॥ বিশেষ প্রতিনিধি, খাগড়াছড়ি ॥ জাতিসংঘের আদিবাসী দিবস ঘোষণার ১৮বছর পর আদিবাসী অভিধান নিয়ে পাহাড়ে শুরু হয়েছে পাহাড়ীদের মাঝে নতুন বিরোধ। পার্বত্য শান্তিচুক্তির পক্ষে জনসংহতি সমিতি চায় আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি আর পার্বত্যচুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ চায় সাংবিধানিক স্বীকৃতি। শুধু তাই নয়, ইউপিডিএফ আদিবাসী দিবস নামে যে কোন অনুষ্ঠান পালনের বিপক্ষে। অপরদিকে সরকারী স্বীকৃতি ক্ষুদ্র নৃ-জাতি গোষ্ঠী হিসাবে। সবমিলে ৯আগষ্ট “বিশ্ব আদিবাসী দিবস” উদযাপন নিয়ে পাহাড়ে ধুম্রজাল তৈরী হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে এ দিবসটি পালনে পাহাড়ের এনজিওগুলো অনেক আগ থেকেই তোড়জোর শুরু করলেও এবার তেমনটি দেখা যায়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফ সমর্থিত “গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম” আদিবাসী দিবস পালনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নেয়। শুধু তাই নয় সংগঠনটির পক্ষ থেকে তিন পার্বত্য জেলার বিভিন্ন এলাকায় আদিবাসী দিবস বিরোধী জনমত সংঘটিত করা হচ্ছে বলে সূত্রে জানা গেছে। সংগঠনটির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, জনসংহতি সমিতির প্রধান সন্তু লারমা’র নেপথ্য সহযোগিতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি জাতি-গোষ্ঠী আদিবাসী দিবস পালনের নাম করে সরকার ও বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে ব্যাপক অর্থ পেয়ে থাকে এবং এ অর্থের সামান্য একটি অংশ দিয়ে র্যালী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা হয়, বাকী অর্থ তারা নিজেরা ভাগ-বাটোয়ারা এবং সন্তু গ্রুপের জন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করে।
এদিকে ২০১০ সারের ২৮ জানুয়ারী পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বসবাসরত উপজাতিকে আদিবাসী সম্বোধন না করতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারী করে সংশি¬ষ্ট সকলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (সমন্বয়-২) মুজিবুর রহমানের জারী করা প্রজ্ঞাপনে বাংলাদেশে বসবাসরত ‘উপজাতিদের’ ‘আদিবাসী’ বলে আখ্যাদানকারী বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, নেতৃবৃন্দ ও সমাজের বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের সমালোচনাও করা হয়েছে। এনিয়ে পাহাড়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দ তৎকালে সরকারের এ ধরনের নির্দেশের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে এখনো চলছে নানা বিতর্ক ও মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সহ তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজীব এ প্রতিনিধিকে বলেন, ৯আগষ্ঠ বিশ্বের আদিবাসীদের জন্য একটি তাৎপর্যময় দিন। জাতিসংঘ এ দিবসটি ঘোষণার কারণে সারা বিশ্বের আদিবাসীদের সাথে বাংলাদেশের আদিবাসীদের একটি যোগসূত্র তৈরী হয়েছে। আদিবাসী দিবসের নামে অর্থ লোপাট এবং অস্ত্র কেনা গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের অভিযোগকে কাল্পনিক এবং বিরোধীতার খাতিরে বিরোধীতা বলে তিনি উল্লেখ করেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুুক্তি সম্পাদনের পর থেকে পাহাড়ে দিবসটি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এবং বিভিন্ন এনজিও’র উদ্যোগে প্রতিবছর পালিত হতে থাকে। বিশেষ করে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম গঠিত হবার পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিস্বত্তাসমূহ নিজেদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং আদিবাসী হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবী জানিয়ে আসছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে আন্দোলনরত আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)’র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও খাগড়াছড়ি জেলা ইউনিটের সাবেক সমন্বয়কারী উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও ইউফিডিএফ এর সংগঠক মিঠুন চাকমা এবং পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সাবেক সভাপতি রিকো চাকমা মনে করেন, উপজাতি বা আদিবাসী হিসেবে আখ্যায়িত না করে পাহাড়িদের ক্ষুদ্র জাতিস্বত্তা হিসেবে স্ব স্ব জাতির সাংবিধানিক স্বীকৃতিই সকল বিতর্কের অবসান ঘটবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গোপন প্রজ্ঞাপন ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোকে “উপজাতি” হিসেবে সম্বোধন করার নির্দেশ জারি সম্পর্কে তাঁরা বলেন, বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোটের শাসনামলেও এ রকম প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ায় সে সময় বিতর্ক উঠেছিল। সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও জনগণের অধিকারের প্রতি এত প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারও আবার তার পুনরাবৃত্তি ঘটালো, যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও নিন্দনীয়। “উপজতি” শব্দটা উপনিবেশিক ধারণাপ্রসূত এবং অপমানজনক। এ অভিধা ভিন্ন ভাষাভাষী জাতিসত্তাসমূহকে অধস্থন হিসেবে দেখা তথা জাতি বিদ্বেষী নীতির প্রতিফলন বলে আমরা মনে করি।
খোঁজ নিয়ে জানাযায়, বাংলাদেশ সরকার এবং দেশের সর্বোচ্চ সংবিধানে কখনোই বাংলাদেশের উপজাতীয় বাসিন্দাদের ‘আদিবাসী’ বা উপজাতি বলে স্বীকার করা হয়নি। তবে দীর্ঘদিন থেকে মন্ত্রী এমপিসহ সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে আদিবাসী বলে বক্তৃতা বিবৃতি দেয়া হচ্ছে। বর্তমান সরকারও শুরু থেকেই দাপ্তরিকভাবে পিআরএসপি এবং সর্বশেষ জাতীয় বাজেটে ‘আদিবাসী’ বলে স্বীকার করেছে। ব্যাপক দাবী সত্ত্বে মানবাধিকার কমিশন ও প্রস্তাবিত ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইনে’ ‘উপজাতি’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসাবে ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার না করে ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। তবে সরকারের অনেক মন্ত্রী-এমপিসহ দায়িত্বশীল বিভিন্ন ব্যাক্তিবর্গ ‘উপজাতিদের’ ‘আদিবাসী’ বলে অভিহিত করে থাকেন।
সরকারী প্রজ্ঞাপনটিতে যা আছে
গত ২৮ জানুয়ারী ২০১০তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারীকৃত ‘উপজাতীয় সম্প্রদায় গুলোকে আদিবাসী হিসেবে অভিহিত করার অপতৎপরতা প্রসঙ্গে’ শিরোনামের এক প্রতিবেদনে (স্মারক: পাচবিম (সম-২)২৯/২০১০/২৫, তারিখ: ২৮/১/২০১০) বলা হয়েছে : “বাংলাদেশে ৪৫টি উপজাতীয় জনগোষ্ঠী বসবাস করে। বাংলাদেশের সংবিধান, পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন, এবং ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তিতে উপজাতীয় সম্পদায়গুলোকে ‘উপজাতি’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। তাদেরকে কোথাও ‘আদিবাসী’ হিসাবে অভিহিত করা হয়নি। তথাপি কতিপয় নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী, পাহাড়ে বসবাসরত শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ, এমনকি সাংবাদিকেরাও ইদানিং উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলোকে ‘উপজাতি’ না বলে ‘আদিবাসী’ হিসাবে অভিহিত করতে দেখা যাচ্ছে। এতদ বিষয়ে বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠান, বিদেশী সংবাদ মাধ্যম, জাতিসংঘের আড়ালে থাকা খ্রিস্টান রাষ্ট্রসমূহ এসকল ব্যাক্তিবর্গের সাহায্যে তাদের একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সহায়তায় অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে বসবাসকারী অধিকাংশ উপজাতীয় সম্প্রদায় এখন নিজ নিজ ধর্ম সংস্কৃতিতে অবস্থান না করে তাদের অনেকেই খ্রিস্টান হয়ে গেছে। বাংলাদেশীয় উপজাতীয়দেরকে ‘আদিবাসী’ উলে¬খ না করার বিষয়ে ইতোপূর্বে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হতে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছিল। তবে বর্তমানে সে নির্দেশনার কোনো কার্যকারিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি উপজাতীয়দেরকে ‘আদিবাসী’ হিসাবে চিিহ্নতকরণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন করে আদিবাসী মন্ত্রণালয় করার ব্যাপারে বিভিন্ন মহল থেকে দাবী উত্থাপিত হচ্ছে বলে জানাযায়। ইউএনডিপি. ডানিডা, এডিবিসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ এবং উপজাতীয়দের ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সেই সাথে উপজাতীয়দের ‘আদিবাসী’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তাছাড়া আমাদের দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও ওয়ার্কশপে এবং সাংবাদিকেরা বিভিন্ন লেখায় উপজাতীয়দের ‘আদিবাসী’ হিসাবে চিহ্নিত করছে। এরূপ কাজ অব্যাহত রাখলে উপজাতীয়দের ভবিষ্যতে ‘আদিবাসী’ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া আবশ্যক হয়ে পড়বে। বর্ণিত অবস্থায় বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন উপজাতীয় সম্প্রদায়কে কোনো অবস্থাতেই যেন ‘উপজাতি’ এর পরিবর্তে ‘আদিবাসী’ হিসাবে উলে¬খ না করা হয় এবং পার্বত্য অঞ্চলে যে সমস্ত এনজিও প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের কার্যক্রমের উপর নজরদারী বৃদ্ধিকরণসহ সতর্কতামূলক কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো”। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয় কর্তক স্বরাষ্ট্র সচিব এবং পার্বত্য ৩ জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের জেলা প্রশাসক বরাবরে এ গোপনীয় প্রজ্ঞাপনটি জারি করা হয়েছে।