॥ নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ পার্বত্য অঞ্চলে আবারো আঞ্চলিক দল গুলোর তৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের তৎপরতায় আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর কোনঠাসা হয়ে পড়লেও নতুন করে বাঘাইছড়ি উপজেলায় আঞ্চলিক দলগুলোর তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় রাঙ্গামাটির প্রশাসনকে ভাবিয়ে তুলেছে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলেও বাঘাইছড়িতে গত দু মাসে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গভীর রাত পর্যন্ত গুলি বিনিময়ের প্রকট শব্দে আবারো ভাবিয়ে তুলেছে প্রশাসনকে। আর এলাকায় বসবাসরত সাধারণ মানুষেরা রয়েছে আতংকে।
বাংলাদেশ সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল গুলোর সশস্ত্র ক্যাডারা দীর্ঘদিন বাংলাদেশ ভারত সীমান্তবর্তী ভারতের মিজোরাম, দেমাগ্রী, ত্রিপুরা সহ বেশ কয়েকটি জায়গায় লুকিয়ে ছিলো। প্রশাসনের তৎপরতা কিছুটা কমে আসায় তাদের নেটওয়ার্ক আবারো শক্তিশালী করে প্রবেশ করছে বাংলাদেশে। তারই ধারাবাহিকতায় বাঘাইছড়ি উপজেলায় প্রায় প্রতিটি কোন কোন জায়গায় গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। এই ঘটনায় হতাহত হলেও কেউ তা বলতে পারছে না।
পার্বত্য রাঙ্গামাটির রাজস্থলী, বাঘাইছড়ি, নানিয়ারচর এখন হঠ জোন হিসাবে পরিণত হয়েছে। এই সকল উপজেলা গুলোতে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল গুলোর আধিপত্য বিস্তার করে মাঝে মাঝে নিজেদের শক্তির পরীক্ষা করে দল গুলো। এই অবস্থায় পার্বত্য অঞ্চলের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান আবারো নতুন করে শুরু করার জোর দাবী উঠছে।
রাঙ্গামাটির দায়িত্বশীল একটি সুত্র জানায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) দীর্ঘদিন ধরে তাদের রাজনৈতিক কোন কর্মকান্ড চালাচ্ছে না। এটাকী তাদের কৌশল হতে পারে না কোন মরণ কামড় দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। তারা বাঘাইছড়ির কিছু কিছু এলাকা এখন নিজেদের দখলে নেয়ার জন্য শক্তি প্রয়োগ করছে।
অন্যদিকে দায়িত্বশীল একটি সুত্র জানায় সম্প্রতি জেএসএস ও ইউপিডিএফএর মাঝে অস্ত্র বিরতীর চুক্তি শেষ হয়ে গেছে। আধিপত্য বিস্তার করতে তারা মাঝে মাঝে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। অপরদিকে চুক্তি শেষ হওয়ার পর পর জেএসএস এর নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আঞ্চলিক দল গুলোর মাঝে আবারো বৈঠকের পরিকল্পনা চলছে। যদি আঞ্চলিক দল গুলো আবারো এক হয়ে যায় তাহলে পার্বত্য অঞ্চলে নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে।
এছাড়া পাহাড়ের আঞ্চলিক দল গুলোর হাতে অবৈধ অস্ত্রের মজুদ দিন দিন বাড়ছে। অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানিতে পাহাড়ে খুন, গুমসহ নিজেদের মাঝে প্রতিনিয়ত শক্তি প্রদর্শণের কারণে সাধারণ মানুষের জীবনে নার্ভিশ্বাস উঠেছে। প্রতিনিয়ত আঞ্চলিক রাজনেতিক দলের আধিপত্য বিস্তারের কারণে রাঙ্গামাটির বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষের শান্তি যেমন বিনষ্ট হচ্ছে তেমনি শত শত মায়ের বুক খালি হচ্ছে।
পার্বত্য তিন জেলার আঞ্চলিক ৫ টি দল অবস্থান করছে। দল গুলো হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (সন্তু গ্রুপ), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ইউপিডিএফ (প্রসিত গ্রুপ), পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (লারমা সংস্কার গ্রুপ), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ইউপিডিএফ (সংস্কার গ্রুপ) ও নতুন দল গঠন করে মগ লিবারেল ফ্রন্ট নামে আত্মপ্রকাশ করছে। মগ লিবারেল ফ্রন্ট বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির রাজস্থলী ও কাপ্তাই উপজেলায় অবস্থান করছে বলে সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে।
এদিকে পার্বত্য অঞ্চল ও ভারত এবং মিয়ানমারের অধিকাংশ বর্ডার এলাকা খোলা থাকায় অবৈধ নানা গোনা ও অস্ত্রের আনা গোনা বেশি পাওয়া যায়। রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল ও জুরাছড়ির বেশ কিছু এলাকা দিয়ে ভারতের অবস্থান এবং বিলাইছড়ি ও রাজস্থলীর বেশ কিছু এলাকা দিয়ে মিয়ানারের লোকজনের আনা গোনা বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। সম্প্রতি রাঙ্গামাটির রাজস্থলী উপজেলার কলেজ পাড়া এলাকায় আরাকান আর্মির আস্তানা পাওয়া গেছে। এসময় ডাঃ রেনিসো নামে একজনকে আটক করা হয় এবং তার বাসা থেকে মিয়ানমারের সন্ত্রাসী হামলার সময় মাইন বিষ্ফোরণে আহত একজনকে পাওয়া যায়। তার দুটি হাত উড়ে যায় ডাঃ রেনিন সোর বাড়িতে রেখে আহত ব্যক্তির চিকিৎসা রত অবস্থায় পাওয়া যায়।
সম্প্রতি খাদ্য মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাঙ্গামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার বেশ কয়েকটি সভায় বলেন, পার্বত্য অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলতে আঞ্চলিক রাজণেতিক দলগুলো পাহাড়ের অস্থিতিশীল করে তুলেছে। অবৈধ অস্ত্রের কারণে পাহাড়ের কোন মানুষ শান্তিতে নেই। পার্বত্য পরিস্থিতিতে অস্থিতিশীল করে তুলতে চাঁদাবাজী, খুন, অপহরণ, সহ আনা ধরনের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে তারা। তাদের রিরুদ্ধে পার্বত্য অঞ্চলের সকল সম্প্রদায়ের মানুষকে এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।
পার্বত্য চট্টগ্রামকে অশান্ত করার পাঁয়তারা করছে উপজাতীয় সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো। খুন, গুম, ধর্ষণ, চাঁদাবাজিসহ তাদের নানান অপকর্ম দিনদিন বেড়েই চলেছে। পাহাড়ে ৫ টি আঞ্চলিক সংগঠনের সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর হাতে সীমান্ত দিয়ে অবাধে আসছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ। মাঝে মধ্যে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীর সমন্বয়ে মাঝে মধ্যে অবৈধ অস্ত্র, গুলি ও অন্যান্য সরঞ্জাম উদ্ধার করা হলেও এদের নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না।
পার্বত্য জেলার অধিবাসীরা জানান, পার্বত্যাঞ্চলে মোতায়েনরত সেনাবাহিনীকে ছয়টি স্থায়ী সেনানিবাসে প্রত্যাবর্তন, সামাজিক উন্নয়ন ও বিদ্যুৎ উন্নয়নসহ প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ৩ পার্বত্য জেলায় ৪১ হাজার ৮৪৭ জনকে বয়স্ক ভাতা, ২২ হাজার ৪১০ জনকে বিধবা ভাতা, ৭ হাজার ৩১১ জনকে অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা এবং ৯৮১ জন প্রতিবন্ধীকে শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান করা হয়েছে। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের আওতায় এ অঞ্চলে ১ হাজার ৪৬টি সমিতির মাধ্যমে ৫২ হাজার ১৭২ জন সদস্যের দারিদ্র্য বিমোচন তথা জীবনমান উন্নয়ন করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ৬২৩টি পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে।
তারা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে আগে যেখানে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ ছিল না সেখানে নির্মিত হয়েছে ১টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১টি মেডিকেল কলেজ। হাইস্কুল ও কলেজের সংখ্যা যেখানে ছিল মাত্র ১১টি সেটা এখন ৪৭৯টি। প্রায় প্রতিটি পাড়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। শিক্ষার হার ২ ভাগ থেকে বেড়ে বর্তমানে ৪৪ দশমিক ৬২ ভাগে পৌঁছেছে। যেখানে বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষার হার ৫৯ দশমিক ৮২ ভাগ সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা জনগোষ্ঠীর শিক্ষার হার ৭৩ ভাগ। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিদের শিক্ষার হার ২৩ ভাগ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ১টি থেকে ৩টি করা হয়েছে, হাসপাতালের সংখ্যা ৩টি থেকে ২৫টিতে উন্নীত হয়েছে। যেখানে কোনো খেলার মাঠ ছিলো না সেখানে ৫টি স্টেডিয়াম নির্মিত হয়েছে। কলকারখানা, ক্ষুদ্র কুটির শিল্প ১৯৩টি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে এখন ১৩৮২টিতে উন্নীত হয়েছে। ফলে সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টায় পার্বত্য চট্টগ্রামে এককালের পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রভূত উন্নতির ছোঁয়া লেগেছে।