেখানে বলা হয়েছে- ‘স্বাধীন দেশসমূহের আদিবাসী এবং ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীর সদস্যদের ক্ষেত্রে রাজ্য বিজয় কিংবা উপনিবেশ স্থাপনকালে এই দেশে কিংবা যে ভৌগোলিক ভূখণ্ডে দেশটি অবস্থিত সেখানে বসবাসকারী আদিবাসীদের উত্তরাধিকারী হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ‘আদিবাসী’ বলে পরিগণিত এবং যারা, তাদের আইনসঙ্গত মর্যাদা নির্বিশেষ নিজেদের জাতীয় আচার ও কৃষ্টির পরিবর্তে ওই সময়কার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আচার ব্যবহারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপন করে।’ অন্যদিকে ‘উপজাতি’ সম্পর্কে আইএলও কনভেনশন-১০৭ এর অনুচ্ছেদ ১ এর উপঅনুচ্ছেদ ১(ক) অংশে বলা হয়েছে- ‘স্বাধীন দেশসমূহের আদিবাসী এবং ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীর সদস্যদের বেলায়, যাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা জাতীয় জনসমষ্টির অন্যান্য অংশের চেয়ে কম অগ্রসর এবং যাদের মর্যাদা সম্পূর্ণ কিংবা আংশিকভাবে তাদের নিজস্ব প্রথা কিংবা রীতিনীতি অথবা বিশেষ আইন বা প্রবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।’ অর্থাৎ ‘আদিবাসী’ হলো ‘সন অব দি সয়েল’। আর ‘উপজাতি’ হলো প্রধান জাতির অন্তর্ভুক্ত ক্ষুদ্র জাতি।

‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র ২০০৭’ অনুসারে তাদের ৪৬টি অধিকারের কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে। এই ঘোষণাপত্রে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়নি বা সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত হয়নি। তাছাড়া ঘোষণাপত্রের ওপর সব সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে সর্বসম্মত সমর্থন নেই। এ কারণে বাংলাদেশ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক ঘোষণাপত্রের ওপর ভোট গ্রহণের সময় তারা ভোটদানে বিরত ছিল। তবে যেকোনো অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীর অধিকারের প্রতি সমর্থন রয়েছে সরকারের। সংবিধান অনুসারে সরকারপ্রধান মানবাধিকার চুক্তির প্রতি অনুগত এবং উপজাতিদের অধিকার সমর্থন করে আসছে। উল্লেখ্য, ‘আদিবাসী’ শব্দটি সংবিধানে সংযোজিত হলে ২০০৭ সালের ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র’ মেনে নিতে হবে; যা হবে বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী। কারণ ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ-৪-এ আছে : ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার চর্চার বেলায়, তাদের অভ্যন্তরীণ ও স্থানীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসন এবং স্বশাসিত সরকারের অধিকার রয়েছে ও তাদের স্বশাসনের কার্যাবলির জন্য অর্থায়নের পন্থা এবং উৎসের ক্ষেত্রেও অনুরূপ অধিকার রয়েছে।’ অর্থাৎ ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করলে ও পার্বত্য অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের অনুমতি ছাড়া বাংলাদেশ সরকার খাগড়াছড়ির গ্যাস উত্তোলন করে অন্য জেলায় আনতে পারত না। কারণ সেখানকার স্বশাসিত আদিবাসী শাসক নিজেদের অর্থায়নের উৎস হিসেবে সেই খনিজ, বনজ ও অন্যান্য সম্পদ নিজেদের বলে চিন্তা করত। আবার অনুচ্ছেদ-৩৬-এ আছে, ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর, বিশেষত যারা আন্তর্জাতিক সীমানা দ্বারা বিভক্ত হয়েছে, তাদের অন্য প্রান্তের নিজস্ব জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক কার্যক্রমসহ যোগাযোগ সম্পর্ক ও সহযোগিতা বজায় রাখার ও উন্নয়নের অধিকার রয়েছে।’ রাষ্ট্র এই অধিকার কার্যকর সহযোগিতা প্রদান ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে। ঘোষণাপত্রের এই নির্দেশ কোনো সরকারই মেনে নিতে পারবে না। কারণ পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের সঙ্গে রাজনৈতিক কার্যক্রম অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হবে। তাছাড়া বাংলাদেশে পার্বত্য অঞ্চলের সীমান্তবর্তী এলাকায় জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি পাবে; যা ক্রমেই সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে জাতীয় উন্নয়ন ব্যাহত করবে। জাতিসংঘের এই ঘোষণাপত্রের শেষ অনুচ্ছেদ-৪৬-এ সবার মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি সম্মান দেখানোর কথা বলা হয়েছে এবং এই কাজটি গত মহাজোট সরকার সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সম্পন্ন করেছে। এর আগে ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি’ অনুসারে ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র, মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, সমতা, বৈষম্যহীনতা, সুশাসন এবং সরল বিশ্বাসের মূলনীতি অনুসরণ করা হয়েছে।

জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রের একাধিক অনুচ্ছেদ অনুসারে আদিবাসীদের কোনো অধিকার চর্চার ক্ষেত্রে বৈষম্য করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা, চাকরি ও অন্যান্য বিষয়ে বাঙালিদের মতো তাদেরও সমান সুযোগ দিতে বাধ্য থাকবে রাষ্ট্র। এর আরেক ধরনের ব্যাখ্যা দেয়া যেতে পারে, উপজাতিদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করলে কোটা সুবিধা বাতিল অনিবার্য হয়ে পড়বে। ফলে তাদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে। সে ক্ষেত্রে বাঙালি-উপজাতি সম্পর্কের মধ্যে বিরূপ ধারণা জন্ম নিতে পারে।

উল্লেখ্য, ভারতে বসবাসকারী একই স¤প্রদায়ভুক্ত উপজাতিদের সেখানকার সংবিধানে ‘আদিবাসী’ হিসেবে সম্বোধন করা হয়নি। বলা হয়েছে- ঝপযবফঁষবফ ঈধংঃব ধহফ ঝপযবফঁষবফ ঞৎরনবং। সংবিধানে আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং মিজোরামকে উপজাতি অধ্যুষিত রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী তথা উপজাতিগুলোর উন্নয়নে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে ১৯৭২ সালের ২২ জুন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রণীত ‘ইন্ডিজেনাস অ্যান্ড ট্রাইবাল পপুলেশনস কনভেনশন, ১৯৫৭’ (কনভেনশন নম্বর ১০৭)-এ অনুস্বাক্ষর করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নৃতাত্তি¡ক জাতিগোষ্ঠী এবং ট্রাইবাল জাতিগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়সহ তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার জন্য জাতিসংঘের এই সংস্থাটি আবার সংশোধিত ‘ইন্ডিজেনাস অ্যান্ড ট্রাইবাল পপুলেশনস কনভেনশন ১৯৮৯’ (কনভেনশন নম্বর ১৬৯) গ্রহণ করে। এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি দলিল জাতীয় পর্যায়ে উপজাতিদের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা ও কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয়। এখানে ট্রাইবাল বা সেমি-ট্রাইবাল বলতে ওই গোষ্ঠী ও ব্যক্তিদের বোঝানো হয়েছে, যারা তাদের ট্রাইবাল বৈশিষ্ট্য হারানোর প্রক্রিয়ায় রয়েছে এবং এখনো জাতীয় জনসমষ্টির সঙ্গে একীভূত হয়নি। বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত পথে অগ্রসর হয়ে বর্তমান সরকার পার্বত্য শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ি অধিবাসীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

মূলত পার্বত্য অঞ্চলে পুরো বাংলাদেশের জনগণের মাত্র ০.৫ শতাংশ উপজাতির বাস। এই উপজাতিরা দেশের এক-দশমাংশ ভূখণ্ডের অধিকারী। গত মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়েছে। ভূমি কমিশন গঠন ও ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল ২০১০’ জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। দেশের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের ধারণা সবাই মেনে নিয়েছেন; বিরোধী গোষ্ঠী গুটিকয়েক। অবশ্য বিরোধী ও স্বার্থান্বেষী মহল প্ররোচনা দিচ্ছে পার্বত্য এলাকা থেকে বাঙালিদের উচ্ছেদ করার জন্য; এ ধরনের ষড়যন্ত্র হবে মর্মান্তিক। পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সবার ঐকান্তিক ইচ্ছাই গুরুত্বপূর্ণ। কেবল সরকারকে দোষারোপ করে নিজেদের দায় এড়াতে পারবেন না উপজাতি সন্তু লারমা ও তার সমর্থকরা। তাদের ‘আদিবাসী’ প্রচারণাটি রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত। এ জন্য ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ জাতীয়ভাবে পালনের কোনো যৌক্তিকতা নেই; তার ইতিবাচক দিকও অনুপস্থিত।

ড. মিল্টন বিশ্বাস : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

Archive Calendar
Mon Tue Wed Thu Fri Sat Sun
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
2425262728